শারদীয়া মানেই পুজোর গল্প-উপন্যাস বাংলা ভাষায়। তাই এই বছর পুজোয় থাকছে নতুন এই বড় গল্প বনেপাহাড়ের পাতায়। বন -জঙ্গল, পাহাড়ের পটভূমিতেই। অপূর্ব কুমার রায়ের কলমে।
পাহাড়ের বাঁকটা ঘুরে কয়েকটা দোকানপাট যেখানে, সেখানে এসে থেমে গেল দেবযানীর গাড়িটা। ড্রাইভার বলল-" ম্যাডাম, সিংবমের মোড় এসে গেছে।" এখানে ঘন গাছের জঙ্গল দুই দিকে। চা বাগান কোথায়! চারিদিক তাকাতে তাকাতে সুইফট ডিজায়ার থেকে নামল দেবযানী। কাল রাতে ট্রেনে ভাল ঘুম হয়নি। তার ওপর ট্রেন লেট। বেশ ক্লান্ত লাগছে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দুই ঘন্টা রোড জার্নি করে এসে। ড্রাইভার যখন ডিকি থেকে ব্যাগ নামাচ্ছে, একটা সাদা মহিন্দ্রা থরের পুরানো মডেলের গাড়ি এসে দাঁড়াল পাশে। বৃষ্টির জলে ভিজে চকচক করছে গাড়িটার বনেট আর কালো মাথা। গাড়ি থেকে নেমে এল ফর্সা, দোহারা একটি তরুণ। "নমস্কার, আমি রোহিত। রোহিত বসু। সিংবম টি এস্টেটের অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার। ম্যানেজার অগ্নি বিশ্বাস স্যার জরুরি কাজে কাল গুয়াহাটি গেছেন সস্ত্রীক। না হলে উনিই আসতেন আপনাকে রিসিভ করতে। বারবার বলে গেছেন যাতে আপনার কোন অসুবিধা না হয়। উনি তো আপনার মামার খুব বন্ধু শুনেছি।" প্রতিনমস্কার দেবযানী জানানোর আগেই রোহিত ড্রাইভারের পাশের আসনটা দেখিয়ে দেবযানীকে বলল," আপনি এদিকটায় বসে পড়ুন। আমি আপনার লাগেজ গাড়ির পিছনের সীটে দিয়ে দিচ্ছি"। লাগেজ বলতে তো একটা বড় ট্রলি, আর একটা হ্যান্ডব্যাগ। দেবযানী ওর ভাড়া গাড়িকে বিদায় করে রোহিতের গাড়িতে উঠে বসল। "এটা আসলে ম্যানেজার স্যারের গাড়ি। খুব দরকার ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার হয় না। আপনি ডাক্তার মানুষ, তায় স্যারের বন্ধুর ভাগ্নি- তাই অনেকদিন পরে এই গাড়ির স্টিয়ারিং এল হাতে আপনার খাতিরে", বলতে বলতে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল রোহিত ড্রাইভারের আসনে। "তা ওই গাড়িটা কি আপনাদের বাগানে যেত না, যে আপনাকে আসতে হল", এতক্ষণে কিছু বলার ফুরসৎ পেল দেবযানী। "পাগল নাকি! চলুন না দেখবেন কেমন রাস্তা পাহাড়ের মধ্যে। ফোর হুইল ড্রাইভ ছাড়া কোন গাড়ি যাবেই না", স্টার্ট দিয়ে বলল রোহিত। মোড় থেকে একটু এগোতেই আচমকা একটা ছোট রাস্তায় নেমে গেল থরটা। কিছুটা নামার পর দু চোখের সামনে ভেসে উঠল সামনের পাহাড় জুড়ে সবুজ গালিচার মত চা বাগানের বিস্তার। বড় একটা হোর্ডিং এ লেখা- সিংবাম টি এস্টেট কোম্পানি। এই চা বাগানের হাসপাতালে ক'দিনের জন্য বিশেষ কাজ নিয়ে এসেছে দেবযানী। কলকাতার একটি বড় কর্পোরেট হসপিটালের ল্যাবরেটরিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে বায়োকেমিস্ট্রির বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসাবে। এখানে সেই হসপিটালের সাথে চা বাগানের হসপিটালের টাই আপ হয়ে এই হসপিটালের ল্যাবের কাজকর্মের পরিধি বাড়তে চলেছে। সেগুলো দেখতেই পাঠানো হয়েছে ওকে । তার ওপর চা বাগানের ম্যানেজার ওর মামার বন্ধু বেড়িয়ে যাওয়ায় ও আর এই কাজে আসতে দ্বিধা বোধ করেনি। কাজের কাজ হবে, আর এই সুযোগে দার্জিলিং পাহাড়ে ঘুরে আসা হবে। কলকাতায় যা কাজ সামলায় ও তাতে মাথা তুলে এইসব দেখার ফুরসৎ কই! গাড়িটা নামতে নামতে মোড় ঘুরে হটাৎ চড়াইয়ের রাস্তা ধরল। চড়াই মানে বেশ চড়াই। ঘনঘন গিয়ার পাল্টে যেতে হচ্ছে রোহিতকে। কিন্ত যেতে যেতে দৃশ্যপট দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে দেবযানী। পথের একধারে চা বাগান, একধারে সবুজ বন। কখনও দুদিকেই চা বাগান। বর্ষার জলে জলে পান্নার মত জ্বলজ্বল করছে তাদের সবুজ।