top of page

বনদেবী দেখেছি

  • ...
  • Apr 16
  • 19 min read

নতুন বছরে আবার গল্পের ঝুলি বনেপাহাড়ের পাতায়। ভালোবাসার টানে মার্কিন প্রবাসী কর্পোরেট ম্যানেজারের প্রবেশ ভারতের বনের গহীনে। খুঁজে কি পেল সে তার পুরানো ভালোবাসাকে বসন্তের বনে? নতুন বছরে পাঠকদের জন্য থাকল সেই আখ্যান উপহার। অপূর্ব কুমার রায়ের কলমে।



বসন্তের সাত সকালে ট্রেনটা এসে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল  নিচু প্ল্যাটফর্মটায়। লাল সুড়কি দিয়ে বিছানো প্ল্যাটফর্ম চত্ত্বর।  এক প্রান্তে  ফলকে  হিন্দি, ইংরাজি আর উর্দুতে লেখা স্টেশনের নাম। সুহাগপুর  । নামটা আর একবার পড়ে নিতেই অভীককে জড়িয়ে ধরল একরাশ আবেগ, অনুভূতি। কি যে জাদু আছে নামটায়।

শান্ত স্টেশন চত্বরে লোকজন নেই বললেই চলে। কয়েকটা কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। একজন মহিলা ঝাড়ু দিচ্ছেন। সরিয়ে দিচ্ছেন লাল মাটির উপর ছড়িয়ে থাকা হলুদ কৃষ্ণচূড়াগুলোকে একপাশে।

আস্তে আস্তে কোলের ব্যাগটাকে জড়িয়ে ধরে স্টেশনের বাইরে পা দিল অভীক। বাইরেই একটা বিরাট শিমূল গাছ গোটা চৌহদ্দিটাকে ফুল ঝরিয়ে লালে লাল করে রেখেছে। বাতাসে নাম না জানা ফুলের গন্ধ, লাল ধুলোর গন্ধ আর সামনের দুটো চায়ের দোকান থেকে বার হওয়া ধোঁয়ায় একটা  মনকেমন অনুভূতি সৃষ্টি করেছে অভীকের মনে । মাত্র দু'দিন আগে নিউ জার্সি থেকে ভারতে পা রাখা অভীককে ঘিরে ধরেছে অদ্ভুত নস্টালজিয়া, থরথর আবেগ, বহুদিনের চেনা কিছু অনুভূতি। অনুভূতিটার নাম পরাগ। ওর পরাগ।

 

 

সামনের চায়ের দোকানটায় পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াল। গরম গরম সিঙ্গাড়া ভাজছে কড়াইতে। কিছু লোক পুরানো একটা কাঠের বেঞ্চে বসে দেহাতি হিন্দিতে মৃদু স্বরে গল্প স্বল্প করছে । অভীক দুটো সামোসা দিতে বলতে বড় একটা কী জানি গাছের পাতায় ভাজ করে ধোঁয়া  ওঠা সিঙ্গাড়া দিল ওকে । না বলতেই পাশে এসে গেল কাচের গ্লাস ভর্ত্তি দুধ চা। দুধ চা খাবার অভ্যাস ওর কোনদিনই ছিল না। কিন্তু এখানে বোধহয় ওসব ব্ল্যাক টি কেউ খায় না।

হাওয়ায় শীতের আমেজের মধ্যে ওই দুধ চায়ে চুমুক দিয়ে মনে হল এখানে, এই পরিবেশে এর থেকে উপযুক্ত কিছু হত না । কী যেন মশলা দেওয়া ঘন দুধে বানানো চা'য়ে। গন্ধটা যেন পরাগেরই। এখানে পা দিয়ে থেকে যা কিছু অনুভব করছে সব কিছুর সাথে পরাগকেই মিলিয়ে ফেলছে ও। অথচ পরাগও এইদিকে এসেছে তো হল মাত্র মাস দেড়েক।

 

শিমূল গাছটার তলায় কয়েকটা অটো দাঁড়িয়ে। অভীক একটা অটোর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল মারাই যাবে কিনা। চালক রাজি হতে ব্যাগ নিয়ে উঠে বসল অটোয়।

শহরটা ছোট।  ইতি উতি কিছু দোকান পাট, ডাক্তারখানা, বসত বাড়ি।  কিছু পরেই এসে পড়ল গ্রাম দেহাত, খেত খামার। দূরে নীল আকাশের নীচে সবুজ পাহাড়ের ঢেউ। দু’পাশে ঢেউ খেলানো গমের ক্ষেত। ইতি উতি উড়ে যাচ্ছে টিয়ার ঝাঁক। অনেক গ্রিন বী-ইটার। মাঝে মধ্যে এক আধটা কুঁড়ে ঘর পড়ছে। দেহাতি মাটির বাড়ি, খাপরার চাল। কিছু মেয়ে সাইকেলে দল বেঁধে চলে গেল স্কুলের পোষাকে।

“ এদিকে পরশু রাতে বাঘ এসেছিল স্যার”, অটোচালক বললেন।

“এই জায়গায়?”

“হ্যাঁ। আমার বাড়িও এইদিকে। রাতের বেলা বুনো শুয়ার আসে বলে একজন কৃষক ক্ষেত দেখতে গেছিল।  তখন দেখে আলপথ দিয়ে বাঘটা যাচ্ছে। বিরাট বাঘ। ছেলে বাঘ”।

“ওরা এভাবে চলে আসে নাকি জঙ্গলের বাইরে?” , অবাক গলায় বলল অভীক।

“জঙ্গল আর কত দূরে স্যর! ওই তো দূরে দেখা যাচ্ছে। ওটা বাফার ফরেস্ট। ওখানে বেশ কিছু বাঘ আছে। তেন্দুয়া আছে। আর বাঘেরা তো এভাবেই যাতায়াত করে এক জঙ্গল থেকে আর এক জঙ্গলে।“

অভীক চুপ হয়ে আবার দেখতে থাকে চারপাশ। পাখির দেশ, বাঘের দেশ। যে দেশ ভালোবেসে পরাগ ছুটে ছুটে আসে এইসব জায়গায়।

সেই ছোট্ট পরাগ। স্কুল পাশ করে সদ্য কলকাতায় পা রাখা মেয়েটা। অভীকও তখন কলেজের প্রথম বর্ষ। যাদবপুরের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। কলেজ শেষে বাড়ি ফিরতে ধরত আনোয়ার শাহ রোড- নিমতলা ঘাট মিনিবাস। সেখানেই রোজ দেখত ফর্সা, মিষ্টি মেয়েটাকে। চেষ্টা করত এমন কোন জায়গায় বসতে যেখান থেকে একটু ঝলক দেখতে পায় পানপাতার মত মিষ্টি মুখটা, ফরসা হাতের আঙ্গুল গুলো।

 তারপরের ক’টা দিন যেভাবে গড়িয়েছে ভাবলে আজও  অভীকের কোন সিনেমার চিত্রনাট্য মনে হয়। অসাধারণ কোন সিনেমা না। যেমন গল্প লেখা হয় ওদের মত সাধারণ ছেলেমেয়েদের জন্য তেমনই গল্প। কিন্তু সেটা যার যার নিজের জীবনের স্পেশাল সিনেমা।  দুরুদুরু বুক নিয়ে একদিন সাহস করে নাম না জানা মেয়েটির পাশে গিয়ে বসে পড়া, কোন কথা না বলেই নিজের স্টপেজ পদ্মপুকুরে নেমে যাওয়া, তারপরে একদিন ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে দেখা, তাকিয়ে থাকা দু;জনের দিকে, প্রথম কথা বলা, প্রথম মিলনদায় গিয়ে বসা। তখনো ছিল আর্চিস গ্যালারি। তার কার্ডের ছাপার অক্ষরে জানানো মনের কথা।

