top of page

সিমলিপালের কালো বাঘ: আশা ও আকাঙ্খা

..

পর্যটকের ক্যামেরা হোক বা বনদপ্তরের পাতা ট্র্যাপ ক্যামেরা। বারবার সংবাদমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ায় ঘুরে ফিরে আসছে সিমলিপাল অরণ্যের কালো রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ছবি। অভিনব দেখতে এই বাঘকে ঘিরে স্বভাবত: সৃষ্টি হয়েছে চাঞ্চল্য ও আগ্রহ । এবার তাদের নিয়ে বনেপাহাড়ের পাতায় আলোচনায় অভিষেক চক্রবর্ত্তী



এই কাহিনীর শুরু আজ থেকে ত্রিশ বছরেরও আগে এক বর্ষার রাতে। সালটা ১৯৯৩,জুলাই মাস। সারা দেশের মত বর্ষার ঘনঘটা পূর্ব ভারতের ওড়িশা রাজ্যেও।ময়ূরভঞ্জ জেলায় সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত পোড়াগড় গ্রামে তখন রাত নামছে।গ্রামের বাসিন্দা সুরাই বেসরার গোয়ালঘর থেকে হঠাৎই ঝটাপটির শব্দ ভেসে আসে। বৃদ্ধ হলেও মনে যথেষ্ট সাহস ধরতেন সুরাই। একহাতে লাঠি আর অন্য হাতে কুপির আলোটা উঁচিয়ে ধরে গোয়াল ঘরে পৌঁছতেই দেখেন একটি পূর্ণবয়স্ক বাঘিনী সেখানে উপস্থিত। গোয়ালের গরুদের সম্মিলিত কলরব এবং সুরাইয়ের আকস্মিক আগমনে বিরক্ত বাঘিনী হঠাৎই ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর ওপর। কিন্তু বুদ্ধিমান সুরাই হাতের লাঠিটা বাঘিনীর মুখে ঢুকিয়ে দেন এবং অপর হাতের কুপিটি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করতে থাকেন। ইতিমধ্যে বাড়ির অন্য সদস্যরা চলে আসায় এ যাত্রা রণে ভঙ্গ দেয় বাঘিনী। কয়েকটি লাফ দিয়ে মিলিয়ে যায় বাইরের অন্ধকারে। মুখের একপাশে জখম হলেও প্রাণে বেঁচে যান সুরাই বেসরা।ঘটনাটি ভয়াবহ হলেও ভারতের অরণ্য সংলগ্ন এই গ্রাম গুলিতে এ ধরণের মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সংঘর্ষ বিরল কিছু নয়। তাই পরদিন সকালে যথারীতি ভুট্টা ক্ষেতে টহল দিতে গিয়েছিল সুরাইয়ের ছেলে সল্কু বেসরা। কিন্তু ক্ষেতে পৌঁছতেই সে দেখে গতরাতের সেই আহত বাঘিনী সেখানে উপস্থিত। বিপদের গন্ধ পেতেই সে দৌড়ে নিজের বাড়িতে ফিরে আসে, পিছনে ধাওয়া করে আসছিল সেই জখম বাঘিনীও, কিন্তু সল্কু অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় দাওয়ায় টাঙানো তীর ধনুক নিয়ে পর পর তিনটি তীর ছোঁড়ে বাঘিনীর উদ্দেশ্যে। অব্যর্থ নিশানায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বাঘিনী। কিছুক্ষণ ছটফট করার পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে।

খবর পেয়ে ভিড় জমান গ্রামবাসীরা। বনবিভাগের আধিকারিকরাও পৌঁছে যান ঘটনাস্থলে। সকলেই বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেন, সদ্যমৃতা বাঘিনীর পিঠের একটি বড় অংশ সম্পূর্ণ ভাবে কালো, স্বাভাবিক ডোরাকাটা নয়। ভারতের বন্যপ্রাণের ইতিহাসে সেই প্রথম এই ধরনের আংশিক কালো বা সিউডোমেলানিস্টিক বাঘের উপস্থিতির অকাট্য প্রমাণ মেলে। এর আগে বিক্ষিপ্ত ভাবে সিমলিপাল অরণ্যে এই প্রকৃতির বাঘের দেখা মেলার কথা শোনা গিয়েছিল। ১৯৭৫ সালে কয়েকজন বনকর্মী এবং বিদেশী পর্যটকরা দুটি কালো বাঘের দেখা পেয়েছিলেন বলে দাবি করেন, যদিও কোন প্রামাণ্য ছবি পাওয়া যায় নি। ১৯৯২ সালের অক্টোবর মাসে দক্ষিণ দিল্লিতে চোরাচালানকারীদের থেকে পুলিশ একটি এই প্রকারের অর্ধ কালো বাঘের ছাল উদ্ধার করে যা রাজধানীর "ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ্ ন্যাচারাল হিস্ট্রি " তে পরবর্তীতে স্থান পায়। এরপরই পোড়াগড় গ্রামের এই বাঘিনী হত্যার ঘটনার পর আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে এই বিরল প্রকৃতির বাঘের আবাসস্থল ওড়িশার সিমলিপাল জাতীয় উদ্যান।

