top of page

টাইগার টাইগার....বার্ণিং ব্রাইট(?): পর্ব ২

  • ..
  • Aug 3
  • 8 min read

২৯ শে জুলাই ছিল বিশ্ব ব্যাঘ্র দিবস। ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে পৃথিবীর ১৩ টি বাঘের আবাসস্থল (tiger range countries) দেশের সম্মতিতে এই দিনটিকে  'বিশ্ব বাঘ দিবস' রূপে ঘোষনা করা হয়। প্রতি বছর  কেন্দ্রীয় সরকারের বন  মন্ত্রক, বিভিন্ন রাজ্যের বন দফতর, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা,সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে আজকের দিনটি মহাসমারোহে পালিত হয়। আর হবে নাই বা কেন ,বিশ্বের সর্বাধিক বাঘের আবাসস্থল (৭০ শতাংশ) যে আমাদের দেশ ভারত। তবে কিভাবে বিপন্নতার মুখে পড়ল আমাদের জাতীয় পশুর অস্তিত্ব আর কিভাবে সেই বিপন্নতার সাথে  আজও চলছে  ডোরাকাটার ফিরে আসার লড়াই তাই নিয়েই গল্প। কলমে অভিষেক চক্রবর্তী। আজ শেষ পর্ব



প্রোজেক্ট টাইগারের পঞ্চাশ বছর পূর্ত্তি উপলক্ষে ভারত সরকার কর্ত্তৃক প্রকাশিত কয়েন
প্রোজেক্ট টাইগারের পঞ্চাশ বছর পূর্ত্তি উপলক্ষে ভারত সরকার কর্ত্তৃক প্রকাশিত কয়েন



পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুভব করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৭১ সালে তিনি গঠন করেন টাইগার টাস্ক ফোর্স। টাইগার টাস্ক ফোর্সের রিপোর্ট প্রকাশিত হলে দেখা যায় সারা দেশে মাত্র ১৮০০ বাঘ জীবিত। বিলুপ্তির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে ভারতের রয়েল বেঙ্গল বাঘ। আর দেরি করেন নি প্রধানমন্ত্রী। তাঁর উদ্যোগে ১৯৭২ সালে রচিত এবং কার্যকর হয় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন ১৯৭২। এই আইন অনুসারে বাঘ শিকার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং আইন ভঙ্গকারীর কারাদণ্ড এবং জরিমানা সহ কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়। বাঘকে এই আইন অনুসারে প্রথম তফসিলভুক্ত করা হয় যার বলে একটি প্রাণী   সর্বাধিক বিপন্ন এবং সর্বোচ্চ সংরক্ষণের অধিকার লাভ করে। এই আইনের ফলে ভারতে বার্ষিক ৪০ মিলিয়ন ডলারের শিকার বাণিজ্যের অবসান ঘটে।এই সময়েই অরণ্য এবং বন্যপ্রাণ সংরক্ষণকে সংবিধানের রাজ্য তালিকা থেকে সরিয়ে যৌথ তালিকায় স্থান দেওয়া হয়। পরের বছর ১৯৭৩ সালের ১ লা এপ্রিল বাঘকে ভারতের জাতীয় পশু রূপে ঘোষণা করা হয় এবং সূচনা হয়  'প্রোজেক্ট টাইগার' এর। প্রাথমিকভাবে ভারতের নয়টি জাতীয়  অরণ্য উদ্যানকে প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এই  প্রকল্পের প্রাণপুরুষ  ছিলেন ভারতের প্রথম টাইগার ম্যান নামে খ্যাত কৈলাশ সাংখালা। তিনিই প্রোজেক্ট টাইগারের প্রথম নির্দেশকরূপে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এখনও পর্যন্ত কার্যকরী এই প্রকল্প বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং সর্বাধিক সময় ধরে চলা বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ প্রকল্প।



 ইন্দিরা গান্ধী ও কৈলাস সাংখালা: ভারতে বাঘ বাঁচাতে যাদের অবদান সবার আগে থাকবে
ইন্দিরা গান্ধী ও কৈলাস সাংখালা: ভারতে বাঘ বাঁচাতে যাদের অবদান সবার আগে থাকবে

