top of page
  • ..

ভারতের বাঘ: সময়ের পথ বেয়ে অনুসন্ধান (পর্ব ৪)

বাঘ ভারতের জাতীয় পশু। শৌর্যে, শক্তিতে সে পশুজগতের শীর্ষে ভারতের মাটিতে। বলা হয় বনের রাজা। হ্যাঁ, একসময়ে সত্যিই ছিল সে বনের রাজা। তারপর? তার সে রাজত্ব চলে গিয়ে অস্তিত্বের সংকট তৈরি হল কোন পথে? সারা দেশের মাটিতে যে দাপিয়ে বেড়াত, সে আস্তে আস্তে কোনঠাসা হয়ে পড়ল কেন সীমিত কিছু অরণ্যে! আজকের দিনেই বা কতটা তাকে স্বমহিমায় ফিরে পাবার আশা রাখা যায়! এই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা Wildlife Conservation Trust এর সভাপতি ও National Tiger Conservation Authorityর সদস্য, ভারতের বিশিষ্ট বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ ড: অনীশ আন্ধেরিয়া এবং ভারতের নরখাদক বাঘের ওপর মার্কিন গবেষক ও লেখক ডেন হাকলব্রিজের হাত ধরে। তাঁদের সাথে আলোচনায় বনেপাহাড়ে'র পাঠকদের সামনে ভারতের বাঘের সময়ের পথ ধরে যাত্রার কথা তুলে ধরছেন আমাদের সহযোগী সম্পাদক ড: ঐশিমায়া সেন নাগ।ধারাবাহিক রচনার শুরু হয়েছিল বিশ্ব পরিবেশ দিবসে। আজ চতুর্থ ও অন্তিম পর্ব





বাঘেরা কোথায় দাড়িয়ে

সারা ভারতের বাঘ গণনায় ২০১০, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংখ্যাটা এসে দাড়াল ১৭০৬, ২২২৬ ও ২৯৬৭ তে। ভারতের দিকে উচ্ছসিত প্রশংসার ঢেউ ভেসে এল।

কিন্তু ঠিক কী কী কারণ ছিল এই বাঘের সংখ্যা বাড়ার পিছনে?

"বেশ কিছু যথোপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া হল এবং প্রয়োগ করা হল"। ড: অনীশ অন্ধেরিয়া বললেন।

" Management Effectiveness Evaluation (MEE)। এই পদ্ধতি গ্রহন করা হল NTCA দ্বারা ভারতের বিভিন্ন টাইগার রিজার্ভের ম্যানেজমেন্ট কেমন চলছে বোঝার জন্য। সংরক্ষণের কাজে যুক্ত যে সব NGO তাদেরকেও আহ্বান জানানো হল বাঘ সংরক্ষণের লড়াইতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে। গ্রামগুলোর পরিবেশ উন্নয়ন সমিতিগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা হল। আরো বেশি বেশি বাঘের সম্ভাব্য বাসস্হান নজরদারির মধ্যে আনা হল। সুরক্ষা বাড়ানো হল টাইগার রিজার্ভগুলোয়। স্বেচ্ছায় বনবাসীদের স্হানান্তরের প্রক্রিয়ায় অর্থ যোগান দিতে শুরু করল NTCA আর রাজ্য সরকারগুলি। বাঘের আবাসস্হলগুলোয় জল সংরক্ষণের ব্যবস্হা নেওয়া হল। প্রতিটা বাঘের মৃত্যুকেই NTCA'র তরফ থেকে পোচিং বা চোরাশিকার বলে প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করা হবে বলে ঠিক হল, যতক্ষণ না অন্য কোন কারণ বলে প্রমাণিত হচ্ছে। এ ব্যাপারটা প্রতিটা টাইগার রিজার্ভ কর্তৃপক্ষকে সদাসর্বদা সজাগ রাখতে করা হল। ফরেস্ট গার্ড থেকে আই এফ এস অফিসার পদমর্যাদা পর্যন্ত্য নতুন নতুন তরুণ কর্মী নিয়োগ করা হল যাতে কর্মীদল বেশি তরুণ ও চনমনে হয়। কিছু কিছু রাজ্য STPF বা Special Tiger Protection Force তৈরি করল NTCA'র সুপারিশ অনুযায়ী যাতে শুধু বাঘেদের ওপর বিশেষ নজর রাখা যায়। এইসব পদক্ষেপ একত্রে সহায়ক হল বাঘেদের সংখ্যা বাড়াতে ও স্হিতিশীল করতে। তবে, মনে রাখা ভাল দেশের বিভিন্ন রাজ্যের কর্মদক্ষতায় ফারাক ছিলই।"