সেখানে খেলা করে যাচ্ছে সাদা ধোঁয়ার মত মেঘ। এসে যাচ্ছে রাস্তাতেও। দুপাশ খোলা গাড়িত ঢুকে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদেরও। "স্প্লেনডিড!" মুখ থেকে বেরিয়ে এল দেবযানীর। ওর দিকে তাকিয়ে রোহিত হেসে বলল, "এখনই? এটুকু দেখেই? আরো একটু দেখুন, ক'টা দিন থাকুন। তবে তো বিশেষণ দেবেন ম্যাডাম। বিরাট বড় আমাদের এই টি এস্টেট। সেই কত পুরানো। সাহেবদের থেকে বাঙালী মালিকের হাত ঘুরে এখন মাড়োয়ারিদের হাতে। এক এক দিকে কত রূপ যদি সময় থাকে আর মন থাকে ঘুরে দেখবেন"। "কে দেখাবে? আপনি?" "সে যদি উপরওয়ালার হুকুম হয় এই অধমই না হয় দেখাবে। না হলেও লোকের তো অভাব নেই।" পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ঘুরতে ঘুরতে একটা বড় কারখানা মত দেখা গেল। টি ফ্যাকট্রি। আশেপাশে ছড়ানো ছেটানো বসতি। শ্রমিকদের, অন্য কর্মীদের। গাড়িটা এসে দাঁড়াল ম্যানেজার বাংলোর গেটে। "এই হল ম্যানেজার বাংলো। এর গেস্ট হাউসেই আপনি থাকবেন। চলুন আমি দেখিয়ে দিচ্ছি", রোহিত বলল। বাংলো থেকে দুজন লোককে আসতে দেখা গেল। খাকি ঊর্দি পড়া। "রামধীন, ডক্টর মেমসাব আ গ্যায়ে। সামান লেকে উনকে ঘর রাখ আও। অউর লাঞ্চ লাগা দো", রোহিত নির্দেশ দিল একটা লোককে। তারপর ঘুরে দেবলীনাকে বলল, "তাহলে এবার আপনি লাঞ্চ করে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিন। কাল থেকে আপনার কাজে লেগে পড়বেন। ম্যানেজার স্যারের গাড়ির ড্রাইভার প্রবীণ আপনাকে হসপিটালে নিয়ে যাবে। যে কোন দরকারে এই রামধীন আর পিটারকে বলবেন। ওরা সাহায্য করবে।" তারপর একটু ইতঃস্তত করে বলল,"তেমন মনে করলে আমাকেও জানাতে পারেন। আমার নাম্বারটা নিয়ে রাখতে পারেন।" দেবলীনা বলল, "নিশ্চই। এখানে বাঙালী তো আর কাউকে দেখছি না। আপনাকে কিছু অসুবিধায় হয়ত কল করতে পারি। এখানে সব নেটওয়ার্ক লাগে তো? আমার কিন্তু এয়ারটেল আর জিও আছে।" "হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চিন্তে লাগবে। আমার বাংলোটা একটু দূরে। বাগানের অন্যদিকে। ওদিকটায় আবার শুধু জিও কাজ করে।" "অন্যদিকে? ওরে বাবা কত বড় আপনাদের বাগান?" "তা ম্যাডাম। তিনটে ডিভিশান আছে এই বাগানের। তিন জায়গায় তিন জন অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার। আমিই একমাত্র বাঙালী ওদের মধ্যে। তাই ম্যানেজার স্যার আমাকেই বললেন আপনার কথা....যাগগে, অনেক দেরি হয়ে গেল। গাড়িটা তো আছেই। চাইলে বিকেলে এদিক ওদিক ঘুরে আসতে পারেন।" তারপর গ্যারেজে পার্ক করে রাখা একটা কালো মোটর বাইকে বসে স্টার্ট দিয়ে বেড়িয়ে গেল রোহিত। গেস্ট হাউসের ঘর থেকে সোজা তাকালে দূরের ফ্যাকট্রিটার ওপারে পাহাড়ের ঢেউ দেখা যায়। সন্ধে বেলার সাইরেন শুনে ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল দেবলীনা। দেখল নীচের রাস্তা দিয়ে ফিরছে শ্রমিক মেয়েরা। সেই ছোটবেলায় দার্জিলিং বেড়াতে এসে যে দৃশ্য দেখত, অবিকল সেইসব ছবি। ওদের নিজেদের জগতে কাজের ধরন কত পাল্টে গেছে। নতুন নতুন গবেষণা,প্রযুক্তি সব বদলে দিয়েছে। কিন্তু এই চা