 ঝাড়খন্ডের নোয়ামুন্ডি থেকে কলকাতায় পা রাখা মেয়েটা সেই বনদেশের প্রকৃতির মতই ছিল নিষ্পাপ আর পেলব। আহিরিটোলায় মাসির বাড়িতে থেকে রোজ আনোয়ার শাহ মিনি চেপে দক্ষিণ কলকাতায়  পড়াশুনা করতে যাওয়া মেয়েটাকে যেন কোনদিন ছুঁতে পারেনি শহর কলকাতার কৃত্রিম নাটকীয়তা, জটিলতা, রাজনীতি, টানাপড়েন। অভীকের মনে হয়েছে বরাবর সেই যে ‘ফার্স্ট ইয়ারে’ র মেয়েটিকে ও দেখেছিল- জুলোজি তে গ্র্যাজুয়েশান, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান করা, পি এইচ ডি – সবটা সময়েই একই থেকে গেছে। যে সময়ে সম্পর্কের হাতবদল হয় ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে, সেই সময়ে অভীক-পরাগের সম্পর্কে কোন টানাপড়েন তৈরি হয়নি। অভীকের মনে হয়েছে এর কারণ একমাত্র পরাগের অমলিন চরিত্র আর সম্পর্ক থেকে শুরু করে জীবনের ছোট ছোট সবকিছুর প্রতি  ওর পরম যত্নে আগলে রাখার ক্ষমতা। পরাগ শুধু নিজেকেই নয়, অভীককেও কোনরকম পদস্খলন হওয়া থেকে আটকে রেখেছিল।

 সবুজ স্বপ্ন চোখে আঁকা ছিল পরাগের। জুলজি পড়া শেষে বন্যপ্রাণীদের নিয়ে কাজ করবে। বনের দেশে বেড়ে উঠেছে ও। বাবা কাজ করত নোয়ামুন্ডিতে সেল কোম্পানিতে। অনেক জায়গা জুড়ে বিস্তৃত লৌহ আকরিকের খনি। আর তাকে ছাড়িয়ে বন, পাহাড়ের রাজত্ব। যদিও বাঘ, হাতির মত জন্তু সেখানে আর ছিল না। কিন্তু ছোট থেকেই ওদের সবুজে ঘেরা কোয়ার্টারের আশেপাশে পরাগরা দেখে এসেছে শেয়ালের আনাগোনা, বনবিড়াল, গোসাপ থেকে নানা পাখি, গিরগিটির জগত ছিল সেটা। বাড়িতে কাজ করতে আসা পার্বতী মাসির থেকে শুনত ওদের আদিবাসী গ্রামের ওদিকে মহুয়া গাছের তলায় রাতের বেলা কেমন ভালুকেরা দলবেঁধে মহুয়া খেতে আসে।রাতের পথে গাড়িতে যেতে যেতে হঠাৎ পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লেপার্ডের দেখা পাওয়া।

 ও  শুনেছে ওদের এলাকায় জঙ্গলে আগে অনেকরকম জন্তু জানোয়ার পাওয়া যেত। কিন্তু খনি এলাকা বড় হওয়ায়, শিকারিদের উৎপাতে এখানে থাকা হরিণ, বাঘ, হাতিরা সব কোথায় যেন চলে গেছে।  ওদের জন্য ছোট থেকেই ওর মন কাঁদত। মনে হত এই সব না-মানুষ জীবগুলোই ওর আত্মার আত্মীয়। বড় হয়ে ওদের জন্য কিছু করতে হবে। তাই স্কুলশেষে জুলজির মত বিষয় বেছে নিয়েছিল পরাগ। অন্য বন্ধুরা যখন পড়ার পর চাকরি বাকরি বাগিয়ে বা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে  শহরকেই বেছে নিচ্ছিল জীবনের গন্তব্য, ও আবার ফিরে যেতে চেয়েছিল বনের কাছে।

 এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একটা নীল জলরাশি ভেসে উঠল অভীকের চোখে।

“ ওটাই মারাই রিজার্ভার স্যর”, অটোওয়ালা বলে উঠল। আচ্ছা এই তাহলে সেই মারাইয়ের দেনোয়া তাওয়া নদীর রিজার্ভার। এইপাশে সাতপুরা, ওইপাশেও সাতপুরার অরণ্য। ওপারেই আছে ওর পরাগ।

অটোওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে রোদ গায়ে মেখে হাঁটতে হাঁটতে ও এসে দাঁড়াল নদীর পারে। বসন্ত বাতাসে জলের মধ্যে হালকা ঢেউ খেলে যাচ্ছে। সামনে একটা মোটর বোট বাঁধা ছিল। সেখান থেকে খাকি পোশাক পরা একজন ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

“স্যর আপ অভীক মুখার্জী হ্যায় কা?”

“ জি হাঁ.. ইয়েস”

“স্যর আপনাকে ওই পারে নিয়ে যেতে এসেছি। আমার নাম মোহন কাহার। আপনি তো মাঝেপুরা ক্যাম্পে যাবেন?”

“হ্যাঁ, ওইরকমই তো কী একটা নাম শুনেছি।  ওখানে কি  আপনাদের পরাগ ম্যাডাম আছেন? পরাগ লাহিড়ী?”


পড়ুন এই লেখকের অন্য গল্প: বড়গল্প: দার্জিলিঙের কাছে



“ ও তো মালুম নাহি সাহাব। ফরেস্টের বিট  অফিসার স্যর আপনাকে নিতে পাঠালো।“

কাঠের পাটাতন দিয়ে কিছুটা এগিয়ে এসে মোটর বোটটায় নেমে বসল অভীক। আস্তে করে স্টার্ট দিয়ে জলে ঢেউ তুলে তারপরে জোরে ছুট দিল বনদপ্তরের মোটরবোট।  নীল জল ভেদ করে চলেছে। ঢেউয়ের দোলা লেগে উড়ে গেল বেশ কিছু বড় বড় হাঁস। আরে এগুলো তো বার হেডেড গিজ! পরিযায়ী পাখি। এইসব ও জেনেছে পরাগের থেকে। আবাল্য দক্ষিণ কলকাতার  ইঁট-কাঠের পরিবেশে বেড়ে ওঠা, আদ্যন্ত পড়ুয়া অভীককে  একটা অন্য পৃথিবীর ঝলক দেখাত পরাগ। ও আজও বোঝেনা দুই জগতের দুটি মানুষ কিভাবে এতগুলো বছর একসাথে হাত ধরে চলল। পরম মমতায় একে অপরকে জড়িয়ে রাখল!