বন দফতরের উদ্যোগে ব্যাঘ্র প্রকল্পের ভিতরে অবস্থিত গ্রাম গুলিকে বাইরে পুর্নবাসন দেওয়ার কাজ শুরু হয়। চোরাশিকার রুখতে শুরু হয় কড়া নজরদারি। ধাপে ধাপে আরো অনেক জাতীয় উদ্যানকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ফল মেলে হাতে নাতে। একদিকে বাঘের বাসভূমির সংরক্ষণ ও মানোন্নয়ন অন্যদিকে শিকার নিষিদ্ধ হওয়ায় বাড়তে থাকে বাঘের সংখ্যা। আশির দশকের শুরুতে  ভারতে বাঘের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় চার হাজারে। কিন্তু এই সাফল্য দীর্ঘ স্থায়ী হয়নি।  আশির দশকের শেষ থেকে আবার শুরু হয় চোরাশিকারের  অন্ধকার অধ্যায়। চীন এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে  প্রাচীন চীনা আয়ুর্বেদিক ওষুধ (traditional Chinese Medicine- TCM) শিল্পে বাঘের দেহের বিভিন্ন অংশ যেমন হাড়, নখ, দাঁত, লোম ব্যবহৃত হত। তার জন্য ওই দেশগুলিতে অবাধে চলত বাঘ শিকার। কিন্তু যথেচ্ছ বাঘ শিকারের ফলে বাঘের  দক্ষিণ চীন প্রজাতি (South China tiger) প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়।  ব্যক্তিগত মালিকানার  টাইগার ফার্ম গুলি থেকে বাঘের দেহাংশ যোগান দেওয়া গেলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ট ছিল না। তাছাড়া মনে করা হত, ফার্মে পালিত বাঘের থেকে অরণ্য বাসী বাঘের দেহাবশেষ থেকে তৈরি ওষুধের গুণগত মান উন্নত। তাই এই আয়ুর্বেদিক ওষুধ শিল্পের  কাঁচামালের সব থেকে বড় যোগানদাতা হয়ে ওঠে ভারতীয় উপমহাদেশ। আবার ব্যপকহারে শুরু হয় চোরাশিকার। ব্যাঘ্র প্রকল্প, জাতীয় উদ্যানগুলি  থেকে স্থানীয় অধিবাসীদের পুনর্বাসনের সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের বিশ্বাস অর্জন, মতামতের মত বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় নি। অপরিকল্পিতভাবে উচ্ছেদের ফলে নতুন জায়গায়  অনেকক্ষেত্রে তাঁদের জীবন ধারণের জন্য নূন্যতম ব্যবস্থা যেমন পানীয় জল, উর্বর জমি, চাষবাষের সরঞ্জাম, সেচের ব্যবস্থা ইত্যাদির অভাব ছিল। ফলে  অনেক জায়গাতেই বন দপ্তরের এই  বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ নীতির সঙ্গে স্থানীয় মানুষ একাত্ম হতে পারেন নি। চোরাশিকারিরা অনেক সময় তাঁদের এই ক্ষোভ কে কাজে লাগিয়ে নিজেদের দলে সামিল করে।  আরও দুঃখের বিষয় এই যে কোন কোন সময় বন দপ্তরের একাংশও মোটা অর্থের বিনিময়ে চোরাশিকারিদের সঙ্গে হাত মেলান। বাঘের চোরাশিকার হওয়ার পর তার ছাল চামড়া , অন্যান্য দেহাবশেষ কয়েকবার হাত বদল হয়ে ভারতের উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলির করিডর দিয়ে মায়ানমার হয়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে পাচার হতে থাকে। বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু  গ্রেফতারি, চোরাই মালের উদ্ধার করা সম্ভব হলেও বিভিন্ন রাজ্য জুড়ে এর একাধিক স্তর থাকায় কখনোই পুরো নেটওয়ার্কের নাগাল পাওয়া যেত না। ১৯৯৩ সালে দিল্লি পুলিশের খানা তল্লাশি তে শহরের একটি চোরাশিকারিদের ঘাঁটি থেকে ৮০ টি বাঘের চামড়া ও অন্যান্য দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়,যার মধ্যে অতি বিরল মেলানিস্টিক অথবা কালো বাঘের চামড়া ও ছিল। রাজধানীতে বসে বন দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্তারা