পাঁচটি বাঘের সপরিবার মৃত্যু এবং....
- ..
- Jul 21
- 5 min read
Updated: Jul 21
সম্প্রতি কর্ণাটকের চামরাজনগর জেলায় মালাই মহাদেশ্বর অভয়ারণ্যে এক বাঘিনী ও তার চার শাবককে বিষ দিয়ে হত্যা করার নির্মম ঘটনায় শিউরে উঠেছিল গোটা দেশের বন্যপ্রাণী নিয়ে সচেতন মহল। ঘটনাটি ভারতের দক্ষিণের এই রাজ্যে বন্যপ্রানী সংরক্ষণে সরকারি স্তরে গাফিলতির যেমন অনেক ইঙ্গিত দেয়, তেমনই আশঙ্কা জাগায় মানুষের মধ্যে হারাতে বসা সহনশীলতা ও মূল্যবোধ নিয়ে। এই নিয়ে আলোচনায় কর্ণাটক তথা ভারতের বিশিষ্ট বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ শ্রী সঞ্জয় গুব্বি।

নীরবতায় হারিয়ে যাওয়া পাঁচটি নিষ্পাপ প্রাণ
দৃশ্যটি যেন শোলের সেই ভয়ংকর মুহূর্তটির স্মৃতি ফিরিয়ে আনল, যখন পুলিশ অফিসার ঠাকুর ছুটিতে বাড়ি ফিরে এসে সেই অবর্ণনীয় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। নিস্তব্ধ এক পরিবেশ, বাতাসে দুলতে থাকা একটি খালি দোলনা, আর গব্বর সিংয়ের হাতে শিশুসহ পরিবারের নির্মম হত্যাকাণ্ড—সব মিলিয়ে যেন সেই কুখ্যাত দৃশ্যেরই পুনরাবৃত্তি।তবে এবার, মানুষের শিশু নয়, নিহত হয়েছিল পাঁচটি বাঘ।
চামরাজনগর জেলার রামপুরা ও কপের মধ্যবর্তী রাস্তাটির মাত্র ৩০ মিটার ভিতরে পড়ে ছিল দুটি বাঘ শাবকের মৃতদেহ—দু'টিই এক বছরেরও কম বয়সী। তাদের উত্তরে পড়েছিল আরেকটি শাবক, পূর্ব দিকে আরও একটি, আর উত্তর-পূর্ব কোণে, এক মা বাঘিনীর নিথর দেহ—যে কিনা অসম্ভব প্রতিকূলতার মধ্যে তার বাচ্চাদের বড় করে তুলছিল। তার মৃতদেহটি পাওয়া যায় একটি বড়, সমতল পাথরের উপর, আর ঠিক দশ মিটার দূরেই ছিল তিনটি ছোট ছোট জলাধার।
আমার অনুমান, মা বাঘিনী হয়তো বিষমিশ্রিত গরুর মাংস খেয়েছিল। ফলে তীব্র জলশূন্যতায় ভুগছিল সে, আর সেই কষ্টে যখন জলাধার থেকে জল খাওয়ার চেষ্টা করছিল, তখনই লুটিয়ে পড়ে এবং মৃত্যুবরণ করে। হয়তো বিষক্রিয়ায় তার হাতে সময়ই ছিল না নিজের ছানাদের শেষবারের মতো আদর করার কিংবা মৃত্যুপথে একটিবার তাকানোরও। আর তার ছানারাও, একে একে অনাথ ও অসহায় অবস্থায়, কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
এটাই আমার দুর্ভাগ্য যে আমি এই বাঘিনীর সঙ্গে পরিচিত ছিলাম তখন থেকেই, যখন সে নিজেও ছিল এক ছোট শাবক। বহুবার সে ধরা দিয়েছে আমাদের ক্যামেরা ট্র্যাপে—তার জীবনযাপন আর বাঘ সংরক্ষণে তার অসাধারণ অবদানের এক নিঃশব্দ জানালা খুলে দিয়েছিল সে আমাদের কাছে। তার সঙ্গে এক আবেগপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমার।
প্রথমবার তাকে আমরা ক্যামেরা ট্র্যাপে ধরতে পারি নভেম্বর ২০১৪-তে, তখন সে ছিল মাত্র ছয় থেকে আট মাসের, সঙ্গে ছিল তার মা ও আরও দুটি ভাইবোন। সেই সময় তারা ছিল মালাই মহাদেশ্বর হিলস ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারির পিজি পাল্য রেঞ্জে।
এরপরের বছরগুলো—২০১৬, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২২—জুড়ে সে নিয়মিত ধরা দিয়েছে আমাদের ক্যামেরায়। মায়ের থেকে আলাদা হওয়ার পর সে নিজের এলাকা গড়ে তোলে ঠিক সেই জন্মভূমির কাছেই। তার মা যেন তাকে আশীর্বাদ করেই সেই জায়গায় স্থায়ী হতে দিয়েছিল। তার মা তাকে সেই জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল।