“তুই কি দেশেই থেকে যাবি? এখানে আসবি না? রাজন্যা-সুমন্তকে দেখ। কেমন আটলান্টায় সেটল করে গেল। বাচ্চাও হয়ে গেছে। তোর মাসির মেয়ে রাগিনীও সামনের মাসে বিয়ে করে চলে আসছে আরিজোনায়। আমাকে মেসেজ করেছিল যে আমরা কবে এখানে ঘর  বসাচ্ছি! আমার বাড়ির থেকেও এবার বলছে বিয়ের কথা। ওরা তো তোকে চেনে। কিন্তু তুই কী চাইছিস? আমার কোম্পানি থেকে বারবার গ্রীণকার্ড নিয়ে নিতে বলছে এবারে। এখানে চলে আয়। চাইলে কোথাও একটা রিসার্চে জয়েন করতেও পারিস এখানে ।“- মাস ছয়েক আগে অভীক ফোনে বলে পরাগকে।

 বিগত তিন বছর ধরে অভীক যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা।  আই আই এম থেকে এম বি এ করে বহুজাতিকের উচ্চপদে আসীন । যে দেশে যাবার, থিতু হবার উচ্চাশা ওর মত তুখোড় মেধাবী ছাত্ররা বহু বছর ধরে লালন করে মনের গোপনে। কিন্তু পরাগ তো পরাগ। দেশের বনে বনে লাল ধুলোর পথে ও তখন নিজের  গন্তব্য বেছে নিয়েছে। হরিয়াণার একটা ইউনিভার্সিটিতে চলে গেল বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণায়।

“তুই একবার আয়। সামনে থেকে কথা বলি আমরা। এক বছরের উপর তো হয়ে গেল তুই আসিসনি দেশে। দেখিনি তোকে। এইসব কথা কি ফোনে হয় রে?”, পরাগ ডাক পাঠিয়েছিল।

অবশেষে এক সপ্তাহের ছুটি কোনরকমে জোগাড় করে অভীকের ভারতে আসা এবারে। কলকাতায় নেমেই সেদিন রাতের ট্রেন ধরে গন্তব্য মধ্যপ্রদেশ। কারণ প্রোজেক্টের কাজে সে তখন অরণ্যের কোন গভীরে ক্যাম্পে। বাইরে আসা সম্ভব নয়।   পরাগকে বুঝাতে হবেই যেভাবে। ওদের দুই  হৃদয়ের নদী যেভাবে দু’দিকে বয়ে যাচ্ছে তা অভীককে কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।

 নদীর অন্য পাড়ে এসে নামতে দেখতে পেল বেশ কিছু জিপসি গাড়ির ভিড় সেখানে। পর্যটকরা সাফারি শেষ করে ফিরছেন এক এক করে। এদিক ওদিকে ছড়ানো  বনদপ্তরের অতিথি নিবাস, অফিস। মোহন ওকে নিয়ে গেল একটা অফিস ঘরে। সেখানে একটা খাতায় বিশদ নাম, পরিচয় সব লিখতে হল। জমা করতে হল পরিচয়পত্রের ফটোকপি।

“আইয়ে স্যর”, মোহন ওকে নিয়ে এবার হাঁটা দিল বনে ঢোকার গেটের দিকে। সেখানে একটা জিপসি দাঁড়িয়ে।  ওরই অপেক্ষায়।  ড্রাইভার নেমে এসে দরজা খুলে দিল । মোহনকে বিদায় জানিয়ে জিপসিতে বসল ও।

“ আমি অমিত। অমিত বাজপেয়ী। মাঝেপুরা ক্যাম্প থেকে আসছি স্যার। ফরেস্ট গার্ড”, ড্রাইভার ছেলেটি বলল।

বনের পথে ধুলো উড়িয়ে জিপসি চলল সবুজের মধ্যে দিয়ে।

দূর থেকে একটা ক্যাম্প দেখা গেল অনেকটা পথ পার হবার পর । সেগুন আর হরজাই গাছের বন পার হয়ে একটা তৃণভূমির মধ্যে এসে পড়েছে ওরা।তার একদিকে একটা পাহাড় উঠে গেছে। এতটাই খাড়া যে সেখানে গাছপালা তেমন হয়নি। তারই নীচে ক্যাম্পটা। এদিক ওদিক ছাড়নো কিছু সবুজ রঙের ঘর,  একদিকে মাঠের উপর বড় একটা সোলার প্যানেল। দূর থেকে  ক্যাম্পের প্রবেশপথের দিকে তাকাতেই হঠাৎ করে চোখটা আর্দ্র হয়ে এল অভীকের।  ওটা কে দাঁড়িয়ে আছে? নেভি ব্লু একটা টি-শার্ট আর কালো জিনস পরে। বাতাসে উড়ছে খয়েরি চুল।  ওর পরাগ। পরাগই তো?

ক্যাম্পের প্রবেশপথ কাছে আসতেই স্পষ্ট হল অবয়বটা। নেভি ব্লু টি শার্ট ছুটে এল তখনও চলন্ত জিপসির কাছে। গাড়ি থেকেই হাতটা বাড়িয়ে দিল অভীক। দুই হাতে অভীকের  শক্ত হাতটা জড়িয়ে ধরল ওর পরাগ।

অমিত তারমধ্যেই  অভীকের ব্যাগপত্তর হাতে নিয়ে ওর নিজের ঘরে চলে গেল। অভীক এখানে দু’দিন অমিতের সাথেই থাকবে। এইরকম বনের কোর এরিয়ায়, নন-টুরিজম জোনে বাইরের কারুর প্রবেশের অনুমতি মেলে না। কিন্তু পরাগ  ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউটের অন্যতম মাথা প্রদীপ শুক্লার প্রিয় ছাত্রী। পরাগের একগ্রতা, নিষ্ঠা, কাজের প্রতি সততায় শুধু শুক্লা স্যর নন, আরো অনেক গবেষক, শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্রী ও। ড: শুক্লার একান্ত অনুরোধে মধ্যপ্রদেশের বনবিভাগের এক বড় কর্তার বিশেষ পারমিশন পাওয়া গেছে অভীকের এই দু’দিনের সফরের। শুক্লা স্যর জানেন তার এই ছাত্রীর জীবনের এই টানাপড়েনের গল্প।


পড়ুন এই লেখকের অন্য গল্প: প্রথম শিমুল ফুল

 

দু’জনে ওরা চুপ করে বসে একটা ছোট নদীর পাশে। ক্যাম্পের পিছন দিয়েই বয়ে গেছে নদীটা। নদীর ওপারেই উঠে গেছে উঁচু পাহাড়। গাছের ছায়ায় বসে ওরা শুনছে পাখির ডাক, নদীর কলতান। কেউ কিছু বলতে পারছে না। পরাগ তো বরাবরই কম কথার মেয়ে। বলে কম, শোনে বেশি। আর অভীক প্রকৃতির এই স্বর্গরাজ্যে ওর রাজকন্যাকে পাশে পেয়ে আবেগে  নিশ্চুপ। কতদিন পর গলার কাছটা ভারী হয়ে আসার অনুভূতি।

“ আমরা এখানে কাজ করছি ওয়াইল্ড ডগদের নিয়ে। যাদের দেশীয় ভাষায় বলে ঢোল। ঢোলদের সংখ্যা তো বেশ কমে আসছে। সাতপুরার এই মারাই আর চূর্নার দিকে ঢোলদের নিয়ে এত ডিটেলে কাজ আগে হয়নি। ওদের সংখ্যা কত হতে পারে, ওদের বাসস্থানগুলো, ওদের জীবনধারণ পদ্ধতি সবটা নিয়ে চলছে আমাদের রিসার্চ। দেড় মাস হয়ে গেল। আরো হয়ত একমাস থাকব এখানে। বিভিন্ন দিকে  ক্যামেরা ট্র্যাপ লাগানো, সেগুলো খুলে নিয়ে এসে কী ছবি এসেছে তা পরীক্ষা করা। ওদের মলের নমুনা সংগ্রহ। এখানে একটা ছোট ল্যাবরেটরি বানিয়েছি আমরা। সেখান এইসব  নমুনা , আবার ওদের খাবারের অবশেষ সংগ্রহ করে এনে তার পরীক্ষা- এইসব চলছে।  এসব করতে করতেই…”

“হাই পরাগ। “ পরাগের কথার মাঝেই পিছন দিক থেকে জোরে সম্বোধনটা ভেসে এল।

ওরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল  দুটি ছেলে মেয়ে এদিকেই আসছে।

