ওড়িশার সাতকোশিয়ার জঙ্গলে একা একা কিসের খোঁজ আঁখি? তীর্থ দাশগুপ্ত'র কলমে।
অর্ধশতক ধরে আমি এক ভাবে এখানে আছি দাঁড়িয়ে । প্রতি বসন্তেই ফুলে ভরিয়ে দি আমি । মাঝে মাঝেই কিছু পর্যটকের পদার্পণ হয় এখানে । তখন তাদেরকে আমার রূপ দেখানোর সুযোগ পাই । কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি কারুর সাথেই সেভাবে ঠিক আত্মীয়তা কখনোই গড়ে ওঠেনি আমার । সামনের সুন্দর দুই কামরা বনবাংলোর কেয়ারটেকার মোহান্তি সেই কবে পম্পাশরের রেঞ্জ অফিস থেকে আমাকে চারা অবস্থায় নিয়ে এসে এখানে লাগিয়েছে । খুব যত্ন করত আমার । তারপর কয়েক বছরেই বড় হয়ে গেলাম আমি । কত শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বসন্তের সাক্ষী থেকেছি। জায়গাটা ভারী সুন্দর আরণ্যক পরিবেশে । আমার সামনেই চমৎকার বনবাংলো । এত বছরে কত পর্যটক এল গেল । সবাই কি আর জঙ্গল কে ভালোবেসে আসে । ওই একটু ফুর্তি হুল্লোড় করতে আসে এখানে । বয়স তো আমার কম হলনা । অনেক মানুষকে তো দেখলাম এত বছরে । মানুষগুলো বোকার মতন ভাবে আমরা কিছু বুঝিনা , দেখতে পাইনা । আসলে ওরা যে বেশিরভাগই নিজেকে নিয়ে মত্ত । পৃথিবীতে আসার পর থেকেই শুধু আরো , আরো চাই বলে ছুটে চলে । এত প্রাণী তো দেখি এই জঙ্গলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে , কিন্তু এই দু পেয়ে জীবের মতন আত্মমগ্ন প্রজাতি আর একটিও দেখিনি প্রায় । কজন জানতে চেষ্টা করে আমাদের । আজ এই চৈত্রের ঝরা পাতার দুপুরে একজনের কথা খুব মনে পরছে । একটি মেয়ে । কতই বা বয়েস হবে । বড়জোর সাতাশ কিংবা আঠাশ । নাম আঁখি । গত শীতে এই বাংলোয়ে যখন চার রাত কাটাতে এসেছিল তখন ফোনে কারুর সাথে কথা বলার সময়ে নাম টা শুনে নি । সুন্দরী , ভারী বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটি । একাই এসেছিল । একা একটি মেয়ে এখানে এর আগে কেউ আসেনি । কথাবার্তায় বুঝেছি মেয়েটির উচ্চশিক্ষা কানাডায় । অনির্বাণ নামে একটি বয়ফ্রেন্ড আছে কানাডাতেই । সেও ওখানে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে গেছে । কিন্তু সম্প্রতি তার সাথে তীব্র মনোমালিন্যের কারণে ছুটিতে দেশে ফিরে শান্তির খোঁজে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে । আমি শুধু দিনরাত দাঁড়িয়ে আঁখির কার্যকলাপ দেখে যাই । দেখা ছাড়া আর করারই বা কি আছে । আলাপ তো আর করতে পারবনা । সেই ক্ষমতা তো আর ঈশ্বর লক্ষ কোটি বছর আগে উদ্ভিদকুল কে পৃথিবীতে আনার সময় থেকেই দেন নি । তবে বদলে দিয়েছেন সূক্ষ্ম অনুভূতি । সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে দৃশ্যমান এই জগতের একটা ছবি মনে মনে আমরা আঁকতে পারি । প্রথম যেদিন ও এই বনবাংলোয়ে আসে খুব অস্থির অবস্থায় দেখেছিলাম । সেইদিন বিকেলেই কাছেই টিকরপাড়ায় যায় আঁখি । পিচ ঢালা রাস্তা জঙ্গলের বুক চিরে সোজা গিয়ে শেষ হয়েছে বিস্তীর্ণ মহানদীর পাড়ে সাতকোশিয়া গর্জের পাশে টিকরপাড়ায় । উল্টোদিকে আছে ঘন পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা কোন্দ আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা কন্ধমাল জেলার বৌধ , দশপাল্লা ইত্যাদি ।