বাগানগুলো, তাদের মানুষজন, কাজের ধরন যেন ব্রিটিশ যুগেই পড়ে আছে। ওর হঠাৎ রোহিতের কথা মনে পড়ল। কী করছে এখন ও এই সন্ধেবেলার চা বাগানে। এখানে একা থাকে না পরিবার নিয়ে? কেমন ওর বাড়িটা! একবার ভাবল ফোন করে ওকে। তারপর ভাবল, থাক কী দরকার বেশি উৎসাহ দেখিয়ে। আর ও একজন ডাক্তার। কলকাতা শহরের। চট করে সবার সাথে অত আলাপেরই বা কি দরকার! যেটুকু কাজ, সেটুকুই থাক। এরপরে নেট চালিয়ে মোবাইলটায় টুকটাক দেখে নিল সব এদিক ওদিকে আলাপ, বার্তা। এরপর ল্যাপটপটা বার করে দেখে নিল অ্যানালাইজার যে মেশিনগুলো এখানে বসবে তাদের কোম্পানি থেকে কী ই-মেল এল।
সকালে ওর গাড়িটা হসপিটালে আসতে হসপিটালের দু’জন চিকিৎসক এগিয়ে এলেন।একজন প্রবীণ। অনেকদিন আছেন জানা গেল।আর একজন অপেক্ষাকৃত তরুণ, সপ্তাহে দু'দিন শিলিগুড়ি থেকে আসেন।চেস্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।কথাবার্তায় বোঝা গেল তার এখন অনেক দর।চা-বাগান কর্তৃপক্ষ অনেক ধরে বেঁধে তাকে রেখেছে।হসপিটালের ল্যাবে সামান্য কিছু ব্লাড টেস্ট হয় প্যাথলজি সংক্রান্ত। একটা থ্রি-পার্ট মেশিন চলে।কিন্তু কোন প্যাথলজির চিকিৎসক নেই।দুজন টেকনিশিয়ান সব করেন।এবার ল্যাবে বায়োকেমেস্ট্রির টেস্টের জন্য কিছু যন্ত্রপাতি বসবে যাতে শ্রমিক বা কর্মীদের শিলিগুড়ি ছুটতে না হয় কথায় কথায়।এই টেকনিশিয়ানদের সাথে নতুন একজন টেকনিশায়ানকে পাঠাবে দেবলীনাদের হসপিটাল।তিনি জানেন, বোঝেন অনেক বেশি।কাল মেশিন কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারের সাথে তিনিও আসবেন।সব মেশিন এসে গেছে।কোথায় কি রাখা হচ্ছে, কেমন ভাবে সব চলবে এই নিয়ে আলোচনা হল হসপিটালের ডাক্তার, টেকনিশিয়ানদের সাথে।কাল থেকে আসল কাজ শুরু।কথাবার্তা শেষ হতে হতে সকাল গড়িয়ে দুপুর। তারপরে আবার সেই থরে চেপে ফেরার পালা গেস্ট হাউসে।
গাড়িটা একটা রাস্তার বাঁক ঘুরতে ও দেখতে পেল নীচে চা-বাগানেএকজন দূরবীন দিয়ে কী দেখছে!
ড্রাইভার প্রবীণ বলল," রোহিত সাব হ্যা উধার দেখা আপনে?"
আরে তাইতো কাল রাত থেকে কাজের চিন্তায় রোহিতের কথা আর মনেই আসেনি দেবলীনার।সাদা ট্রাউজারের ওপর নীল জ্যাকেট পরে ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে লোকটা।
"পাগল নাকি! ভিজে যাবে তো",বলল ও।
"রোহিত স্যার এই রকমই।পাখি দেখছেন উনি", প্রবীণ বলল।গাড়িটা থামিয়েছে ও, যদিও স্টার্ট বন্ধ করেনি।
"স্যার, ডক্টর মেমসাব আছেন গাড়িতে", প্রবীণ চেঁচাল।
পিছন ফিরে দেখল রোহিত।হাত তুলে থামার ইঙ্গিত করল।তারপর আবার দূরবীনে চোখ রাখল।
এ তো আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেল। ভাবল দেবলীনা। ওর খিদে পেয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বাংলোয় ফিরে লাঞ্চে বসবে। কিন্তু চলে যাওয়াটাও অভদ্রতা হবে। পাঁচ ছ মিনিট পর লাফ দিতে দিতে ফিরলেন তিনি চা বাগানের চড়াই ভেঙ্গে। "ভায়োলেট কুকো। এ দিকটায় তেমন দেখা যায় না। কাজ করে এদিক দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম দূরবীনে একটু চোখ রাখছিলাম। এ গরীবের আবার একটু এইসব পাখিরোগ আছে । এই পাখিটা চোখে পড়ে যেতে নীচে নেমে গেলাম একটু কাছ থেকে ভাল করে দেখব বলে", বলল রোহিত। তারপরেই বলল, "দেখবেন আপনি? এসেছেন যখন দেখে যান একটু এখানে কে কে থাকে। আমাদের মত দু'পেয়েদের তো দেখেই থাকবেন। আসলে এটা কাদের বাড়ি তাদের দেখবেন না?" "ভায়োলেট কুকো, মানে কী...