“ লেট মি ইনট্রোডিউস। ওরা হাজব্যান্ড- ওয়াইফ। আমার কলিগ। আমরা সব একসাথে কাজ করছি। সৌম্য বিশ্বনাথ আর   অশোক গৌড়। ওরা দু’জন ব্যাঙ্গালোরের। জানলে অবাক হবি অভীক, ওরা তোর মত কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু সেই জব ছেড়ে এখন পুরাদস্তুর ওয়াইল্ডলাইফ রিসার্চার। এমন পাগল এরা”, পরাগ আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল।

অশোক আর সৌম্য -দুজনেই এগিয়ে এসে অভীকের সাথে করমর্দন করল। ওদের করমর্দনের মধ্যে একটা উষ্ণ অভ্যর্থনা টের পেল অভীক। আন্তরিক। কোথায় পড়েছিল অভীক যে বন জঙ্গল, প্রকৃতির মধ্যে থাকা মানুষরা অনেক খোলা মনের, আন্তরিক হন।

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর ওরা বার হল একটা জিপসিতে। ওদের দলের একজন সঙ্গী সকাল থেকেই বনের একদিকে সমীক্ষার কাজে গেছে। অতুল সিরাজ। কাশ্মীরের ছেলে।  ওরা যাচ্ছে অন্যদিকে । এদিকটা আগেই সার্ভে করে কোথায় কোথায় ট্র্যাপ ক্যামেরা বসানো হবে ওরা ঠিক করে এসেছে।  এখন নিয়ে যাচ্ছে সেগুলো। অভীকও ওদের সাথেই গাড়িতে ।

 একটা নালা পার হতে হতে গাড়িটা হঠাৎ থামিয়ে দিল অমিত।

“কী হল”, অশোক জিজ্ঞাসা করল।

“টি-১৬ টাইগ্রেস দেখুন। এদিকেই আসছে। পিছনে ওর তিনটে বাচ্চা”।

দূরে তাকিয়ে ওরা দেখতে পেল ঘাস, গুল্ম লতার আড়াল থেকে একটা বড় বাঘ আসছে। পিছনে এক এক করে উঁকি দিচ্ছে তিনটে ছোট ছোট বাচ্চা।

“ স্পেলনডিড ইয়ার”, পরাগের মুখ থেকে বেরিয়ে এল  আস্তে করে।

অভীক তো একটু ভয়ই পেল। মা বাঘিনী আবার আক্রমণ করে বসবে না তো। ছোটবেলায় একটা মা কুকুর ভয় পেয়ে ওকে কামড়ে দিয়েছিল একবার। সেই স্মৃতি মনে পড়ে গেল।

বাঘিনী তার বাচ্চাদের নিয়ে আস্তে আস্তে জলের কাছে এল। ওদের গাড়িটা দেখতে পেয়েছে। এইদিকে টুরিস্টদের জিপসি তো তত আসে  না। ও হয়ত খুব একটা অভ্যস্ত নয় মানুষের আনাগোনায়। তবে খুব একটা কিছু চঞ্চল হল না সে। আস্তে আস্তে বাচ্চাদের নিয়ে জলের ধারে এসে বসল।

অভীক ভাবছিল, ভারতের বাঘকে যে স্বমহিমায়  জঙ্গলে না দেখেছে সে বুঝবে না তার রাজকীয় চলন। আশার কথা ভারতে আবার বাঘ বাড়ছে। সেটা ভাবতেই ও পরাগের দিকে তাকাল। ওর মত মানুষদের জন্যই তো বাড়ছে, ভাল হচ্ছে প্রকৃতির। আর ওকে এখান থেকে নিয়ে এসে যেতেই ওর আসা ভাবতেই বুকের কাছটা কেমন করে উঠল।

 গাড়িটা আবার চলতে শুরু করল। পরাগ, সৌম্যদের রোজকার কাজে বাঘ-ভাল্লুকের সাথে দেখা হয়ে যাওয়াটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। পথে যেতে যেতে আবার গাড়ি থমকে গেল। একদল চিতল হরিণ দৌড়ে পার হল রাস্তা। দূরে ঘুরছে কিছু বারা শিঙ্গা। কানহা থেকে কিছু বছর আগে ওদের আনা হয়েছে।

“ এই যে বড় বড় গ্রাসল্যান্ড বা ঘাসজমিগুলো দেখছিস, এগুলোয় আগে গ্রাম ছিল। টাইগার রিজার্ভের জন্য গ্রামবাসীরা এই গ্রামগুলো ছেড়ে দিয়ে বাইরে চলে গেছে। স্বেচ্ছাতেই গেছে বেশিরভাগ। কারণ বনের ভিতরে থেকে ওদের জীবন যাপনের তেমন সুবিধা হচ্ছিল না। ওদের ফসল খেয়ে যেত জন্তুরা। বাঘে, লেপার্ডে তুলে নিয়ে যেত গবাদি পশুদের। ওদের উপরেও অনেক সময় আক্রমণ হত। তো ওরা ভালই ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ পেয়েছে। অনেকেই এখন টুরিজম বা বনদপ্তরের কাজে আছে। তোকে আজ যে নৌকা পার করিয়ে এনেছে, সেই মোহন এমন একটা গ্রামেরই বাসিন্দা”, পরাগ এদিক ওদিক দেখতে দেখতে বলছিল অভীককে।

 ওরা একটা পাহাড়ি, পাথুরে জায়গায় এসে থামল। গাড়ি থেকে নেমে সৌম্য আর অশোক একদিকে গেল। পরাগ আর একদিকে। অভীকও পরাগের সাথে সাথে চলতে লাগল।  পরাগের কাঁধে একটা ব্যাগ । তাতে ট্র্যাপ ক্যামেরা রাখা। পাহাড়ের জমিতে তরতর করে উঠে গেল ও। অনভ্যস্ত অভীক এদিক ওদিক ধরে বেশ কসরৎ করতে লাগল ওঠার জন্য। পরাগ একটা হাত বাড়িয়ে দিল ওপর থেকে। পরাগ ওর পথপ্রদর্শক, গাইড সব এখানে।  অভীক তো চায় সারাটা জীবন পরাগই হোক ওর গাইড, পথপ্রদর্শক।

“ এই জায়গা গুলোয় ঢোলদের একটা দল থাকে। ওদের আচার ব্যবহার লক্ষ্য করতে এখানে ট্র্যাপ ক্যামেরা বসাব আমরা”, পরাগ হাঁটতে হাঁটতে বলছিল অভীককে। একটা গুহা মত আছে। তার উল্টোদিকে কী একটা বড় গাছের কান্ডে  একটা ক্যামরা বাঁধল ও। পুরো জায়গাটা নির্জন। একটু ভয় ভয় করছিল অভীকের। শুনেছে  জংলী কুকুররা খুব হিংস্র হয়। শিকারকে জ্যান্ত ছিঁড়ে খায়।

ওর মনের কথা বোধহয় পরাগ বুঝতে পেরেছিল। “ ভয় পাস না। জন্তু জানোয়ার কিছু করবে না। ওদের ন্যাচারাল ইনস্টিংক্ট থেকেই ওরা মানুষের থেকে দূরে থাকে। ওদের সিক্সথ সেন্স তো খুব প্রখর। বোঝে ওরা যে আমাদের থেকে খতরনাক আর শয়তান প্রাণী আর কেউ নেই”, অভয় দিল ও।

আরো কিছু জায়গায় ক’টা ক্যামেরা বাঁধল ও। অভীকও সাহায্য করল। খুব ভাল লাগছিল ওর এভাবে ওর ভালোবাসার জনকে সাহায্য করতে পেরে। যেন এটাই ওদের সাজানো সংসার যেখানে পরাগ হল গৃহকর্ত্রী।