এই পথে জাতীয় অরণ্যের ভীতরে ছোট ছোট গ্রাম । বেশ কিছু কজওয়ে পেরিয়ে , নিঝুম বনপথ অতিক্রম করে এসে পৌঁছতে হয় ।বনবাংলো চত্ত্বর টা স্কুল , হেলথ সেন্টার , থানা , বাজার ইত্যাদি নিয়ে বেশ বড় সদর ও রেঞ্জ । গাড়ী থেকে নেমে এই বনবাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটির যে এক দারুণ ভালো লাগায় মন টা ভরে গিয়েছিল তা ওর অভিব্যক্তি দেখেই বুঝেছি । পেছনে আরেকটা উঁচু ঢিপির উপরে পর্যটকদের জন্য দুই কামরার নতুন ফরেস্ট রেস্ট হাউস । এখানেই দুই রাতের জন্য আঁখির আস্তানা । আরও ভালো যে দুটি কামরাই বুক করা ছিল আঁখির নামে । এই অসামান্য অরণ্য প্রকৃতির নৈঃশব্দ একাই অনুভব করবে বলে । এরকম প্রকৃতি প্রেমিকা সত্যিই তো দেখিনি আগে । প্রকৃতি আর আঁখি একা , স্থানীয় মানুষজন ছাড়া শহুরে জগতের আর কেউ নেই ।
ছোটো সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাংলোয়ে ঢুকেই প্রথমেই মাঝখানে কমন ডাইনিং রুম । দুদিকে দুটি প্রশস্ত ঘর । পেছনে সুন্দর একটি বারান্দা যেখানে বসে বাইরের ঘন জঙ্গল দেখা যায় । সামনে কোনো বারান্দা নেই তবে বাংলোর হাতায় প্লাস্টিকের দুটি চেয়ার পাতা । আমার খালি মনে হয় প্লাস্টিকের চেয়ার না থেকে আরামকেদারা থাকলে বেশ হত । আঁখির মতন অরণ্য-বিলাসীদের পক্ষে আরাম করে প্রকৃতির মৌতাত নিতে সুবিধা হত । হয়তবা ছিল সেই ব্রিটিশ আমলে । আমি তো অন্ততঃ দেখিনি । ব্রিটিশ আমলের এই সব বনবাংলোর হাতায় বসে আরামকেদারায় হেলান দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়ার , ঘড়িতে দম দেওয়া সময় কে থামিয়ে মুহূর্ত কে সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করার মধ্যে যে এক অপার্থিব আনন্দ আছে , সে টা যে মানুষ না পেয়েছেন তিনি বুঝবেন না । আমার তো সেই উপায় নেই । শুধু ভাবি কিছু মানুষ ঈশ্বরের কৃপায় সব পেয়েও এই মুহূর্তে বাঁচার সুখ থেকে কেন বঞ্চিত । নিরন্তর চাহিদার জালে জড়িয়ে তাদের মন যে সর্বদা চঞ্চল ।
বাংলোর সামনে সমতল জমি টা অনেকটা প্রসারিত হয়ে পরে খাড়া নেমে গেছে খানিকটা নীচে । নীচের ধাপে ভারী সুন্দর আরেকটি ইংরেজ আমলের বাংলো । রেঞ্জ অফিসের পাশেই উঁচু ঢিপির উপরে দুই কামরা বিশিষ্ট পুরনো বনবাংলো । ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত । ওটি অবশ্য পর্যটকদের থাকার জন্যে নয় ।