বেগুনি রং এর কোকিল?" দেবলীনা জানতে চাইল। "ওই আর কি! এসে দেখুন না। গাড়ি থেকে নামুন" একটু ইতস্তত করে গাড়ি থেকে নামল ও। নীল একটা জিনস আর সাদা পুলওভার পরে আছে। সেটা না এবার ভিজে যায় এই শেষ বর্ষার ঝিরঝিরানিতে। "আসুন এদিকে", ডাকল রোহিত। "মানে কোথায়!", দেবলীনার গলায় বিস্ময়। "বাগানে নামুন। এই যে সরু পথটা দেখছেন", বলে নিজে নেমে গেল রোহিত। দেবলীনার অস্বস্তিও হচ্ছে, আবার একটা চাপা উত্তেজনাও। ঝোঁকের মধ্যে রাস্তা থেকে নেমে পড়ল চা গাছের মধ্যে বাগানের সুড়িপথে। "দেখে আসুন। দরকারে চা গাছ ধরে ধরে। ওরা খুব মজবুত," রোহিতের নির্দেশ। একটা সময় থামল। চোখ রাখল রোহিতের দূরবীনে। পাখি কতটা কি দেখল কে জানে! কিন্তু বেশ মজা লাগছে। সারাটা বছর হসপিটালের এসি চেম্বারের বাইরে এই ঠান্ডা মেঘ, বৃষ্টি, হাওয়া মাখার অভিজ্ঞতাটা ওকে অভিভূত করে দিল। দেখার পর ফেরার পালা। একদল মেঘ এসে ঝাপসা করে দিয়েছে চারপাশ। উঠতে উঠতে হোঁচট খেল একজায়গায়। সাদা পুলওভারটা পড়ল কাদামাটিতে। "হাত দিন", পিছন থেকে ডাক শুনল দেবলীনা। ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল হাত বাড়িয়ে রয়েছে রোহিত। ওর হাতটা শক্ত করে ধরে উঠে দাঁড়াল। বাকি রাস্তাটা সামনে সামনে চলে হাত ধরে নিয়ে এল রোহিত। "সরি। আপনি বোধহয় একটু রেগেই যাবেন। এভাবে আমার জন্য পড়তে হল আপনাকে," রোহিতের গলায় আর চোখে অনুতাপ। "আরে না না। it is a part of the game। আমার তো দারুণ লাগল। thank you so much। এত সুন্দর একটা পাখি দেখলাম। চা বাগানে ঘুরলাম। ভাগ্যিস সময় মত দেখা হল আপনার সাথে"। "আরে দাঁড়ান দাঁড়ান দাঁড়ান", বলেই রোহিত বসে পড়ল দেবলীনার পায়ের কাছে। আর জিনসের থেকে হাত দিয়ে তুলে আনল দুটো জোঁক। "ও মাই গড। হোয়াট ইস দিজ্", দেবলীনার গলায় আতঙ্ক। "জোঁক ম্যাডাম", উঠে দাঁড়িয়ে বলল রোহিত। "এটা জোঁকেরও দেশ কিন্তু । সাবধানে দেখেশুনে থাকবেন। আমাদের ব্লাড টেস্টের ব্যবস্থা করতে এসে শেষে আপনাকেই ব্লাড দিয়ে যেতে হবে না হলে এখানে"। তারপর হেসে বলল,"ভয় পাবেন না। এসব আমাদের লাইফের রোজকার পার্ট।চলুন এবার জিপে উঠে পড়ুন। দেরি করে দিলাম অনেক"। ফিরতে ফিরতে দেবলীনার মনে কাজের মধ্যে হঠাৎ এই ছোট্ট অ্যাডভেঞ্চারের ধাক্কা ওর মধ্যে যেন অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ বাড়িয়ে দিল। ফিরে এসে স্নান করার সময়, খেতে বসে,একটু গড়িয়ে নেবার সময় বারবার চা বাগান, পাহাড়, পাহাড়ের মাথায় জঙ্গল- এগুলোই মনে আসছিল। মনে আসছিল রোহিতের কথাও। ওর আশেপাশের চেনা ছকে চলা মানুষদের মধ্যে বেমানান। বেশ একটা অন্য রকম পেশায় একটা বাঙালী ছেলে। বিকেলবেলায় একঘেয়ে লাগছিল। ড্রাইভার প্রবীণ কাছেই ছিল। ওর সাথে কথা বলে জানতে পারল রোহিতের বাংলোটা কয়েক কিলোমিটার দূরে। ও নাকি একাই থাকে এখানে। দুর্গাপুরের ছেলে। গত তিন বছর হল এই চাকরিতে এসেছে। দেবলীনা একবার ঘুরে আসতে চাইল রোহিতের বাড়ির দিকে। "চলুন মেমসাব। ওইদিকটা দারুণ। ঝরণা, নদী এসব আছে। আপনার ভাল লাগবে", বলল প্রবীণ। রাস্তায় যেতে যেতে বেশ কয়েকটা ঝরণা পড়ল। শেষ বর্ষার জল উপচে তারা পথের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে। নানা রং এর পোষাক পরে মেয়েরা চা বাগানে কাজ করছে। গাড়িটা এসে থামল এক জায়গায় পথের ধারে। একটা