ফেরার পথে সূর্যাস্তের সময়ে আকাশটা পশ্চিমে লাল হয়ে এল। বিরাট প্রান্তরে,  গাছগাছালির মাথার উপরে তা যেন  আশীর্বাদের মত ঝরে পড়ছিল বনদেবতার কাজে নিয়োজিত ছেলেমেয়েগুলোর উপরে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যাচ্ছিল ওদের বাসার পথে।



রাতের খাবারের সময় ওরা গোল হয়ে বসেছিল ক্যাম্পের ছোট রান্নাঘরটায় আগুনের চারপাশে। সন্ধে হতেই ঝুপ করে ঠান্ডা নেমে এসেছিল বনের এই গহীনে। দূরে কোথাও টিটি পাখি ডাকছে পালা করে করে। ল্যাপউইং। খাবারের মেনু খুব সিম্পল- ডাল, ভাত, রুটি, একটা সবজি আর স্যালাড।

“এখানে আমাদের খাবার দাবার সব এরকমই। মাছ মাংস তো নেই। তোর খুব অসুবিধা হচ্ছে বুঝতে পারছি। কোন কোনদিন ডিম থাকলে সেটা হয়। আর নয়তো  মাছ মাংস এখানে পাইনা। আর জঙ্গলের মধ্যে না খাওয়াই ভাল”; পরাগ বলল অভীককে।

“ ওরে বাবা। কোন নন ভেজ না খেয়ে এতদিন আছিস কিভাবে! ডিম কি আবার নন ভেজ নাকি! ধন্য কাজ তোদের”, অভীক উত্তেজিত হয়ে বলল একটু্

“ না রে অভ্যাস হয়ে গেছে।  আর এই সৌম্যরাও পুরো ভেজ। এখানে যে স্টাফরা আছে ফরেস্টের তারাও ভেজ। এইসব দিকে মাছ মাংস কমই খায় মানুষ। তাই এখানে জঙ্গলে জীবজন্তু ধরে রাখতে পেরেছে এরা। কারণ শিকার কম হয়েছে এখানে স্থানীয় লোকের হাতে। “

“ বাংগালী বাবু! মছলি ছাড়া তো হবে না”, হাসতে হাসতে বলল অশোক।

চুপচাপ বসে খাচ্ছিল সিরাজ। ও বলল, “দাদা আমরাও মাংস ছাড়া খেতে পারিনা। কিন্তু এই বনে জঙ্গলে ঘুরে কাজ করতে করতে সেই অভাবটা আর বোধ হয় না। আর যত পরিবেশ, বন নিয়ে পড়ছি, ক্লাইমেট চেঞ্জ, বায়োডাইভার্সিটির বিপদ বুঝছি- তত মনে হচ্ছে একটু বেশি নিরামিষে আস্থা রাখলেই ভাল।“

“কেন কেন! খাবারের সাথে এর কী সম্পর্ক! আর নিরামিষ একটা রিলিজিয়াস ট্যাবু। এটাকে অত গ্লোরিফাই করো না”, অভীকের ভিতর জেগে উঠল বিদ্রোহী সত্ত্বা।

“ হা হা দাদা। ওরকম না। রেড মিট খাওয়ার সাথে ক্লাইমেট চেঞ্জের সম্পর্ক খুব বড়। আর গ্রিন হাউস এফেক্ট কেমন তুমি পরে পড়ে নিও। পরাগ বেহেন তোমায় আর্টিকেল শেয়ার করে দেবে। তুমি যে দেশে থাক সেই দেশ তো সবচেয়ে বেশি কালপ্রিট  এইটার জন্য”, হাসতে হাসতে বলল সিরাজ।

“তাই নাকি! আচ্ছা!…যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি! কি বল পরাগ”।

পরাগ  আরো দুটো রুটি অভীকের পাতে দিয়ে বলল-“ মকাইয়ের রুটি। এটা খা। এটা শরীরের জন্য যতটা ভাল, পরিবেশের জন্যেও। কারণ এটা চাষ করতে খুব কম জল নষ্ট হয় ধান. গমের তুলনায়। আমাদের ভারতীয়দের প্রাচীন খাদ্যাভ্যাস। একেই আবার নতুন করে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। শুধু বন বাঁচাও- এই করো- সেই করো বললে তো হবে না। নিজেদেরও ভাবতে হবে কোনটা ভাল , কোনটা মন্দ। তুই শহরে বসে যেটা করছিস সেটার প্রভাব এই অরণ্য আর তার বন্য বাসিন্দাদের উপরেও পড়বে।“

“তুই বিষ দিলে সেটাও খেয়ে নেব আর এ তো মোটা রুটি..” হাসতে হাসতে অভীক বলল।

অন্য কোন মেয়ে হলে হয়ত বলে উঠত-ঢং। পরাগ কম কথার  মেয়ে। শুধু চোখে একটা নীরব হাসি খেলে গেল। সোহাগের।  সেটা অভীক দেখতে পেল।

 খাবার পর সবাই তাড়াতাড়ি বিছানায় চলে গেল। সারাদিন  ওদের খুব খাটা খাটনি, দৌড়াদৌড়ি যায়। শুধু পরাগ আর অভীক একটা কাঠের বেঞ্চে বসেছিল। একটা মহুয়া গাছের তলায়।  সামনে একটা আগুন জ্বলছিল ধিকধিক করে। আঁচটা কমে এসেছিল। চারিদিকে নানারকম পাখির ডাক ভেসে আসছে। রাতচরা পাখি। ক্যাম্পের পিছন দিক থেকে একটা নাইটজার ডেকে যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে কুপ কুপ করে। বাতাসে মিষ্টি একটা গন্ধ। মহুয়ার গন্ধ, আরো না জানি কত সব ফুল, পাতার গন্ধে মিশে।  আবার অভীকের মনে হচ্ছে এই গন্ধটাও পরাগেরই।  ও আস্তে করে পরাগের হাতটা ছুঁল। কথা না বলেও বলতে চাইল-কবে তুই আমার হবি পুরোপুরি?

 ওর ইচ্ছা ছিল ওর মোবাইলে ওর সিয়াটলের বাংলোর, ও যে পাড়াটায় থাকে সেখানকার ছবি, ওর গাড়ি, কলিগদের ছবি সব দেখাবে পরাগকে। কিন্তু এখানে বসে সে ইচ্ছাটা উবে গেল। এই  যে মায়াবী রাতটা, স্বপ্নের মত ওকে ঘিরে আছে, চারপাশের ঘাসবন আর দূরে ঘন গাছের মাথাগুলো শুক্লপক্ষের চাঁদের হালকা আলোয় ভেসে আছে- সেখানে বসে কি আর ওইসব প্রসঙ্গ তোলা যায়!

অভীকের কাঁধে মাথা রেখে পরাগ বলল-“ আমি যদি ইউ এস না যেতে চাই তবে কি তুই আমায় ছেড়ে দিবি? আর আমাদের সম্পর্ক থাকবে না?”