উচ্চপদস্থ ফরেস্ট অফিসাররা এলে ওখানে থাকেন । ফরেস্ট অফিসারদের বাংলোর সামনেই গাড়ী পার্কিং করার জায়গা । জমিটা ঢালু হয়েই এরপর নীচে নেমে গিয়ে বড় গেট পেরিয়ে বড় রাস্তায় টিকরপাড়া রোডে মিশেছে । গেটের পাশেই চৌকিদারের কোয়ার্টার । চৌকিদার লক্ষণ মোহান্তি এক অদ্ভুত চরিত্র । সেই আদি মোহান্তি যিনি আমাকে পম্পাশর থেকে এনে বসিয়েছিলেন তার ভাই । প্রায় আশির উপরে বয়স । একেবারে জঙ্গলে বেড়ে ওঠা , প্রায় জঙ্গলেই সারাটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া এই সব সরল মানুষজন , তাদের জীবন , উপলব্ধি , কিংবা দর্শন জানতে কি কোনই ইচ্ছা হয়না আগত মানুষদের ? তবে সেই সুযোগ মিলে যায় আঁখির , ফিরে যাওয়ার আগের দিন রাতে । এবং সেই রাত টা আঁখির জীবনদর্শন অনেকটাই পালটে দেয় । সম্পর্ক নিয়ে উদ্ভূত ওর অস্থিরতা অনেকটাই কমাতে সাহায্য করে ।
বাংলোর কেয়ার টেকার ভীম নারায়ণ দাস ভারী সপ্রতিভ । ভাঙা ভাঙা হিন্দি মেশানো কথায় দুদিন ধরে অনেক গল্প শোনালেন আঁখি কে । চমৎকার খাবারের অয়োজনও করলেন । বাড়ীতে ওনার স্ত্রীর হাতে সেই রান্না ভারী উপাদেয় ।
বাংলোর সামনেটা আমাকে ঘিরে আছে , শাল , সেগুণ , নোনা গাছ । অতটা পথ এসেও ক্লান্তি বিন্দুমাত্র ছিলনা আঁখির । লক্ষ্য করলাম বাংলোর হাতায় চেয়ারে বসে ও সামনে নোনা গাছে একটা কাঠবিড়ালি খেলা করছিল , তা দেখছিল মন দিয়ে ।পাখীর ডাকে মাঝে মাঝেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হচ্ছিল । আমি অবশ্য রোজই অনুভব করি এই ডাক । সুন্দর একটা গন্ধ আসছিল নাকে । জঙ্গলের নিজস্ব আতর । নাক নেই , তাই গন্ধটা নিতে পারবোনা । তবে অনুভব করতে পারি বেশ । দুপুরের রোদ আশেপাশে গাছের উপরে পরেছে , আমার উপরেও । খানিক পরেই কেয়ারটেকার ভীমের ডাকে সম্বিত ফিরল আঁখির। বেলাও হয়েছিল ।দুপুরের খাবার ডাক পরল ।
দ্বিপ্রহরিক আহার শেষে অলস দুপুরের আমেজ নিতে বাইরে চেয়ারে এসে বসে আঁখি । এবারে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে । বোধহয় আমার ডালে ডালে ফুটে থাকা পলাশ ফুলের শোভায় মোহিত হয়ে যায় । বেশ বুঝতে পারি আসতে আসতে মেয়েটির সাথে একটা আত্মিক যোগ তৈরী হচ্ছে আমার । কই এত মানুষ এলো গেলো , এরকম তো কখনও মনে হয়নি ! মেয়েটির মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু আছে । দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয় । আঁখি তখনও বিস্ময়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকে আমার দিকে , মানে এই পলাশ গাছটার দিকে । সন্ধ্যা ঢলে পরে । রাত আসে । নিঃশব্দ পরিবেশে ঝি ঝি পোকার ডাক ভেসে আসে । দূর থেকে ভেসে আসে বার্কিং ডিয়ারের কর্কশ ধ্বনি , রাতচড়া পাখীর ডাক আর জ্যোৎস্নায় স্নান করা দুদিকের ঘন জঙ্গল , নাকে ভেসে আসা মিষ্টি কোনো নাম না জানা বুনো ফুলের গন্ধ সব মিলিয়ে যে এক ঘোর লেগে যাওয়া অনুভূতি হয় ওর ,বেশ বুঝতে পারি ।নিজের মধ্যেও বেশ একটা পরিবর্তন আসে আমার দ্রুত । প্রতিমুহূর্তে আঁখির মনে ভেসে বেড়ানো ভাবনা আমি নিজেও যেন দেখতে পাই চোখের সামনে । এ যেন ভক্ত আর ইষ্টদেবতার মধ্যে অদৃশ্য বন্ধন । ভক্তির অমোঘ আকর্ষণে কি ?