দোতলা বাড়ি সবুজ রং এর। ঠিক বাংলো যেমন হয় তেমন নয়, কিন্তু আশপাশটা কি সুন্দর! আহা দেবলীনা যদি এমন একটা বাড়িতে থাকতে পারত! বাড়ির নীচতলায় অফিসের কাজ হয়। উপরে দুটো ঘর আর ডাইনিং রোহিতের। বাড়ির কুক কাম চৌকিদার বলল, রোহিতবাবু কাজ থেকে ফিরে নদীতে স্নান করতে গেছেন। নীচে নদী। আচ্ছা, এটারই একটা সোঁ সোঁ শব্দ আসছে এখানে এসে থেকে। দেবলীনার পরিচয় পেয়ে ওকে ঘরে বসতে ডাকল কুক। রোহিতের বেশ বড় বড় দুটি ঘর। ঘরে ঢুকতেই একটা তীব্র পুরুষালি ঘামের গন্ধ নাকে এসে লাগল। ডিভানের ওপর পড়ে আছে রোহিতের সেই নীল জ্যাকেট আর সাদা প্যান্ট। এদিক ওদিক চেয়ারে, দড়িতে ছড়ানো ছিটানো ওর জামা কাপড়! কি আগুছালো!! ডিভানে, টেবিলে গাদা খানেক বই ছড়িয়ে। তার মধ্যে বেশিরভাগ জীবজন্তু, পশুপাখির উপর। ঘরের দেওয়ালে বাঘের একটা বড় ছবি। নীচে লেখা sanctuary asia। একদিকে একটা ফ্রেমে রোহিত আর বোধহয় ওর বাবা-মা'র ছবি। মা'কে বেশ সুন্দর দেখতে। সেই মুখের অনেকটা বসানো রোহিতের চেহারায়। রোহিতের অনুপস্থিতিতেই অনেকটা জেনে নিল যেন ওকে দেবলীনা। হঠাৎ চটি পরা পায়ের শব্দে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজায় দেখে রোহিত। খালি, রোমশ, ভেজা গা থেকে জল ঝরছে । মাথার চুলও তথৈবচ। পরনে একটা সাদা হলুদ তোয়ালে। দেবলীনাকে দেখে রোহিতের মুখে যুগপৎ বিস্ময় আর অস্বস্তি। "একি আপনি!" দেবলীনাও যে একটু অস্বস্তিতে পরেনি তা নয়। গোলাপি একটা সালোয়ার আর সেই রং এর একটা কার্ডিগানে ওকে সকালের থেকে পুরো আলাদা লাগছিল। "দাঁড়ান আমি আসছি", এই বলে মুখ নীচু করে ভেতরের ঘরে চলে গেল রোহিত। দরজা বন্ধ করে পোশাক পাল্টাতে। রোহিতের মুখে এক ঝলক খেলে যাওয়া লাজুক ছায়াটা বেশ লাগল দেবলীনার। একটা সবুজ জলপাই জ্যাকেট আর নীল জিনসে বেরিয়ে এল ও। " আপনি যে আসবেন আগে বলবেন তো। এভাবে এই ঘরে কাউকে আনতেও লজ্জা লাগে"। "তা থোড়াই আপনার ঘর দেখতে এসেছি। প্রবীণ বলল আপনার বাড়ির দিকটা নাকি খুব সুন্দর। তাই আপনি না ডাকলেও দেখতে চলে এলাম এই দিকে।তা এসে দেখি ঘরের মালিক নিজেই সেই সৌন্দর্যে ডুব দিতে চলে গেছে"। " হা হা হা। বেশ বললেন বটে।" "তা রোজই কি নদীতে স্নান করেন এমন? আপনি তো রীতিমত অরণ্যদেব মশাই"। "না না রোজ আর নদীতে স্নান হয় কোথায়। আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরে দেখি দিব্যি রোদ উঠেছে। তাই ইচ্ছা হল রংছুতে ডুব দিয়ে আসতে।" " নদীর নাম বুঝি রংছু?" "হ্যাঁ। নদীতে বেশ গা এলিয় শুয়ে থাকি। কানের পাশে কত কথা বলে যায় নদীর জল মাথার ওপরে প্রজাপতিরা উড়ে যায়, পাখিরা ডাকতে ডাকতে ঘরে ফেরে। এমনও হয়েছে ঘুমিয়ে পড়েছি নদীতে শুয়ে।" " বলেন কি! ভাগ্য করে চাকরি পেয়েছেন তো মশাই"।
“তা বলতে পারেন…আমি অন্তত তা মনে করি। এখন বাকি দুনিয়ার লোক, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুরা কেমন বাউন্ডলে ভাবে সেটা তারাই ভাল বলতে পারবে”।
এই বলে ‘ঘর ছাড়া এই পাগলটাকে এমন করে কে গো ডাকে….’ গুনগুন করতে করতে ভেজা তোয়ালেটা বারান্দায় মেলতে গেল রোহিত।
“আপনার কাজ কতদূর?”, জানতে চাইল দেবলীনার কাছে।
“হ্যাঁ, আজ তো সব দেখলাম। কাল মেশিনগুলো এসে যাচ্ছে। আমাদের শিলিগুড়ি ল্যাব থেকে টেকনিশিয়ান রাজীববাবু আসছেন। উনি এখন একমাস সামলাবেন। আপনাদের টেকনিশিয়ানরা শেখা অবধি উনি তো থাকবেন”।
“আর আপনি কতদিন”?