“ এমন কথা বলিস না পরাগ। এমন ছাড়াছাড়ির কথা। এখানে বনের দেবতারা শুনতে পাবে। তোর আমার যে সম্পর্ক এত বছরের আমাদের তো কোনদিন মনে হয়নি কারুর হাত ছেড়ে দেবার কথা। তাই তো আমি ছুটে এলাম এই বনে তোকে দেখব বলে। তোর কথা শুনব বলে। তুই যেমনটা বলবি পরাগ, আমি সেইমত ভেবে দেখব। তুই তো জানিস তোর ভাবনা চিন্তা, মতামতের গুরুত্ব সবসময়েই কতটা ছিল আমার কাছে”।

“ আমি কী বলব বল! তোর এত বড়  কেরিয়ার। এত দিনের পরিশ্রমে, অধ্যবসায়ে তৈরি করেছিস। সেখানে আমার কি কিছু ইন্টারফেয়ার করা উচিৎ। আমি খুব সামান্য মেয়ে। তোর থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি, সেটা সারাজীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে তুই যদি কাল আমায় ছেড়েও যাস ।

আমি যেখানেই থাকি না কেন, মনে মনে তোর সঙ্গে থাকি সবসময়ে। যখন কাজ করতে করতে হঠাৎ বৃষ্টি নামে , চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি কোন গাছতলায়- মনে হয় তুই এখানে সঙ্গে থাকলে কী করতিস, কোন কথা বলতিস। বন থেকে বনে যখন জিপসিতে চলে যাই, পাশটা বড় ফাঁকা লাগে। মনে হয় তুই যদি থাকতিস। মনে আছে আমরা যে সেই ডায়মন্ড হারবার বেড়াতে গেছিলাম তোদের ডিপার্টমেন্টের পিকনিকে আর সেখানে গিয়ে আমার জ্বর এল! ফেরার পথে পুরো ট্রেনে তোর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাতে ঘুমাতে এসেছিলাম।  এখনও কোনদিন ফিল্ডে কাজ করতে করতে শরীর খারাপ হলে, ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়লে সেই  দিনটা ভেসে  আসে মনে । আর ভেবে নিই তোর কাঁধে মাথা রেখে আছি…তুই গুনগুন করে আগের মত গেয়ে শোনাচ্ছিস-

“ আজ আমি ফিরে এসেছি,তোমার পাশে বসেছি

বলো তোমার কথা শুনব আজ, শুনব বলে তাই রাখিনি কাজ…”।

 

অভীক পরাগের মাথাটা বুকে জড়িয়ে চুমুতে চুমুতে   ওর গাল, কপাল, মাথা ভরিয়ে দিল।  বাইরে নাইটজারটার ডাকে ঘাসবনের অন্যদিক থেকে সাড়া দিচ্ছে আর একটা নাইটজার। থেকে থেকে একটা ব্রেন ফিভার পিউ কাহা-পিউ কাহা করে ডেকে ডেকে রাতের বনকে সচকিত করে তুলছে। টুপটাপ করে মহুয়ার ফুল ঝরে পড়ছে ওদের মাথায়,গায়ে, চারপাশে।



 

 সকালে অভীকের ঘুম ভাঙ্গল বেশ বেলা করে। অন্তত জঙ্গলের ক্যাম্পে যত সকালে লোক ওঠে তার তুলনায়। আটটা বেজে গেছে তখন। ও আড়মোড়া ভেঙ্গে বাইরে এসে দাঁড়াল। ক্যাম্পের বেড়ার বাইরে  একজোড়া শিয়াল দম্পতি যাচ্ছিল। ওরা সব সময় জোড়ায় জোড়ায় থাকে। অভীক একবার শুনেছিল পরাগের থেকে, কোন সঙ্গী যদি মারা যায় ওদের মধ্যে বড় কোন জন্তুর হাতে বা অসুখে, যে বেঁচে থাকে বাকি জীবনটা তার বড় কষ্টে, দু:খে কাটে। ভাবতে ওর মনটা বড় ভারী হয়ে এল। ওই শিয়ালদের জন্য। সেইসব মানুষ-মানুষীদের জন্যেও যারা একসাথে বাকি জীবনটা কাটাবে ভেবেও আলাদা হয়ে যায়।

পিছন থেকে কেউ একজন কাঁধে টোকা দিল। ও ফিরে দেখল পরাগ দাঁড়িয়ে আছে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা হাতে। স্নান সেরে নিয়েছে ও। ভেজা চুলগুলো কাঁধে জড়ানো। কচি কলাপাতা রং এর একটা টপ আর সাদা ট্রাউজার পরে আছে। কপালে একটা মাঝারি সাইজের টিপ। সেদিকে তাকিয়ে অভীক একটু ভ্রু কুঁচকাতে ও বলল-“ ব্যাগে ছিল একটা পাতা।  তুই ভালোবাসিস আমি টিপ পরলে। তাই বার করলাম খুঁজে খুঁজে…..”।  কাঁধে চুল এলিয়ে পরাগকে  রান্নাঘরের দিকে চলে যেতে দেখে অভীকের মনে হল- এমন কোন জায়গায় যদি এভাবেই জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যায় ওর এই মনের মানুষকে সঙ্গে করে তবে কিসের প্রয়োজন জীবনের অত বাহুল্যের, বাজার থেকে কিনে আনা সুখের।  একটা সুখের আবেশ জড়িয়ে ধরল ওকে।

 একজন স্টাফ মহুয়া গাছ তলা থেকে একটা ঝুড়িতে মহুয়া কুঁড়াচ্ছে। বিক্রি হবে এগুলো। ফরেস্টের সম্পদ। সারা রাত মহুয়া ঝরে ঝরে গাছতলাটা সাদা হয়ে আছে। মহুয়া এইসব বনদেশের মানুষের জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সম্পদ। পরাগ বোঝাচ্ছিল অভীককে। আবার এর কারণেই বনে বিপদ ঘনিয়ে আসে। মহুয়া কুড়বার সুবিধার জন্য ঝোপ জঙ্গল সাফ করতে গ্রামবাসীরা অনেক জায়গায়  গাছের নীচে আগুন দিয়ে দেয়। আর শুখা মরশুমে সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে বনের চারিদিকে। কখনও মহুয়া কুড়াতে এসে ভালুকের হাতে আক্রান্ত হতে হয়।

 পরাগ আজ সকালে বার হয়নি ফিল্ডে। অভীকের জন্য থেকে গেছে। তবে ওকে নিয়ে বার হবে একটু পরে।   ওরা যাবে অন্য একটা দিকে । সেদিকে একটা জংলী কুকুরের দল আছে খবর পেয়েছে ফরেস্ট গার্ডদের  থেকে। বোধহয় অন্য কোন দিক থেকে এসেছে দলটা ক’দিন হল। সেটাই দেখতে দূরবীন, ক্যামেরা নিয়ে যাবে।

অভীক আজ একটা অ্যাডভেঞ্চারাস কাজ করল। আলু পরোটায় নাস্তা সেরে, একটা শর্টস পরে ও স্নান করতে নেমে গেল পিছনের ঝোরাটায়। উন্মুক্ত প্রকৃতির প্রান্তরে পাথরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া জলে অনাবৃত দেহে স্নান করতে করতে নিজেকে বেশ হি-ম্যান মনে হচ্ছিল। আবার কখনও ভাবছিল ছোটবেলায় আনন্দমেলায় পড়া ঋজুদার গল্পের ঋজুদা ও। সামনে নদীর পারে বসে আছে অনেক আকাঙ্ক্ষার নারী। মুখে মিটিমিটি হাসি।  ফরসা কপালে জ্বলজ্বল করছে লাল টিপ টা। যেন বনদেবীর তৃতীয় নয়ন।

 