তবুও লড়াইয়ের পথ অনেক লম্বা


যতই, বন্যপ্রাণীদের মধ্যে রাজার সম্মান পাক, বাঘেদের অস্তিত্বের সংকট থেকেই গেছে। উপযুক্ত নিরাপত্তা ও পরিচালনার মাধ্যমে চোরাশিকারের ঘটনা যেমন কমানো গেছে, নতুন এক উপদ্রব এসে উপস্হিত হয়েছে - বাঘে ও মানুষে দড়ি টানাটানি। এক্ষেত্রে মানুষের ব্যবহারের পরিবর্তন ছাড়া বাঘেদের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে। "ভারতের সংস্কৃতি সবসময়েই ছিল পরিবেশবান্ধব। বাঘ সহ বিভিন্ন পশুপাখিকেই শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়, পুজো করা হয়।কিন্তু মানুষের মধ্যে বাঘ বা বাঘের খাদ্য যেসব প্রাণীরা তাদের সম্পর্কে বিদ্বেষ দানা বাঁধে যদি এরা তাদের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে অসুবিধার সৃষ্টি করে এবং কর্তৃপক্ষের তরফে সঠিক সময়ে যোগাযোগ আর উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের অভাব দেখা যায়। এই অবস্হায় সব ক্ষেত্রেই বাঘে-মানুষে দ্বন্দের সৃষ্টি হয়। মানুষ যে সমস্যা আসলে তা নয় এসব ক্ষেত্রে, সমস্যা হল অনুপযুক্ত ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা নিয়মকানুন।" জানালেন ড:আন্ধেরিয়া।

এবং বিশ শতকের চম্পাবতের বাঘিনীর মতই, এই শতকের T-1 বাঘিনী'র (যাকে আমরা 'অভনি' নামে চিনেছি) হত্যা আমাদের বুঝিয়ে দেয়, সময় অনেক এগোলেও বাঘেদের অস্তিত্ব মানুষের খামখেয়ালের সামনে কতটা অসহায়!


T1 বাঘিনী: এই শতকের চম্পাবত বাঘিনী?


২০১৮ এর ৩রা নভেম্বর। মহারাষ্ট্রের যবতমল জেলায় বাঘিনী T1, যে কিনা অভনি নামেই পরিচিত , আসগর আলি খানের হাতে নিহত হয়। আসগর হলেন একজন দীর্ঘদিনের শিকারী নবাব শফাত আলি খানের পুত্র।২০১৬'র জুন থেকে ২০১৮'র অগাস্টের মধ্যে অভনীকে ১৩ জন মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসাবে দেখা হয়। তাই বন বিভাগের নজরে সে অনেকদিনই ছিল। তার মৃত্যুর খবর কিন্তু সারা দেশে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। সাধারণ পশুপ্রেমী মানুষ থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মানেক গান্ধী অবধি ক্ষোভে ফেটে পড়েন এই ঘটনাকে 'নৃশংস হত্যা' বলে অভিহিত করে।


কমিটি এটা জানায় যে, আসগর আলি কোন রকম অনুমোদন ছাড়াই অভনিকে হত্যা করার অপরাধী। পুরো ঘটনাটাই চূড়ান্ত অব্যবস্হা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঘটে।
ক্যামেরা ট্র্যাপে অভনি ও তার শাবকের প্রাপ্ত ছবি

একটি বাঘ যার ওপর মানুষ হত্যার অভিযোগ. তার জন্যে এত আর্তনাদ কেন!তার অকাল মৃত্যু কি সঠিক ছিল?