পরবর্তী তিন দশকে ২৭৫০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই ব্যাঘ্র প্রকল্পে একাধিকবার দেখা মিলেছে এই ছদ্ম কালো বাঘের। কখনো বনকর্মীদের চোখে পড়েছে কখনো বা ব্যাঘ্র সুমারির সময় ট্র্যাপ ক্যামেরায় এদের ছবি ধরা পড়েছে। সারা ভারত ব্যাঘ্র সুমারির (All India Tiger Estimation) ২০২২ এর রিপোর্ট অনুযায়ী সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানে ১৬ টি বাঘের বসবাস যার মধ্যে প্রায় ৬০℅ সিউডোমেলানিস্টিক। ইকোট্যুরিজমের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাকে মাথায় রেখে ২০২৪ এর জানুয়ারিতে ওড়িশার তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক সিমলিপাল অরণ্যে বিশ্বের প্রথম "কালো বাঘে"র সাফারি চালু করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। অতি সম্প্রতি সাফারিরত পর্যটকদের ক্যামেরাতেও বন্দী হয়েছে এই বিরল ধরণের বাঘের ছবি। নেট দুনিয়ায় সেই ছবি "ভাইরাল" হওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই বন্যপ্রাণ প্রেমীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, অনেকেই অরণ্য ভ্রমণের পরবর্তী গন্তব্য হিসেবে সিমলিপাল অরণ্যের কথা ভাবছেন।

কিন্তু কেন সিমলিপালের অরণ্য হয়ে উঠল এই বিরল প্রকারের বাঘের আবাসস্থল, আর কিভাবেই বা চিরাচরিত হলুদ কালো ডোরাকাটা রঙের থেকে আলাদা হয়ে উঠল এই ছদ্ম কালো বাঘ, কেন আশার পাশাপাশি আশঙ্কার ঘনঘটাও থাকছে এই বিশেষ প্রকৃতির বাঘের সংরক্ষণ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে, এবার তারই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক।



প্রথমেই জানিয়ে দেওয়া যাক, এই প্রকৃতির বাঘ কোন আলাদা প্রজাতি বা উপপ্রজাতি নয়। ভারতীয় উপমহাদেশে বাঘের যে উপপ্রজাতি পাওয়া যায় (Panthera tigris tigris) তারই অন্তর্গত। তবে কিভাবে আলাদা হল সিমলিপাল অরণ্যের এই বাঘ?এ বিষয়ে সর্বপ্রথম আলোকপাত করেছিলেন বিশিষ্ট প্রাণীবিজ্ঞানী ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ডঃ এল.এ.কে সিংহ। সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানে দীর্ঘদিন গবেষণার ফসল তিনি তুলে ধরেন ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত "Born Black-The Melanistic Tiger in India" নামক বইটির মাধ্যমে। ডঃ সিংহ এই বইটিতে বাঘের শরীরের রঙ ও তার যাবতীয় সম্ভাব্য বিচ্যুতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে আমরা প্রকৃতিতে সাধারণত যে হলুদ, কালো, সাদা রঙের সমন্বয়ে ডোরাকাটা বাঘ দেখতে পাই তার ১৪ রকম সংমিশ্রণ রূপভেদ ( colour combination) সম্ভব । সাধারণ বাঘের সাদার ওপর হলুদ কালো ডোরা কাটা ছাড়া বাকি সমস্ত সংমিশ্রণ রূপকে তিনি বিচ্যুতি বলে উল্লেখ করেন। সিমলিপালের কালো বা ছদ্ম কালো বাঘও এই প্রকার জেনেটিক বিচ্যুতির ফলাফল। তাঁর মতে বাঘের এই গায়ের রঙের প্রকৃতি নির্ভর করে এক সেট