“ এই বুনো কুকুরদের পাওয়া যেত একসময় গোটা এশিয়া, ইওরোপ আর উত্তর আমেরিকা মহাদেশ জুড়ে। এখন এশিয়ার কিছু দেশেই টিকে আছে। আর আমাদের ভারতে ওদের সংখ্যা সবথেকে বেশি। তবে বাঘের বা লেপার্ড , হাতির মত প্রাণীদের নিয়ে যত কাজ হয় ততটা এমন সব পশুদের নিয়ে খুব বেশি হয়নি। কিন্তু আমাদের জীববৈচিত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এইসব প্রাণী। তাই আমরা ওদের নিয়ে কাজ করার কথা ভাবলাম”, পরাগ বলতে বলতে যাচ্ছিল। ওরা জিপসিতে করে যাচ্ছে বনের অন্য একটা দিকে। এইদিকটা খুব সবুজ। তার মাঝে মাঝে অনেক কুসুম গাছ। পাতায় লাল রঙ ধরেছে।  আসার আগে ও পরাগের ল্যাপটপে দেখছিল ক্যামেরা ট্র্যাপে ধরা পড়া ওয়াইল্ড ডগদের ছবি, ভিডিও। কেমন ভাবে ওরা দলবদ্ধ হয়ে থাকে। দেখতে অনেকটা শিয়ালের মত, কিন্তু লালচে রঙ। আর ইয়া বড় মোটা ল্যাজ। সেটা আবার কালো রঙের।  এমনকি একটা সম্বর হরিণকে শিকারের ভিডিও ধরা পড়েছে ওদের ক্যামেরায়। জীবন্ত প্রাণীটাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে একটা ঢোলের দল আক্রমণ চালালো। 

 একটা জায়গায় এসে জিপসিটা দাঁড়ালো। “ এইখানে ম্যাডাম ঢোলের দলটাকে দেখা গেছে”, অমিত বলল। ভূপালের ছেলে ও। বনকে খুব ভালোবেসে যে চাকরিতে এসেছিল তা না। একটা চাকরির খুব দরকার ছিল নিম্নবিত্ত পরিবারে। বাবা একটা ছোট মন্দিরের পূজারী। তাতে সংসার টানা যাচ্ছিল না। ঘরে মা,  আরো দুই বোন আছে। তবে বনে বনে ঘুরতে ঘুরতে ও নেশায় পড়ে গেছে। কাল রাতে শুয়ে শুয়ে ও বলছিল অভীককে। “ এখন স্যার শহরে গেলে খুব দমবন্ধ লাগে। মনে হয় কবে আবার জঙ্গলে ফিরে যাব। এটাই আমার ঘর এখন”।



 

পরাগ আর অমিত দুজনেই জিপসিতে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে এদিক ওদিক দেখছে, খুঁজছে। সামনের গাছে একজোড়া রুফাস ট্রি পাই বসে আছে ল্যাজ ঝুলিয়ে। অভীকের কাছে এভাবে বনের গহীনে ঘোরার অভিজ্ঞতা একদম নতুন। অরণ্যে যাওয়া বলতে দুবার উত্তরবঙ্গে বন্ধুদের সাথে আর পরিবারের সাথে ঘোরার অভিজ্ঞতা মাত্র।  এই যে সবুজ সামিয়ানার নীচে বসে আছে  , চোখ দুটো আবেশে বুজে আসছে, পাশে ভালোবাসার নারী – এর থেকে স্বর্গসুখ আর কী হতে পারে! সবুজ একটা টুপি পরে আছে মাথায় পরাগ। তার পাশ দিয়ে জুলফির কাছে বেরিয়ে থাকা ওর চুলগুলো মৃদু হাওয়ায় উড়ছে। অভীক উঠে দাঁড়িয়ে অমিতের অলক্ষ্যে ওর পরাগের সেই উড়তে থাকা চুলে ওর নাকটা ঘষে দিল। চমকে উঠে পরাগ ওর দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় কর যেন একটু বকে দিল। কিন্তু ঠোটের কোনে হাসিটা যেন ছিল প্রশ্রয়ের, ভালোলাগার। বনের দূরে কোথাও একটা কোকিল ডাকছে সঙ্গীর খোঁজে। এই বসন্তে সবাই কাছে পেতে চাইছে তার সঙ্গীকে।

 

সৌম্য আর অশোক দুজনেই কর্ণাটকের খুব বড় দুটি কলেজ থেকে  ইঞ্জিনিয়ারিং করেছে। কিন্তু ছোট থেকেই বন জঙ্গল, বন্যপ্রাণী নিয়ে ওদের দারুণ আগ্রহ ছিল। এমন  একটা ওয়াইল্ডলাইফ  সেমিনারে ওদের আলাপ। তারপর প্রেম। একসাথে কর্পোরেটে চাকরি করতে ঢুকেছে। একসাথে হাঁসফাস করেছে সেই জগতে। তারপরে কাজ ছেড়ে ওয়াইল্ডলাইফ বায়োলজি নিয়ে নতুন করে পড়াশুনা একসাথে। জড়িয়ে পড়া এইসব কাজে। কত অদ্ভুত মানুষের জীবনের গতিপথ হতে পারে ওদের কথা শুনতে শুনতে ভাবছিল অভীক।

“তোমরা ভাগ্যবান যে ভালোবাসার মানুষরা একসাথে এক পথে চলতে পারছ”, অভীক বলল ওদের।

“তা ঠিক। আমরাও সেটা ভাবি মাঝে মাঝে। নাহলে হয়ত শহরের চিরাচরিত গড্ডালিকা প্রবাহে আমাদের জীবটা কেটে যেত।  এই সিদ্ধান্তগুলো নেবার সময় পরিবার বা বন্ধু-বান্ধবদের থেকে কোন সমর্থন তো পাইনি। আশাও করিনি। তবে নিজেরা নিজেদের হাত ধরেছিলাম দু’জনে। আর কর্ণাটকের বিখ্যাত বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ এস আর কারিয়াপ্পা স্যর খুব সাহায্য করেছিলেন আমাদের। “

ক্যাম্পে রান্না করে মালতী আর ওর ভাই দিনেশ। ওদের ঘর ঠিক এইখানেই ছিল। এখানে যে গ্রামটা ছিল সেখান থেকে সরে গিয়ে এখন মারাইতে নদীর ওইপারে  ওদের নতুন বসতি স্থাপন হয়েছে। মালতীদের আর এক ভাই ওয়াইল্ডলাইফ সাফারিতে গাইডের কাজ করে। আর এক দাদা গাড়ির ব্যবসায়। ক্ষতিপূরণের যে টাকা পেয়েছিল সেটা দিয়ে কিনেছে। তাছাড়া  জমিও পেয়েছে চাষাবাদের  জন্য।

“ কিন্তু আমার স্যার মনে এখানেই পড়ে থাকত। ছোট থেকে কত স্মৃতি এই জায়গাটার। এখানকার সব গাছ, সব পাথর কে আমরা চিনি, ওরাও চেনে আমাদের।  এই যে মহুয়া গাছটা এর ডালে আমরা দড়ি বেঁধে দোল খেতাম। এর নীচে হোলিতে হোক বা রামনবমীতে- গান বাজনার আসর বসত। কত পুরুষ ধরে এসব চলেছে। তাই যখন কাজ দেবার কথা বলল ‘ফরেস ডিপাট’ থেকে আমরা বললাম- আমাদের ওখানে ক্যাম্পে কাজ দাও। আমরা সপ্তাহে একদিন নতুন বাড়ি ঘুরে আসি। কিন্তু মনে করি আজও এটাই আমাদের বাড়ি”, মালতী বলছিল।

“তোমাদের রাগ হয় না ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের উপর, তোমাদের সবাইকে এভাবে সরে যেতে হল?”, অভীক জানতে চাইল।