“ আমার তো আরো তিনদিন থাকার কথা। সব গুছিয়ে বসলে, সব ডকুমেন্টেশান কমপ্লিট করে যেতে হবে এর মধ্যে। আমার তারপরে দার্জিলিং যাবার কথা। কলেজের কিছু পুরানো বন্ধুও আসছে। ওদের সাথে কাটিয়ে, ক’টা দিন একটু মজা করে আবার ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। কলকাতা।”
তারপরে রোহিতকে বলল, “আপনার কথা বলুন। কতদিন আছেন এই কাজে? এখানেই থাকবেন বরাবর?”
“ এই রে, বরাবরের কথা কে বলতে পারে। জীবন তো নদীর মতই। এখন যে বাঁকে জল দাঁড়িয়ে আছে সে কি দেখতে পাচ্ছে এরপর কোন ঢালে, কোন উপত্যকায় সে পড়বে।"
“বা: বেশ কবির মত, দার্শনিকের মত বলেন তো আপনি। জায়গার সাথে একদম মানানসই”।
“হা হা হা। তা যা বলেছেন। থাকুন না কদিন এখানে, আপনিও এমন বলতে শুরু করবেন। আমাদের ম্যানেজার সাহেবও এমন। উনি তো আছেনই কত বছর। খুব ভাল কবিতা লেখেন, গান করেন। পরশুদিন তো স্যার ফিরছেন। কথা বলবেন তখন।”
“তা আপনার কথা কিছু বললেন না তো!”
“ আমি সাধারণ চাকুরে মানুষ। আপনাদের মত ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার কি অধ্যাপক, গবেষক তো নই। বলব আর কি…..তবে এখানে এসেছিলাম কাজের মাঝে ফরেস্ট সার্ভিসের জন্য পড়ব বলে। জানেন তো ইঞ্জিনিয়ারিং এও আমি সুযোগ পেয়েছিলাম। এমনকি আমাদের দুর্গাপুর আর ই কলেজেই পেয়ে যেতাম। কিন্তু ছোট থেকেই প্রকৃতি, অরণ্য, বন্যজীব আমায় টানে। সেই কারণে বাড়ির অমতে ,বলতে পারেন বিস্তর অশান্তি সহ্য করে বটানি নিয়ে পড়ি। তা বনবিভাগে যোগ দেবার ইচ্ছা তো ছিলই পি এইচ ডি করার পর। ফরেস্ট সার্ভিসের প্রস্তুতির আগে বেকার বসে থাকব না ভেবেই এখানে কাজে জয়েন করেছিলাম। কিন্তু এই এত বড় পাহাড়, চা বাগান, জঙ্গলের দেশে এসে যেন এখানকার আমেজে মজে গেছি। মনে হয় না এই কাজ ছেড়ে অন্য কোথাও যাই।“
“কিন্তু, আপনার অ্যাম্বিশনস্…”, দেবলীনার গলায় প্রশ্ন।
“হুমম্, অ্যাম্বিশানস্। জানি যুগে যুগে মানুষ এই একটা নেশায় বারবার ভালবাসার ঘর ভেঙ্গেছে। স্থির হয়ে বসতে দেয়নি তাকে সেই ক্ষিদে। বলতে পারেন, তাতেই হয়ত সভ্যতা এগিয়েছে। জানিনা, আমি সেই সভ্যতার অংশ হতে চাই কিনা। নট সিওর এখনও।“
“বাবা, অনেক ভারি ভারি কথা বলে ফেললেন। এখন একটু আপনার রংছু নদীকে দেখান,” দেবলীনা বলল।
“চলুন। তবে নামতে হবে অনেকটা। যদিও পাথরের পথ করা আছে।“
দুদিকে সবুজ গাছ আর চা বাগানের মধ্যে দিয়ে পাথরের একটা পথ নেমে গেছে নদীর দিকে। দূরে নীচে নদীটা দেখা যাচ্ছে। সবুজ জলে সাদা স্রোত বয়ে চলেছে পাথরের মধ্যে দিয়ে নাচতে নাচতে।
নীচে নেমে নদীর পাড়ে একটা বড় পাথরে এসে বসল দেবলীনা।
নদীর ওপাড়ে ঘন জঙ্গল। কোন জনিমনিষ্যি নেই। কিছু বক ওড়াউড়ি করছে এদিক ওদিক। একটা পাথরের উপরে সাদা সাবানের ফেনা পড়ে আছে। অর্থাৎ এখানে রোহিত সাবান মেখেছিল স্নান করার সময়ে। মনে মনে এই উন্মুক্ত প্রকৃতির প্রান্তরে সম্পূর্ণ নগ্ন এক পুরুষকে কেমন লাগে – এমন একটা চিন্তা, দৃশ্যপট মাথায় খেলা করে গেল। কিন্তু তারপরেই ‘ধ্যাৎ’ বলে মাথা থেকে চিন্তাটা জোর করে সরাতে চাইল ও। মনে পড়ে গেল বিবস্বানের মুখ। ন্যাশানাল মেডিকালে ওর সহপাঠি, বন্ধু, প্রেমিক। বোধহয় প্রাক্তন প্রেমিক। এখন কত দূরে কানাডায় রয়েছে ও। কিন্তু আস্তে আস্তে সেই পুরানো টানটা দুর্বল হয়ে আসছে। দেবলীনা স্পষ্টতই গত বছর জানিয়ে দিয়েছিল বিবস্বানকে যে, ও নিজে কিছুতেই দেশ ছেড়ে বিদেশে থিতু হবে না। সে যতই বিদেশি জীবনের আকর্ষণ থাক, বিবস্বান যাই ভাবুক। ও যে নিজেকে বিরাট দেশপ্রেমিক ভাবে তাও নয়, কিন্তু ওর এই চারপাশ, বাবা-মা, ভাই তাদের ছেড়ে এত দূরে গিয়ে আবার নতুন জীবন শুরু করতে ও অপরাগ। তাতে বিবস্বান যদি….