ডিনার সেরে বাংলোর পাশে খড়ের চালের গোল ছাতার নীচে বাঁধানো বেদিতে রাখা চেয়ারে এসে বসল আঁখি । ঘুমে চোখ জুড়িয়ে
এলেও ঘুমোতে যেতে ইচ্ছা করছিলো না ওর ।
জ্যোৎস্নালোকিত এমন স্বর্গীয় আরণ্যক পরিবেশের নেশায় বুঁদ হয়ে গেল ও । জ্যোৎস্নার নরম আলোয়ে ভেসে যাচ্ছিল পুরুনাকোটের চরাচর । মাঝে মাঝে হাতে ধরা টর্চ বাতি পেছনের জঙ্গলের দিকে ফেললে জ্বল জ্বল করে উঠছিল কয়েকটি সবুজ চোখ । স্পটেড ডিয়ারের একটা দল জ্যোৎস্না রাতে চড়তে ব্যস্ত । এমন চন্দ্রালোকিত রাতে জঙ্গলের মাংসাশী প্রাণীরা বড় একটা বাইরে বেরোয়ে না । ঝিরঝিরে একটা প্রাক বসন্তের হিমেল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে । কাছেই কোথাও একটানা চুঁই চুঁই করে কোনো নাইটজার পাখী ডেকে চলেছে । ইচ্ছা হচ্ছিল সারা রাত ধরে এমন স্বর্গীয় পরিবেশের মৌতাত নি আঁখির সাথে । কিন্তু চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছিল ওর । অগত্যা ঘরে এসে হালকা একটা চাদর গায়ে দিয়ে গভীর ঘুমে ঢলে পরে মেয়েটি ।
পরের দিন ভোরবেলা লক্ষণ মোহান্তি আঁখিকে ডেকে নিয়ে চলল নন্দিনী নালা দেখাতে । বাংলো থেকে বেরিয়ে হেঁটে বড় রাস্তা ধরে পাঁচশো মিটার মতন এসে পাকা রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে জঙ্গলের মেঠো পথ ধরল।
লালমাটির মেঠো পথ ধরে জঙ্গল পথে এগোতে লাগল নন্দিনী নালার দিকে । এত দূরে বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও আমি সব দেখতে পাচ্ছিলাম । জানিনা এরকম অন্য গাছেদেরও হয় নাকি ! আমার পাশের শাল গাছটা , কিংবা নোনা গাছটারও কি এরকম অনুভূতি হচ্ছে মেয়েটি এই বনবাংলোয়ে আসার পর থেকে ? কি জানি ।
সরু পায়ে চলা পথের দুপাশে ঘন জঙ্গল । মূলত শালের জঙ্গল । নীচে ছোট ঝোপ ঝাড় । কিছু জায়গায় ঘন আন্ডারগ্রোথ ।কিছু জায়গায় পাতলা । শুকনো পাতা পরে আছে পথে । মচ মচ শব্দে শুকনো পাতা মারিয়ে নন্দিনী নালার দিকে এগিয়ে চলেছে আঁখি। সকালের সূর্যের তেরছা আলো পরেছে গাছের পাতায় । মাঝে মাঝে আলো ছায়ার খেলা । আরেকটু এগিয়ে হালকা কুলুকুলু শব্দ টা বেশ জোরদার হল । এরপরই দৃশ্যমান হল বড় , ছোট বোল্ডার ও নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নন্দিনী নালার স্রোত । নালা না বলে ছোট নদীই বলা চলে । পাথর পেরিয়ে নালার মাঝে একটা বড় পাথরের উপরে বসল ও বেশ কিছুক্ষণ । কত রকম নানা সুরের নানা গলায় পাখীর গান যে ভেসে আসছিল তা বলার না । একদম নিস্তব্ধ পরিবেশ । শুধু একটানা বয়ে চলা ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দ । নালার ওপারে ঘন জঙ্গল , কয়েক জায়গায় পাতলা হয়ে এসেছে । খালি ওর মনে হচ্ছিল নদীর ওপারে কোনো শ্বাপদ একা বা দলবদ্ধ ভাবে যদি জল খেতে আসে তো বেশ হয় । আরণ্যক পরিবেশ সম্পূর্ণতা পায়।