২০২২ সালে তাকে দেখা গিয়েছিল চারটি প্রায় দুই মাস বয়সী শাবকের সঙ্গে—নিজের বংশধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গৌরবময় ভূমিকাটি যেন সে বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছিল। আর গত মাসে যখন তার মৃতদেহ পাওয়া গেল, তখনও সে সদ্য চারটি শাবকের জন্ম দিয়েছিল।
সাধারণভাবে বাঘের প্রতিবার সন্তানপ্রসবের গড় সংখ্যা প্রায় ২.৪। যদি ধরা যায় সে ২০১৪ সালে ছিল ৬ থেকে ৮ মাস বয়সী, তাহলে মৃত্যুকালে তার আনুমানিক বয়স দাঁড়ায় ১১ থেকে ১২ বছর। বাঘ প্রজননক্ষমতায় পৌঁছায় প্রায় ৩.৫ বছর বয়সে, এবং সাধারণত প্রতি ৩ থেকে ৩.৫ বছরে একবার করে সন্তান প্রসব করে।
এই বাঘিনী অন্তত তিনটি লিটারের জন্ম দিয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। নিশ্চিতভাবে জানা আছে, সে ২০২২ এবং ২০২৫—এই দুই বছরেই চারটি করে শাবকের জন্ম দিয়েছে। ২০১৭ ও ২০১৯ সালে তাকে ক্যামেরা ট্র্যাপে ধরা পড়তে দেখা গিয়েছিল ফুলে ওঠা স্তনগ্রন্থিসহ, যা ইঙ্গিত দেয় যে সে তখনও মা হয়েছিল।
এই তথ্যের ভিত্তিতে ধরে নেওয়া যায়, তার জীবদ্দশায় সে কমপক্ষে ১৫টি শাবকের জন্ম দিয়েছিল—একজন সত্যিকারের যোগ্য এবং স্নেহময়ী মা।
সে নিজের ছানাগুলোকে বড় করে তুলেছিল এমন একটি অঞ্চলে, যেখানে প্রকৃতিতে স্বাভাবিক শিকারের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত— এই চরম প্রতিকূলতার মাঝেও সে লড়ে গেছে আজীবন। যদি সে আর ৩–৪ বছর বেঁচে থাকত, তবে বনে আরও একটি লিটারের জন্ম দিতে পারত। কিন্তু মানবজাতি সেই সম্ভাবনাটিকে নির্মমভাবে শেষ করে দিল।
তার শাবকগুলোর মৃত্যু এই অঞ্চলের বাঘ জনসংখ্যার ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে। চারটি শাবকের মধ্যে তিনটি ছিল মেয়ে। আরও দুই বছরের মধ্যে এই তিন বাঘিনী নিজেদের পরিবার শুরু করত, এবং নিজেদের লিটার দিত। গড় সন্তানসংখ্যা অনুযায়ী, প্রতিটি বাঘিনী জীবদ্দশায় প্রায় ১২ থেকে ১৫টি শাবকের জন্ম দিতে পারত।
অর্থাৎ, সম্ভাব্য ৩৬ থেকে ৪৫টি নতুন বাঘ এই অঞ্চলকে নিজেদের আবাসস্থল হিসেবে বেছে নিতে পারত।
২০১৩ সালের মে মাসে, আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই এই অঞ্চলকে ঘোষণা করা হয়েছিল মালাই মহাদেবেশ্বর বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। কিন্তু মাত্র বারো বছর পর, এই ভয়াবহ ঘটনার অভিঘাতে যেন এক দশকের সংরক্ষণ প্রচেষ্টা পিছিয়ে গেল।
তবে, দোষ দেবো কাকে?
সরকারকে? যারা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দেয় না, সময়মতো পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করে না?
বন দফতরের সেই অফিসারদের, যারা অভয়ারণ্যের মূল অঞ্চলে কদাচিৎ পা রাখেন, এবং বাস্তবিক সংরক্ষণের প্রতি যাদের আন্তরিকতা নেই?
সিনিয়র অফিসার ও সোশ্যাল মিডিয়া-সক্ষম 'সংরক্ষণপন্থী'দের, যারা বন থেকে দূরে, কম্পিউটারের পর্দার আড়ালেই "সংরক্ষণ" নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যান?
সেই আধিকারিকদের, যারা টাকা পেলেও মাটিতে কাজ করা কর্মীদের বেতন দিতে দেরি করেন?
যারা সংরক্ষণ নয়, বরং রাস্তা, চেক ড্যাম আর দালান তৈরি করতেই বেশি আগ্রহী?
যে আধিকারিকরা মর্মান্তিক ঘটনা চোখের সামনে দেখেও কেবল অবজ্ঞাসূচকভাবে বলেন, “যা হবার হয়েছে, এখন আমাদেরটা বাঁচাই”?
নাকি স্থানীয় জনসম্প্রদায়কে, যারা ফসল ও গবাদিপশুর ক্ষতির কারণে বন্যপ্রাণীর প্রতি ক্রুদ্ধ, আর যথাসময়ে বাজারদরে ক্ষতিপূরণ না পেয়ে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে?