ড:আন্ধেরিয়া মানছেন যে, কোন বাঘ যদি বারবার মানুষের সাথে দুর্ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে তখন তাকে মারাটা "necessary evil" হয়ে যায়, তবে সব ক্ষেত্রেই নিয়মকনুনের মধ্যে থাকতে হবে- যাকে বলে Standard Operating Procedure ( SOP)। বাঘিনী T1 এর ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। অনেকেই সতর্ক করেছিলেন, মিসেস গান্ধীও যে, অভনিকে বাঁচানো যেতে পারে তাকে ঘুমপাড়ানি গুলিতে অজ্ঞান করার পর বন্দী করে এবং পৃথক স্হানে রেখে সব SOP মেনে। বেসরকারি ট্রিগার-হ্যাপি শিকারিকে একটি বাঘিনীকে মারতে নিয়োগ করার ঘটনা গোটা দেশেই সমালোচিত হয়। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, মহারাষ্ট্র সরকারের গঠন করা একটা কমিটি অভনিকে ধরার বা হত্যা করার গোটা কর্মকান্ডে অনেকগুলি গুরুতর ত্রুটি খুঁজে পায়। কমিটি এটা জানায় যে, আসগর আলি কোন রকম অনুমোদন ছাড়াই অভনিকে হত্যা করার অপরাধী। পুরো ঘটনাটাই চূড়ান্ত অব্যবস্হা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঘটে। বিশেষজ্ঞরা এটাও মত প্রকাশ করেন যে, বাঘিনীটির বেশ কয়েকজন শিকার এবং বাঘিনী স্বয়ং বেঁচে যেত যদি আরো আগে যথাযথ ব্যবস্হা নেওয়া যেত সঠিক সময়ে।

দেশ জুড়ে প্রতিবাদ। ছবি: Avni the tigress/ facebook page

তাই, ব্রিটিশ ভারতের সেই ভয়ানক নিয়মকানুনের শিকার চম্পাবতের বাঘিনীর মতই এই বাঘিনীও একবিংশ শতকের ভারতের সংরক্ষণ নীতির দুর্বলতার শিকার। এবং বিশেষজ্ঞদের কথা মানলে এটাই বুঝতে হবে যে, বাঘের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে এই জনবিস্ফোরণের দেশে এই ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আরো বাড়বে।


বর্তমানের আশঙ্কাগুলি


প্রতিহিংসা বশত: বাঘেদের হত্যা- কখনও খাবারে বিষ মিশিয়ে, কখনও বেআইনি ভাবে ওভারহেড তারের সাথে সংযোগ করে বৈদ্যুতিক শক্ দেবার মত ঘটনা অভূতপূর্ব।

অভনির ঘটনা আমাদের আর একবার নাড়িয়ে দিয়ে গেল এই বাস্তবের প্রতি যে, ভারতের বাঘেরা এখনও কেমন সংকটে দাড়িয়ে। পুরানো বিপদগুলো ধীরে ধীরে বিদায় নেবার সাথে সাথে নতুন শঙ্কাগুলো প্রকট হচ্ছে। ড:আন্ধেরিয়া বাঘেদের সামগ্রিক বিপদগুলো সম্পর্কে বোঝালেন-"যদিও ভারতে অরণ্যে এখনও প্রায় ১০ হাজার বাঘেদের জায়গা হবে, তবু সেখানে যথেষ্ট খাদ্যের অভাব, একই সাথে স্হানীয় জনগোষ্ঠীর বিরূপতা তাদের সংরক্ষণের পক্ষে মূল বাধা"। তিনি বলেন," প্রতিহিংসা বশত: বাঘেদের হত্যা- কখনও খাবারে বিষ মিশিয়ে, কখনও বেআইনি ভাবে ওভারহেড তারের সাথে সংযোগ করে বৈদ্যুতিক শক্ দেবার মত ঘটনা অভূতপূর্ব। এছাড়াও, বন থেকে বনে যোগাযোগের 'করিডর'গুলিতে বাধা-বিঘ্ন তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন পরিকাঠামো তৈরির কাজের জন্য। বন ধ্বংস হচ্ছে। কমে যাচ্ছে আবাসস্হল। ফলত: বাঘেদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সুষ্ঠ মিলন প্রক্রিয়া বাধা পাচ্ছে।"