সকালের সূর্যের আলো ওপারের শাল জঙ্গলের উপরে পরেছে । এদিকটা তখন ও সূর্যের আলো পরেনি । সব মিলিয়ে বেশ আলো আঁধারি পরিবেশ । স্বর্গ যদি কোথাও থেকে থাকে তা বোধহয় এখানেই । কি যে দারুণ লাগছিল জায়গাটা তা বলার না ।দুপুরে নন্দিনী নালায় স্নান করে এই চ্যাটালো পাথরে নগ্ন হয়ে বসে গা শুকোতে বেশ লাগবে নিশ্চয়ই ওর । আমি , এই অঞ্চলের সম্পূর্ণ অনাবিল প্রকৃতি আর সুন্দরী আঁখি , আর কেউ থাকবেনা । আহা । এমন ভক্তের কাছে সম্পূর্ণ সমর্পণ করেও শান্তি ।মনে মনে চাইছিলাম দু চোখ ভোরে এখানকার পুরো অভয়ারণ্যটাই যেন ও ঘুরে নেয় এই কদিনে , তবেই না আমাদের মধ্যে ভালোবাসা আরো গভীরতর হবে । আর ঠিক তাইই হল । বিকেলে ভীমের সাথে গেল বাঘ্বমুন্ডার দিকে ।
পুরুনাকোটের তুলনায় বেশ নির্জন এই জায়গাটা । ভারী ভালো লাগলো ওর বাঘ্বমুন্ডার এই নির্জনতা । ঠিক করল এরপরে কখনও সাতকোশিয়া এলে বাঘ্বমুন্ডাতেই থাকবে । আমার চোখের সামনে থাকবেনা যদিও , কিন্তু অদৃশ্য একটা বন্ধন থাকবেই আমাদের মধ্যে । হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে ও বাঘ্বমুন্ডার পুরনো বনবাংলোর সামনে । বর্তমানে পুরো ভগ্নপ্রায় । সামনে সেই আমলের কুয়ো । বর্তমানে একদম ভঙ্গুর দশা । অনেকটা জায়গা নিয়ে পাঁচিল ঘেরা কম্পাউন্ড । পাশেই একটা নতুন পাকা বাড়ী যেখানে রেঞ্জ অফিস বানানো হয়েছে । সেই পুরনো ভগ্নপ্রায় ইংরেজ আমলের ফরেস্ট বাংলোর পাশে বর্তমান আমলের রেঞ্জ অফিসের বিল্ডিং খুব একটা দৃষ্টিনন্দন লাগল না । ভারতের বেশীরভাগ জায়গাতেই সংস্কারের বড় অভাব । পুরনো বিল্ডিং ভেঙে নতুন বাড়ী গড়ার প্রবণতা । অথচ মানুষ কি ভেবেও দেখেনা পুরানোকে ভেঙে দেওয়ার সাথে সাথে কত শত ইতিহাসকেও ধুলোয়ে মিশিয়ে দেওয়া হয় । গত গল্প , কত না বলা কথা জড়িয়ে থাকে বাড়ীগুলির সাথে । খুব কি কঠিন ছিল বাঘ্বমুন্ডার এই পুরনো ফরেস্ট বাংলো কে সংস্কার করা ? মানুষগুলো সত্যিই জানি কেমন ।
মেঠো পথ আর কয়েক হাত এগোলেই ফরেস্ট চেকপোষ্ট । এরপরই কোর এরিয়া স্টার্ট হচ্ছে । ওই পথই খুব কম দূরত্বে পুরুনাকোট পৌঁছচ্ছে । অনেক আগে অভয়ারণ্য হওয়ার আগে এই সংক্ষিপ্ত পথে বাঘ্বমুণ্ডা আর পুরুনাকোটের যাতায়াত চলত ।