তাদের দোষ দেবো, যারা সংরক্ষণের নামে পুরস্কার ও অনুদান নেয়, অথচ সঙ্কটকালে তাদের দেখা মেলে না—সেই এনজিওর নামধারী মাথাদের?
নাকি সেই বন্যপ্রাণী গবেষকদের, যারা প্রতিবছরই নতুন প্রজাতি বা নতুন অঞ্চল নিয়ে গবেষণার দাবি তোলেন, অথচ বাস্তবে যার কোনও প্রভাব নেই?
আর রাজনীতিকদের? যারা বন্যপ্রাণী সপ্তাহ বা পরিবেশ দিবসে জঙ্গলপ্রেম নিয়ে গর্ব করেন, অথচ বিধানসভায় দাঁড়িয়ে সংরক্ষণের প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন?
তাহলে, আমরা প্রশ্ন তুলতেই পারি—এই মৃত্যুতে সত্যিকারের দায়ভার কার? নাকি সবাই মিলে, নীরবে এই হত্যার ভাগীদার?

আমরা কাকে দায়ী করব?
বাস্তব সত্য হলো, ভেঙ্গে পড়া এই ব্যবস্থাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এতে মৃতেরা ফিরে আসে না, বন সুরক্ষিত হয় না। আসল পথ হলো—এই ব্যবস্থার মধ্যেই থেকে বদল আনার জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া।
যদি সরকার যথাযথ অর্থ বরাদ্দ করে, যদি মাটিতে কাজ করা কর্মীরা উৎসাহ নিয়ে কাজ করেন, আর যদি বিভাগের সব স্তরে এমন অফিসার থাকেন, যারা সত্যিই বন্যপ্রাণ ও জনসাধারণ—দুজনেরই কল্যাণ চান, তাহলে এসব বাধা সত্ত্বেও সংরক্ষণ সম্ভব।
সমাধানের সূচনা হয় সাহসী ও দক্ষ ডেপুটি কনজারভেটর অব ফরেস্টস (DCF) নিয়োগের মাধ্যমে। উপর মহল থেকে যদি সামান্য উৎসাহও আসে—যেমন, “তুমি সামলাও, আমরা পাশে আছি”—আর সংরক্ষণে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর সহযোগিতা মেলে, তবে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া যায়।
আজকের বনমন্ত্রী এই জটিলতাটা বোঝেন, প্রকৃতি সংরক্ষণের বিষয়ে আন্তরিক, আর সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে যা বন বিভাগ ও তার লক্ষ্যকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিতে পারে।
রাজনৈতিক সহকর্মীদের ও বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সমর্থন পেলে, এমন মর্মান্তিক ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব— এমনকি বিপরীত পরিস্থিতির মাঝেও।

প্রভু মহাদেশ্বরের বাহন হল বাঘ। আর ঠিক সেই মহাদেশ্বর পাহাড়েই বিষক্রিয়ায় প্রাণ হারাল এক বাঘিনী ও তার শাবকেরা। নেক্রোপসির সময়, দুজন অন্যতম সন্দেহভাজন ব্যক্তি ঘটনাস্থলে এসে নির্লিপ্তভাবে বলে গেল, “কোন গরু ছিল আর বাঘগুলো কীভাবে মরল, তা তো দেবতাই জানেন।”
আমরা যদি ব্যবস্থাপনাগত সমস্যাগুলোর সমাধান করতেও পারি সরকারি স্তরে, তবু প্রশ্ন থেকে যায়—আমাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ কতটা পতিত হলে আমরা ঈশ্বরের নাম জপে, তাঁরই প্রতীকী বাহনকে হত্যা করি? প্রকৃতির প্রতি আমাদের সেই দৈবী শ্রদ্ধাবোধ কি হারিয়ে গেছে?
সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন এখন এই:এই বদলে যাওয়া মানসিকতার ভিতরেও কি আমরা আমাদের পুরাতন সংস্কৃতির নাম করে বন্যপ্রাণীদের রক্ষা করতে পারব?
*মূল প্রবন্ধটি কন্নড়ে প্রকাশিত হয় প্রজাবাণী পত্রিকায় ১৪.০৭.২৫ তারিখে। লেখকের অনুমতিক্রমে কন্নড় থেকে অনুবাদ করে প্রকাশিত হল বনেপাহাড়ে পত্রিকার পাঠকদের জন্য।
লেখক পরিচিতি: লেখক একজন প্রখ্যাত বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ, সংরক্ষণকর্মী ও লেখক। কর্ণাটকে বাঘ ও লেপার্ড সংরক্ষণে তাঁর ভূমিকার কথা সুবিদিত। হোয়াইটলি পুরষ্কারপ্রাপ্ত সঞ্জয় গুব্বি তাঁর গবেষণায় গ্রামীন সমাজের মানুষকে নিয়ে কাজ করেন বন্যপ্রাণী বিশেষত: বাঘ ও লেপার্ডদের সুরক্ষায়।
Comments