অথবা ব্যাঘ্র প্রকল্পের আধিকারিকরা এই চোরাশিকারের বাড় বাড়ন্ত সম্পর্কে মৌনতার নীতি অবলম্বন করতেন। কখনো বা সম্পূর্ণ ভাবে অস্বীকার করতেন। বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যাঘ্র প্রেমী ও সংরক্ষণবিদ গবেষক  ব্যাক্তি বা সংস্থা অরণ্যে দ্রুত হ্রাসমান বাঘের সংখ্যা এবং চোরাশিকার সম্বন্ধে সংবাদমাধ্যম অথবা সরকারের ওপর মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে বন দফতরের রোষানলে পড়েন।  কোথাও তাঁদের গবেষণার অনুমতি বাতিল করা হয়, কোথাও বা তাঁদের অরণ্যে প্রবেশের ক্ষেত্রেই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। উদাহরণস্বরূপ কর্ণাটকের নাগারহোল ব্যাঘ্র প্রকল্পে গবেষণারত ডঃ উল্লাস কারনাথ এবং মধ্য প্রদেশের পান্না ব্যাঘ্র প্রকল্পে ব্যাঘ্র গবেষক রঘু ছুন্দাওয়াত এর কথা উল্লেখ করা যায়। প্রখ্যাত এই দুই জন ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞ সংশ্লিষ্ট অরণ্যে ব্যাপক চোরাশিকার এবং বাঘের বিপন্নতা সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের কারণে বন বিভাগের বিষ নজরে পড়েন। তাঁদের গবেষণার অনুমতি এবং বনে প্রবেশ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়। সেই সময় পাগমার্ক পদ্ধতিতে বাঘের পায়ের ছাপ গণনার সাহায্যে বাঘসুমারি করা হত। এই পদ্ধতিতে একই বাঘকে একাধিক বার গণনা করার মত ভুলের সম্ভাবনা যথেষ্ট বেশি ছিল। এর মধ্যে ২০০৪ সালে জানা যায় রাজস্থানের সরিষ্কা ব্যাঘ্র প্রকল্পে আর একটি বাঘও জীবিত নেই। এই খবর প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ ,বন্যপ্রাণবিদ এবং জনমানসে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয় সরকার। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহর নির্দেশে  পুনরায় তৈরি হয় টাইগার টাস্কফোর্স। মান্ধাতা আমলের পাগমার্ক পদ্ধতির বদলে ক্যামেরা ক্যাপচার রিক্যাপচার পদ্ধতিতে সারা দেশে  বিশেষ বাঘসুমারি করা হয়, ২০০৬ সালে এই বাঘসুমারির ফলাফল প্রকাশিত হলে দেখা যার সারা ভারতে বাঘের সংখ্যা মাত্র ১৪১১। তেত্রিশ বছর ধরে প্রায় চারশ মিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় করার পর প্রোজেক্ট টাইগারের এই শোচনীয়  ফলাফলে দেশজুড়ে  সমালোচনার ঢেউ ওঠে । পরবর্তীতে ২০০৯ সালে  মধ্যপ্রদেশের পান্না ব্যাঘ্র প্রকল্পও বাঘ শূন্য হয়ে যায়। নড়েচড়ে বসে ভারত সরকার, টাইগার টাস্কফোর্সের রিপোর্ট ও পরামর্শ অনুযায়ী ব্যাঘ্র প্রকল্পগুলোকে ঢেলে সাজানো শুরু হয়। প্রতিটি জাতীয়  উদ্যানে  তৈরি করা হয় একাধিক অ্যান্টি পোচিং ক্যাম্প। জঙ্গলের মধ্যে স্থানে স্থানে নজরদারি রাখার জন্য ইনফ্রারেড ক্যামেরা বসানো হয়। ২০০৬ থেকে প্রতি চার বছর অন্তর All India Tiger estimation অথবা  ব্যাঘ্র সুমারির ব্যবস্থা করা হয়। পুরনো পাগমার্ক পদ্ধতির বদলে আধুনিক ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে বাঘ সুমারির সূচনা করা হয়। বর্তমানে বাঘ সুমারির পর M stripe নামক মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন এর মাধ্যমে দেরাদুনে অবস্থিত ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া (WII) এর CaT RAT সফ্টওয়্যারের সেন্ট্রাল সার্ভার ব্যবহার করে বাঘের সংখ্যা নির্ণয় করা হয়।