বাঘ্বমুণ্ডা থেকে ফিরতি পথে পুরুনাকোট পৌঁছতে আঁখিদের বিকেল গড়িয়ে গেল । এই কদিনে হালকা ভাললাগা যে অতি গভীর প্রেমে রুপান্তরিত হয়েছে বেশ বুঝতে পারছিলাম । এখানে আসার সময়ে একটা মানসিক দ্বন্দে ভুগছিল ও জানি আমি । আর হবে নাই বা কেন । অনির্বাণ যথার্থই ওর পরিপূরক নয় । আদ্যন্ত হেডোনিস্টিক অনির্বাণের সাথে সংবেদনশীল মনের প্রকৃতিপ্রেমিক আঁখির কোনো দিক থেকেই কোনো মিল নেই । সম্পর্ক পরিণতি লাভ না করায় জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে বেড়ায় আঁখি ।ভ্যাকেশনে দেশে ফিরে এদিক ওদিক অনেক ঘোরে । এখানেও আসা মূলত শান্তির খোঁজে । মনের অস্থিরতা ক্রমশঃ শান্ত হয় প্রকৃতির নরম ছোঁয়ায় । আজই ওর শেষ রাত এই বাংলোয়ে । ঠিক করলাম আমার ডালে ভরে যাওয়া ফুল অনেকটাই ঝরিয়ে ওকে ফেয়ারওয়েল জানাব । করলামও তাই । নীচে মাটিতে পরে থাকা প্রচুর পলাশফুল দেখে শিশুর মতন উচ্ছল আনন্দে মেতে উঠলো ও । দুটো ফুল কুঁড়িয়ে মাথায় গুঁজল । আহা । কি যে সুখ হল তা বলার না । সুখ দুঃখ এসব কি শুধু তোমাদের মানুষদেরই হয় ভাবো ? কখনোই না । আমাদেরও সুখ হয় । দুঃখ আসে ।
চাঁদের আলোয়ে বাংলো চত্ত্বর ভেসে যাচ্ছিল সন্ধ্যেবেলাটায় । বাংলোর পেছনের হাতায় ভীম নলা পোড়ার অয়োজন করল । নলাপড়া উড়িষ্যার পাহাড় জঙ্গলের আদিবাসীদের এক প্রকারের রান্না যেখানে বাঁশের ভেতরে নুন হলুদ মশলা মাখানো মাংস ভরে কাঠের আগুনে অনেকক্ষণ পোড়ান হয় । তারপর 'ফোটাস' করে বাঁশ ফেটে যাওয়ার আওয়াজ হয় । আগুন থেকে সেই ফাটা গরম বাঁশ বার করে ভেতর থেকে উপাদেয় মাংস বার করা হয় । আগুন জ্বালিয়ে গোল হয়ে ঘিরে আঁখি , ভীম , আর লক্ষণ মোহান্তি চেয়ারে বসল । আগুনে নলা পোড়া রান্না হতে লাগল । আকাশে থালার মতন সাদা গোল চাঁদ । আলোয় ভেসে যাচ্ছিল চরাচর । লক্ষণ মোহান্তি গান ধরল কন্ধমালের আদিবাসীদের গান । ভীম গানের মানে তর্জমা করে দিচ্ছিল, যার মূল মানে দাঁড়াল যে অর্থ কখনও প্রকৃত ভালোবাসা কে কিনতে পারে না । আর এই আকাশ বাতাস , গাছ , পাহাড় , হরিণ , পাখি সব একসূত্রে বাঁধা । সবাই তো এক একজন ভক্ত । আর ভক্তই তো ভগবান । তাহলে কিসের এত গোল ?
আঁখির চোখের কোল টা ভেজা মনে হল । আর ঠিক সেই মুহুর্তেই একটা বড় পলাশ ফুল টুপ করে খোসে পড়ল আমার ডাল থেকে ।
Comentários