“ না স্যর। রাগ নেই। ওখানে গিয়ে তো আমাদের ভালই হয়েছে। অনেকে অনেক রকম কাজ পেয়েছে। বাচ্চারা স্কুল, কলেজ যাচ্ছে। এখন আর আগের মত চাষ করলে বেশি ফসলটাই হরিণ, শুয়ারে এসে খেয়ে যায় না। দরকার হলে  আমরা তাড়াতাড়ি শহরের হসপিটালে চলে যেতে পারি। আর আমরা তো বনবাসী। বনের জন্তুরা আমাদের ভাইবোন। ওদের জায়গা ছেড়ে দেয়ায় ওদেরও ভালো হয়েছে। কত হরিণ বেড়েছে। তার পিছু পিছু সাতপুরায় গত বছরগুলোয় বাঘও বেড়েছে”।

মালতীর মেখে একটা তৃপ্তির হাসি। দেখে ভালো লাগল অভীকের। এই দেশের সাধারণ মানুষরা কতটা সম্পৃক্ত প্রকৃতির সাথে। ওদের যেটা শহরে বসে বই পড়ে, রিসার্চ করে বুঝতে হয়, সেটা গ্রামবাসী, বনবাসীরা জীবনের সহজ পাঠ থেকেই জানে। আসলে সত্যিই হয়ত মালতীদের বন ছাড়তে হত না , যদি না শহরের মানুষ, দেশের নেতারা নিজেদের লোভে দেশজুড়ে অরণ্য ধ্বংস করে বেড়াতেন। বাঘ, হাতি, বাইসনদের আবাসস্থল কেড়ে নিতেন।  এখন  এই বেঁচে থাকা কিছু অরণ্যকে চোখের মণির মত তাই আগলে রাখতে হচ্ছে। তার কত না নিয়ম, আইন কানুন। মানুষের নিজের খেয়ালে বানানো। ‘সভ্য’ মানুষের।

বিকেলে আবার কালকের জায়গাটায় গেল ওরা। আজ ক্যামেরাগুলো খুলে নিয়ে আসবে দেখতে যে আদৌ কিছু ধরা পড়েছে কিনা তাতে। অভীক আজ আবার পরাগের সাথে পাহাড় টিলার উপরে গেল পিছু পিছু। ও নিজেও আজ হাত লাগাল ক্যামেরা গুলো খোলায়। বরং পরাগ চুপ করে বসেছিল একটা উঁচু পাথরে। সামনে যে বিরাট উপত্যকাটা নীচে দেখা যাচ্ছে সেটার দিকে তাকিয়ে আছে। ক্যামেরাগুলো ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে অভীক পরাগকে ডাকতে গেল। কিন্তু ওকে দেখে   অভীক চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। শেষ বিকেলের গাঢ় সোনালী রোদ পরাগের মুখের একপাশে এসে পড়েছে। খোলা চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। সকালের সেই সবুজ টপটাই পরে আছে পরাগ। দেখে মনে হচ্ছে বনের কল্যাণময়ী দেবী উপর থেকে তাকিয়ে আছেন তার রাজত্বের দিকে। বনের মঙ্গল যার জীবনের সাধনা।  অভীক চুপ করে এগিয়ে এসে ওর পাশে বসল হাঁটুগেড়ে। তাকিয়ে থাকল ওর মুখের পানে। ওর মনে ভালোবাসা আর ভক্তিতে মিলেমিশে গেছে। এই পরাগকে ও নতুন করে দেখছে  এই গভীর বনের মধ্যে। আর  এই বনদেবীকে নিয়ে গিয়ে ও বসাতে চাইছে শহরের আলো ঝলমলে রাজপথে।  এই পরাগকে কি চিনত ও?




পরাগ এতটাই তন্ময় হয়েছিল শেষ বিকালের বনের সৌন্দর্যে, প্রথমে ও খেয়ালই করেনি যে অভীক এসে কখন বসেছে ওর পায়ের কাছে। অভীক যখন ওর কোলে মাথা রাখল আস্তে করে, ও চমকে উঠল। ওর মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। চুলগুলো ঘেঁটে দিতে লাগল।

ফিল্ড থেকে ফেরার পথে ওরা কেউ কোন কথা বলেনি। চুপ করে পিছনের সীটে বসে একে অপরের হাত ধরেছিল। কাল সকাল হলে অভীক চলে যাবে। সেই কথা ভেবে পরাগের চোখদুটো ভিজে। ও অভীকের মনটা অনেকটা পড়তে পারছে। বরাবর পারে। তবু মনে কত সংশয়, ভয় এসে জড়ো হয়,,,,প্রিয়জনকে হারাবার ভয়। বড় ভয়।

তোমার ছায়া ফেলে যাবে পথের ধুলায়—

আমি কুড়িয়ে রাখবো হৃদয়ের পাতা জুড়ে,

চোখের কোণে ঝরে পড়বে

অপরাহ্ণের অলস রোদ্দুর,

যেন তুমি বলে গেলে—

“ফিরে আসবো, একদিন।”

 

সদ্য ভোর কেটে সকাল এসেছে। মারাইতে দেনোয়া নদীর উপর তখনও হালকা কুয়াশা। জিপসিটা থেকে নেমে ভারী পায়ে নদীর ধারে এসে দাঁড়াল অভীক। ওকে বিদায় দিতে এসেছে পরাগ। গালটা ভিজে। চোখের জলে। হাতের পাতা দিয়ে সেটা মুছে দিল অভীক। কাল সৌম্য আর অশোক ওদের ঘরটা ছেড়ে দিয়েছিল পরাগদের জন্য।  ওরা জানে ওদের টানাপড়েনের কথা। বলেছিল- ঘরে বসে তোমরা আজ সব ফাইনাল করে ফেল। তবে মনে রেখ বাঙ্গালী বিয়েতে গিয়ে আমরা মছলি খাব। যেটা যেন ভেস্তে না যায়।

কথা কি বা বলবে ওরা। গহীন বন শব্দ করে শুনিয়ে যাচ্ছে ওদের কত কথা।  অনেক রাত অবধি একে অপরকে শুধু  আদরে ভরিয়ে দিল ওরা। বনের গন্ধ, বনের স্বাদ ওর দুজনেরই শরীরে লেগেছিল।  আদরটাই হয়ে  উঠল  অঙ্গীকার, সমর্পণ।

পরাগের হাতটা ছাড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল অভীক নৌকার দিকে। বোটম্যান দড়িটা খুলে, ইঞ্জিনে স্টার্ট দিয়ে আস্তে করে ছেড়ে দিল মোটরবোট। জল কেটে ওইপারে চলেছে নৌকা। নদীর পারে দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ ফেলে আসা সাতপুরার বন। সেখানে নদীর পারে দাঁড়িয়ে আছে অভীকের দেখা বনদেবী। তার প্রতিষ্ঠা এই দেশের অরণ্যে, ধুলোয়, গন্ধে, পাখির ডাকে, বন্য জন্তুর চকিত চলনে। তাকে কিভাবে শিকড় উপড়ে নিয়ে যাবার পাপ করতে পারে ও। ওকে ফিরে আসতেই হবে তাই এই মাটিতেই। বসন্তের আকাশে, মাথার উপর টিয়ার ঝাঁকের উড়ে যাওয়ায়, জল থেকে উঠে আসা সোঁদা গন্ধে, দূরের পাহাড়ের রেখায় – সর্বত্র ঘরে ফেরার ডাক। ভালোবাসার ডাক।

 




Comments


86060474-00b1-415d-8c11-9c4471c9c5e7.png
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG

Editor: Dr. Sumanta Bhattacharya
Co-editor: Dr. Oishimaya Sen Nag

  • Facebook

follow our facebook page to stay updated

© 2021 by Boney Pahare. All rights reserved.

bottom of page