“ এদিকে আসুন!” , রোহিতের ডাকে সম্বিৎ ফিরল।
রোহিত একটূ দূরে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে চোখ রেখেছে ওর বাইনোকুলারে। দেবলীনা উঠে এগিয়ে যেতে ওকে আঙ্গুল তুলে দেখাল নদীর ওই পারে।
“ ওখানে দেখছেন একজোড়া স্কারলেট মিনিভেট। লাল আর হলুদ”।
প্রথমে কিছু বুঝতে পারল না দেবলীনা। তারপরে রোহিতের আঙ্গুলটা বরাবর লক্ষ্য করে দেখল সত্যিই একজোড়া পাখি একটা গাছের ডালে ওঠা নামা করছে, উড়ে এদিক ওদিক বসছে।
“ নিন, আমার বাইনোটা নিয়ে ভাল করে দেখুন,” রোহিত বলল।
নিকনের বাইনোকুলারটায় চোখ দিয়ে দেবলীনা দেখতে পেল দূরের পাখিদের একদম যেন হাতে কাছে। প্রকৃতি যেন নিজের তুলি দিয়ে রঙ ঢেলে সাজিয়েছে পাখি দুটিকে।
“ এরা কি একই পাখি? আলাদা রং যে?”, জানতে চাইল দেবলীনা।
“ হ্যাঁ। একটা ছেলে, একটা মেয়ে। ছেলেটা লাল আর মেয়েটা হলুদ।“
“বা:”, মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেড়িয়ে এল দেবলীনার।
পাখি দেখতে দেখতে আনমনে কখন ওর পা ‘টা পাথর থেকে ফস্কে নীচে পড়ে গেছিল। টাল সামলাত জোরে চেপে ধরল রোহিতের জ্যাকেট। প্রতিবর্ত্ত ক্রিয়ায় রোহিতও চেপে ধরল শক্ত করে দেবলীনার হাত। একটু দূরত্ব রেখেই টেনে আনল ওর দিকে। হাঁফাচ্ছে দেবলীনা। এভাবে রোহিতকে , ওর জ্যাকেটটাকে চেপে ধরায়, পুরো ব্যাপারটায় একটু লজ্জায় ওর কানদুটো গরম হয়ে গেল যেন।
“সরি…”।
“আরে ইটস্ ওকে…,” রোহিত বলল একটু হেসে। “তাও ভাগ্যিস জলে পড়েননি আপনি। নাহলে কাল পত্রপাঠ চাকরি থেকে বিদায় হত আমার।“ বলে হো হো করে হেসে উঠল।
“ আর কি ভাগ্যি, গরীব অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজারের বাইনোটা জলে যায়নি এত সবে।“
তাড়াতাড়ি বাইনোকুলারটা রোহিতের হাতে দিয়ে নিশ্চিন্ত হল ও।
নদীর ওপাড়ে পাখি দুটো আর নেই। এদিকে একজড়ো নারী-পুরুষের দাপাদাপিতে পাখি দম্পতি কি বিরক্ত হয়েই উড়ে গেল!
দূরের পাহাড়ের উপরে নীল আকাশের মেঘে তখন সূর্যাস্তের ছোঁয়া। চারপাশে আলো পড়ে এল। ওরা আস্তে আস্তে উঠে চলল নদীর পাড় হতে।
উঠতে উঠতেই ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা আবার শুরু হল। রোহিত বলল,” এক কাপ চা খেয়ে যান। চা বাগানের অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজারের বাড়ি এসে চা না খেয়েই যাবেন!”
“শুধু চা?”