ভারতের দরকার বাঘেদের

সবার শেষে আমাদের এই আলোচনায় আসতেই হবে, কেন আমাদের বাঘেদের বাঁচাতে হবে?

"বাঘেদের নাম এবং চেহারাতেই এক আশ্চর্য শক্তি বা ক্যারিশমা আছে। এমনকি এমন কেউ, যে কখনও বাঘ দেখেনি- তারও বাঘের নাম শুনলেই সম্ভ্রম জাগে মনে। বাঘেদের সর্বজনীন যে আবেদন তাকে কাজে লাগিয়ে তার বাসস্হানকে সুরক্ষিত করার ব্যবস্হা করা হয়েছে, যার ফলে শুধু বাঘই নয়- সেখানে বাস করা আরও কত প্রজাতি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। এবং এর ফলে অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন, নদী-যেগুলোর উৎপত্তি বাঘেদের জন্য সুরক্ষিত বন থেকে, সেগুলোও রক্ষা পেয়েছে।" ড:আন্ধেরিয়া ব্যাখা করলেন।

" এছাড়াও টাইগার ট্যুরিজমের অর্থনৈতিক লাভ তো আছেই। এই ধরনের ট্যুরিজমে দেশ ও বিদেশ থেকেও অনেক মানুষ আসেন। এই অর্থনীতির ফলে গ্রামেদেশের অনেক পরিবার টিকে আছে। যদিও, এই টাইগার টুরিজমকে আরো ভাল ভাবে কিভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে তা দেখার অবকাশ তো আছেই"।

সাফারি শুরুর অপেক্ষায়

গ্রামের কৃষি অর্থনীতিতেও বাঘের মত বাস্তুতন্ত্রের শীর্ষে থাকা মাংশাসী প্রাণী কিভাবে কাজে লাগে তাও ড:আন্ধেরিয়া বোঝালেন। বাঘ শাকাহারী, তৃণভোজী বন্যজীবদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রেখে তাদের দ্বারা ফসলের ক্ষতিসাধন রোধ করে। ভারত হল পৃথিবীর ৭০% বাঘের আবাস। দেশের জাতীয় প্রাণী। তাই তার সংরক্ষণ শুধুমাত্র একটা সংকটে থাকা প্রাণীকে রক্ষা করার থেকেও অনেক বেশি কিছু।

"বাঘের নামটাই ভারত নামক দেশটির সাথে সমার্থক।ভারতের গৌরবময় প্রতীক।ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অবশ্যইআমাদের বাঘ বাঁচাতে হবে", ড:আন্ধেরিয়ার শেষ কথা। (শেষ)



লেখক পরিচিতি: ড: ঐশিমায়া সেন নাগ বায়োকেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট। বর্তমানে বন্যপ্রাণ ও সংরক্ষণের কাজে নিবেদিত। কানাডা থেকে প্রকাশিত শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট worldatlas এর অন্যতম সম্পাদক। বর্তমানে বাংলা ওয়েবজিন 'বনে-পাহাড়ে'র সহ-সম্পাদিকার দায়িত্বেও তিনি যুক্ত।


শিরোনাম ও সাফারির ছবি: শ্রী শ্যামাপ্রসাদ সাঁই।












Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page