M STRIPES
M STRIPES

বন্যপ্রাণ সংক্রান্ত অপরাধ দমনের জন্য গঠন করা হয়  ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইম কনট্রোল ব্যুরো ( WCCB) ।এছাড়া টাইগার টাস্কফোর্সের পরামর্শ অনুযায়ী সংরক্ষণ কেন্দ্রিক পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে স্থানীয় অধিবাসীদের মতামত ও প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর সংস্থানের ওপর জোর দেওয়া হয়। ভারতের মত জনবহুল দেশে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ সহাবস্থান ( co existence) ছাড়া সম্ভব নয়। তাই নতুন ব্যাঘ্র সংরক্ষণ নীতিতে স্থানীয় অধিবাসীদের সামিল করার ওপর জোর দেওয়া হয়। প্রোজেক্ট টাইগার কে আরো শক্তিশালী করে তোলার জন্য গঠন করা হয় National Tiger conservation Authority ( NTCA) যা বর্তমানে ভারতের ব্যাঘ্র প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক সংস্থা।  বাঘ সংরক্ষণে  রাজ্যগুলির দায়বদ্ধতা সুনিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি রাজ্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। ব্যাঘ্র প্রকল্প গুলিকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা যুক্ত কোর এবং তুলনামূলক কম নিরাপত্তা যুক্ত বাফার এলাকায় ভাগ করা হয়। বাফার এলাকায় স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ন্ত্রিত উপায়ে বনজ সম্পদ সংগ্রহের অধিকার দেওয়া হয়।সারা দেশ জুড়ে শুরু হয়  'Save The Tiger 'প্রচার।


ree

ব্যাঘ্র প্রকল্পগুলিতে উন্নততর নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সংরক্ষণে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আইনের অনুশাসনের সুফল মিলেছে গত দেড় দশকে।বর্তমানে সারা ভারতে ব্যাঘ্র প্রকল্পের সংখ্যা ৫৮। ২০২২ সালের সর্বশেষ বাঘ সুমারি অনুযায়ী দেশে বাঘের সংখ্যা বর্তমানে ৩৬৮২। বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক হার ৬ শতাংশের বেশি এবং পৃথিবীর ৭০ শতাংশের বেশি বাঘের আবাসস্থল আমাদের দেশ। বিগত দেড় দশকে প্রোজেক্ট টাইগারের এই সাফল্যের খতিয়ান দেখে আপাত স্বস্তি মিললেও কিছু প্রশ্ন এখনও থেকেই যায়।

ভারতের টাইগার রিজার্ভগুলির অবস্থান।  ছবি: NTCA
ভারতের টাইগার রিজার্ভগুলির অবস্থান। ছবি: NTCA

চোরাশিকারের বাড় বাড়ন্ত কমলেও তা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি। অরণ্যের কোর অঞ্চলে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও বাফার অংশে কোথাও কোথাও এখনও  বাঘের চোরাগোপ্তা শিকার করা হচ্ছে। সম্প্রতি মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর জেলায় একটি চোরাশিকারের দলের সন্ধান মিলেছে, মধ্য ভারত থেকে শিকার করা বাঘের চামড়া, হাড় ও অন্যান্য দেহাংশ আসাম মেঘালয়, মিজোরাম রাজ্যের কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় পাচার করা হচ্ছে। উদ্ধার করা হয়েছে চোরাশিকার হওয়া বেশ কয়েকটি বাঘের চামড়া ও হাড়। ভারতে বসবাসকারী  মোট বাঘের ২০ শতাংশ সংরক্ষিত অরণ্যের বাইরে বসবাস করে। এই সকল বাঘের চোরাশিকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি। নিরাপত্তা বলয়ের বাইরে থাকা এই বাঘেদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার যথাযথ পরিকল্পনা বন দফতর করবেন আশা করা যায়। প্রয়োজনে স্থানীয় যুব সমাজকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নির্দিষ্ট সাম্মানিকের বিনিময়ে এদের নজরদারির কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে।

২০২৪ এ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে বন দফতরের ৩০ শতাংশ পদ বর্তমানে শূন্য। ব্যাঘ্র প্রকল্পে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নজরদারির কাজে যে সকল বনকর্মীরা নিযুক্ত, তাঁদের মধ্যে সিংহভাগই বেশ বয়স্ক এবং চুক্তি ভিত্তিক কর্মী। শ্বাপদ সংকুল অরণ্যে নূন্যতম দৈনিক মজুরিতে, বেহাল পরিকাঠামোর মধ্যে তাঁদের কাজ করতে হয়। শূন্য পদগুলিতে নতুন নিয়োগ এবং স্থায়ী চাকরি,পেনশন, জীবন বিমার ব্যবস্থা,সংশ্লিষ্ট পরিকাঠামোর মানোন্নয়ন বন দফতরের কাজের মানকে নিশ্চিত ভাবেই উন্নততর করে তুলবে। অবশ্য এর জন্য বন দফতরের বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং এই দফতরকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রয়োজন যা রাজনৈতিক সদিচ্ছা (political will) ছাড়া সম্ভব নয়।