একটু অপ্রস্তুত হয়ে রোহিত বলল, “ তা আপনাকে খাওয়ানোর মত এখন তো বিশেষ কিছু নেই আর! আর যে ক’দিন আছেন সন্ধের দিকে এলে বার বিকিউ করে খাওয়াতে পারি। ওটা আমি বেশ ভাল করি। আমার কুকও আছে।“
“বা:। বেশ তো…দেখি সময় করতে পারি কিনা।"
চা খেয়ে দেবলীনা যখন আবার গাড়িতে করে রওয়ানা দিল বৃষ্টিটা ধরে এসেছে। তবে চারপাশের মাটি, গাছপালা থেকে ভেজা গন্ধ বার হচ্ছে। গন্ধটা বেশ নেশা ধরানো। শহুরে ধুলোবালি, পোড়া ডিজেলের গন্ধে অভ্যস্ত নাকে যেন একটা ঝাপটা এসে লাগছে প্রকৃতির অনুভূতিমালার। মনটা বেশ খুশি খুশি আবার একসাথে কেমন উদাস হয়ে গেল।
সেদিন রাতে ঘুমটা কেমন বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল দেবলীনার। ঘুমের মধ্যে বারবার কিছু দৃশ্য ফুটে ফুটে উঠছে…রোহিতের কোয়ার্টার, নদীর সবুজ জল,লাল-হলুদ পাখিগুলো…আর রোহিতের সদ্যস্নান সেরে আসা ভেজা শরীর। ভোররাতে ঘুম ভেঙ্গে ও জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকল। কালো আকাশে মেঘ কেটে তারা জ্বল জ্বল করছে। আর দূরের পাহাড়ে মিটমিট করছে কিছু আলো।
পরেরদিনটা কর্মব্যস্ত গমগমে এক সকাল। অনেক সকালে হসপিটালে চলে এসেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার থেকে টেকনিশিয়ান সবাই। ম্যানেজার একটু পরেই এসে পৌঁছাবেন বাগডোগরা। সেখান থেকে সোজা হসপিটালে আসতে আসতে দুপুর। কাজের মধ্যে একটু একটু হাঁই আসছিল দেবলীনার। মনে পড়ছিল বারবার কালকের কথা। তার সাথে চলছিল কাজ বোঝার ও বোঝানোর পালা।
কাজের মাঝে একবার হসপিটাল বাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল টেকনিশিয়ান রাজীববাবুর সাথে কথা বলতে বলতে। হঠাৎ একটি মাঝবয়সী লোক আর একটি মেয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে দেবলীনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেল। চমকে গিয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল ও। “কি করছেন আপনারা! একি…”
“আপনি ম্যাডাম কাল থেকে হসপিটালে কত কি করছেন দেখছি…শুনছি আর রক্ত পরীক্ষা করতে আমাদের শিলিগুড়ি যেতে হবে না। আপনি সব ব্যবস্থা করতে এসেছেন। তাই মা আপনাকে একটু প্রণাম জানাতে এলুম”, লোকটি বলল হাত জোড় করে।
“ আরে সে তো আপনাদের টি এস্টেট সব করছে। আমি তো দেখতে এসেছি এসব…”, দেবলীনা অস্বস্তির সাথে বলল।
“সে যেই করুক ম্যাডাম, আপনি তো সব দেখছেন। আপনারা না থাকলে তো বাড়ি , যন্তর এসব থাকলেও যা, না থাকলেও তা। ওই যে বুড়ো ডাক্তারসাব, আজ কত বছর আমাদের দেখছেন জানেন! এমনকি উনি আমাদের লেবার বস্তিতে অবধি চলে যান কখনও কখনও। কিন্তু বেশিরভাগ পরীক্ষা করতেই এতদিন আমাদের সেই শিলিগুড়ি যেতে হত। এখন শুনছি কত সুবিধা হবে…আপনারা আছেন সেই ভরসাতেই তো আছি।"
শুনে ভাল লাগল দেবলীনার। এখনও তাহলে কোথাও কোথাও ডাক্তার-বদ্যিদের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা, বিশ্বাস বজায় আছে এই লেনদেন সর্বস্ব পৃথিবীতে। অবশ্য তার জন্য হয়ত ডা: চ্যাটার্জীর মত প্রবীণ ডাক্তারদের ভূমিকাও অনেক। প্রায় বৃদ্ধ মানুষটিকে দেখলে দেবলীনার ওর দাদুর কথা মনে পড়ে যায়, যিনি পুরুলিয়ার এক মফ:স্বলের ডাক্তার ছিলেন। কতই বা রোজগার ছিল সেই যুগে, কিন্তু মানুষের ওঁর প্রতি ছিল অগাধ আস্থা। কর্পোরেটের দুনিয়ায় থেকে দেবলীনা অনেক কাল আর এমন চিকিৎসকদের সাক্ষাৎ পায়নি।
লোকটির নাম ফাগুলাল। হসপিটালের স্টোরের গেট-কীপার। সঙ্গে ছিল ওর মেয়ে। টিবিতে খুব ভুগেছে একসময়ে। কিন্তু এখানেই চিকিৎসা করে ভাল হয়ে গেছে। বিহারের লোক ওরা। কিন্তু ফাগুলালের জন্ম-কর্ম সব এই চা-বাগানেই।
দুপুর নাগাদ ম্যানেজার বিশ্বাস এলেন।
“তোমার কথা তো তোমার মামা অমিতেশের থেকে শুনতাম। তোমার ডাক্তারি পড়া, এম ডি করা। তা তুমি যে একদিন কাজে কাজে আমার এখানে এসে হাজির হবে... দেখে খুব ভাল লাগল।"
কাজ শেষ হতে হতে বিকাল গড়িয়ে গেল।
(ক্রমশ)
আরো পড়ুন: প্রথম শিমুল ফুল
আরো পড়ুন: পিউ কাঁহার রাত
コメント