বাঘ একটি আঞ্চলিক প্রাণী ( territorial) । একটি নির্দিষ্ট এলাকায়  বসবাসকারী একটি পূর্ণবয়স্ক বাঘ সাধারণতঃ সমলিঙ্গের অন্য বাঘকে প্রবেশ করতে দেয় না। বর্তমানে সংরক্ষিত অরণ্য গুলিতে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও অরণ্যের এলাকা নির্দিষ্ট থাকায় বাঘের স্থান সংকুলানের অভাব ঘটছে। এরফলে এলাকা দখলের জন্য পারস্পরিক লড়াইয়ে ( infighting)  বাঘের মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। একই রক্তসম্পর্কীয় ( bloodline) বাঘেদের মধ্যে বারবার মিলনের ফলে inbreeding  depression এর সম্ভাবনা বাড়ছে যার ফলে একটি জনগোষ্ঠীতে জিনগত রোগ এবং বিভিন্ন ধরনের জেনেটিক অস্বাভাবিকতা প্রকাশ পায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায় যা কালক্রমে ওই জনগোষ্ঠীর  বিলুপ্তির কারণ হতে পারে।এছাড়া  অরণ্যে স্থানাভাবে বাঘ আশপাশের  গ্রাম জনবসতি গুলিতে আনাগোনা শুরু করায় বাড়ছে বন্যপ্রাণ মানুষ সংঘাত। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি কিছু মানুষের অথবা বাঘের মৃত্যু। কোন কোন সময় বন দফতরের সংশ্লিষ্ট বাঘটিকে খাঁচা বন্দী করে প্রাণে বাঁচাতে সক্ষম হলেও অকালে শেষ হয়ে যাচ্ছে তার স্বাধীন বন্য জীবন। ঠাঁই মিলছে চিড়িয়াখানা বা পশু চিকিৎসালয়ে। ভারতে বাঘের আবাসস্থলগুলি বেশি র ভাগই বর্তমানে এক একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী (isolated population)। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ এবং উন্নয়নের চাহিদা মেটাতে তৈরী জাতীয়,রাজ্য সড়ক, খনিজ পদার্থের উত্তোলন,বাঁধ ও কৃষি খাল নির্মাণ,কলকারখানার দাপটে  একদা সংরক্ষিত অরণ্য গুলির মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী প্রাকৃতিক করিডোর গুলির অস্তিত্ব আজ বিপন্নপ্রায়। সংরক্ষিত অরণ্যের সীমানা বৃদ্ধি করা সব সময় সম্ভব না হলে সংরক্ষিত অরণ্যের উপকন্ঠে অথবা সীমানাবর্তী   টেরিটোরিয়াল বা সামাজিক বন  এলাকায় বাঘের বসবাসের মত প্রাকৃতিক পরিবেশ (habitat) থাকলে সেগুলির সঙ্গে মূল ব্যাঘ্র প্রকল্পকে করিডোর দ্বারা সংযুক্ত করা যেতে পারে। এই করিডোর গুলিকে সুরক্ষিত রাখতে পারলে মূল জনগোষ্ঠী থেকে উদ্বৃত্ত বাঘ করিডোর ব্যবহার করে সহজেই সংলগ্ন টেরিটোরিয়াল অথবা সামাজিক বনসৃজনের অন্তর্গত অরণ্য গুলিতে যাতায়াত এবং বসতি স্থাপন করতে পারবে।

মধ্য ভারতের আন্ত:সম্পর্কযুক্ত অরণ্যগুলি।  ছবি: গুগল ম্যাপস
মধ্য ভারতের আন্ত:সম্পর্কযুক্ত অরণ্যগুলি। ছবি: গুগল ম্যাপস

কালক্রমে সেখানে মূল জনগোষ্ঠী ( source population) থেকে জিনগতভাবে অনন্য (unique) বিচ্ছিন্ন একটি  উপ জনগোষ্ঠী (metapopulation) গড়ে উঠবে। দুই গোষ্ঠীর মধ্যে যাতায়াত ও মিলনের ফলে জিনগত মিশ্রন ঘটবে (genetic exchange) যা একটি জনগোষ্ঠীর স্থায়ীত্বের জন্য বিশেষভাবে জরুরি।


একই ভাবে কাছাকাছি একাধিক সংরক্ষিত অরণ্যের মধ্যেও এ ধরণের প্রাকৃতিক করিডোর গড়ে তোলা এবং তার যথাযথ সংরক্ষণ করা গেলে  তা কোন একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর (isolated population) এর ক্রমহ্রাসমান বাঘের সংখ্যা পুনরূদ্ধারের সহায়ক হতে পারে। তবে এর জন্য রাজ্য ভিত্তিক পরিকল্পনার বদলে দুই বা ততোধিক রাজ্য একত্রিত হয়ে মিলিত পরিকল্পনা ( combined comprehensive plan) করলে তা বাঘ সংরক্ষণে অধিক সহায়ক ও কার্যকর হতে পারে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের  পরিবর্তে পারস্পরিক সহায়তায় মনোভাবের প্রয়োজন। বাঘ সংরক্ষণে নীতি নির্ধারণের সময় সময় আমলাতন্ত্রের পাশাপাশি ব্যাঘ্র গবেষক, বৈজ্ঞানিক এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তাঁদের গবেষণা ও কাজের অভিজ্ঞতা সংরক্ষণ পরিকল্পনা রচনা ও বাস্তবায়নে বিশেষ সহায়ক হয়ে উঠবে।

ব্যাঘ্র প্রকল্পগুলিতে ইকোট্যুরিজম প্রসারের নামে যথেচ্ছভাবে গজিয়ে উঠছে হোটেল রিসোর্ট। এদের মালিকানা থাকছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বহিরাগত দের হাতে। স্থানীয় অধিবাসীরা অনেকেই জলের দরে তাদের জমি এই হোটেল মালিকদের বিক্রি করে দিয়ে সেই জমিতে গড়ে ওঠা হোটেল রিসোর্টে সামান্য বেতনের চাকরি করছেন। তাই ইকোট্যুরিজমের সুফল স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে কতটুকু পড়ছে তা নিয়ে প্রশ্ন এসেই যায়। এর বদলে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং লোনের ব্যাবস্থা করে তাঁদের বাড়িতে হোমস্টে ট্যুরিজম এর ব্যবস্থা করা গেলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। এছাড়া ইকোট্যুরিজম বাবদ সরকারের আদায়কৃত রাজস্বের একাংশ যাতে যথাযথ ভাবে স্থানীয় বাসিন্দাদের উন্নয়নে ব্যাবহৃত হয় তার জন্য ইকো ডেভেলপমেন্ট কমিটি গুলির সশক্তিকরণ এবং উপযুক্ত নজরদারির প্রয়োজন।

 

বাঘ শুধু ভারতের জাতীয় পশু নয়, বাঘ ভারতের জাতীয় সম্পদ। ভারতে বাঘের অস্তিত্ব মানুষের ওপরে নির্ভরশীল নয়।প্রকৃতির দানে নিজগুণেই সে বাস্তুতন্ত্রের সর্বোচ্চ খাদক এবং ভারতীয় বনের রাজা। মানুষের সচেতনতা, সহাবস্থান এবং আইনের অনুশাসনের পালন, ভারতের অরণ্যভূমিতে রাজার পদচারণাকে আরো দৃপ্ত করবে। কারণ বাঘ শূন্য ভারত আরও দরিদ্রতর ভারত হবে, জিম করবেটের ভাষায়-

 

             " India will be poorer, having lost the finest of her fauna.... "



সপরিবারে।   ছবি: সুমন্ত ভট্টাচার্য্য ।
সপরিবারে। ছবি: সুমন্ত ভট্টাচার্য্য ।

লেখক পেশায় প্রশাসনিক আধিকারিক। প্রাণীবিদ্যার ছাত্র ও বন্যপ্রাণী প্রেমী।


  • প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব।



ree

 


Comments


86060474-00b1-415d-8c11-9c4471c9c5e7.png
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG

Editor: Dr. Sumanta Bhattacharya
Co-editor: Dr. Oishimaya Sen Nag

  • Facebook

follow our facebook page to stay updated

© 2021 by Boney Pahare. All rights reserved.

bottom of page