আগৌটি জিন এবং ডোরাকাটা দাগ নির্ভর করে এক সেট ট্যাবি জিনের ওপর। দেহের কোন অংশের রঙ ও ডোরার নকশার স্বতন্ত্রতা নির্ভর করে এই জিনগুলির প্রকাশের ভিন্নতার ওপর। কোন একটি বাঘের শরীরে এই তিনটি রঙের কোন একটির অনুপস্থিতিকে তিনি জিনগত অবদমন (Genetic suppression) ও এপিস্ট্যাসিসের ফল, এবং কোন একটি রঙের অধিক প্রকাশকে জিনগত নিরোধন বা হাইপোস্ট্যাসিসের ফল বলে দাবি করেন। পাশাপাশি তাঁর মত অনুযায়ী পুনরাবৃত্তিমূলক মিউটেশন নয়, এই ধরনের রঙগত বিচ্যুতি গুলি বহুরূপতার(polymorphism)উদাহরণ কারণ এই বহুরূপতার জন্য দায়ী জিনগুলি বাঘের জিন পুলের মধ্যে আগে থেকেই উপস্থিত। তাদের নিরোধন (হাইপোস্ট্যাসিস )অথবা অবদমনের ( এপিস্ট্যাসিস) কারণে বাঘের শরীরের এই রঙগত তারতম্য সৃষ্টি হয়। এছাড়া সিমলিপালের বাঘের এই রঙগত বিচ্যুতির কারণ হিসেবে ডঃ সিংহ এখানে বাঘের জনসংখ্যার ক্ষুদ্রতা, প্রান্তিকতা ও বিচ্ছিন্নতাকে দায়ী করেন। মূলত এই সকল কারণেই এখানের বাঘেদের মধ্যে ইন ব্রিডিং অর্থাৎ অন্তঃপ্রজননের হার অত্যন্ত বেশি, যার ফলে এই ধরনের জিনগত বিচ্যুতির সম্ভাবনা বাড়ে এবং তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যেহেতু এই ধরনের বিচ্যুতি প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদের বিরোধী, এই প্রকৃতির বিচ্যুত প্রাণীদের দ্রুত অবলুপ্তির আশঙ্কা প্রবল। উদাহরণস্বরূপ তিনি ভারতের অরণ্য থেকে সাদা বাঘের অবলুপ্তির কথা উল্লেখ করেন। ডঃ সিংহ আরো উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এই যে, এই ধরনের রঙগত বিচ্যুত বাঘের অভিযোজনগত মূল্য কম হলেও, যদি ক্রমাগত এই ভাবে অন্তঃপ্রজননের ফলে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে তা বাঘের বিবর্তনের ধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং জাতীয় পশু বাঘ, যা তার হলুদ কালো ডোরাকাটা দেহসৌষ্ঠব নিয়ে এতকাল ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের জনমানসে শৌর্য, বীরত্ব, রাজকীয়তার প্রতীকরূপে বিবেচিত হয়ে এসেছে, এই ধরনের রঙগত বিচ্যুতি তার সেই জনপ্রিয়তায় অবশ্যই প্রভাব বিস্তার করবে। এই বিচ্যুতির নিরসনে ডঃ সিংহ, সিমলিপাল অরণ্যের সঙ্গে সম্ভাব্য নিকটবর্তী বাঘের আবাসস্থল গুলির মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী করিডোর গড়ে তোলা ও তার সংরক্ষণ এর ওপর জোর দিয়েছেন যাতে ইন ব্রিডিং এর সম্ভাবনা কমে, জিনপুলের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায় এবং এই ধরণের অনভিপ্রেত বিচ্যুতিও হ্রাস পায়।


সিমলিপাল অরণ্য
সিমলিপাল অরণ্য

সিমলিপাল অরণ্যের এই বিরল প্রকারের বাঘ নিয়ে ডঃ সিংহের রচিত এই বইটি বন্যপ্রাণ গবেষকদের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত হয়। পরবর্তীতে এই বিষয় নিয়ে গবেষণা কম হয় নি। এই বইটি প্রকাশের প্রায় দুই দশক পরে বাঙ্গালোরে অবস্থিত ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের (NCBS) বিজ্ঞানী ডঃ উমা রামকৃষ্ণন এবং গবেষক বিনয় সাগরের প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র এই বিষয়ে নতুন আলোর দিশা দেখিয়েছে। ২০২১ সালে প্রকাশিত এই গবেষণাপত্র অনুযায়ী সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানের এই ছদ্ম কালো বাঘের রঙগত বিচ্যুতির কারণ একটি জিনগত মিউটেশন বা পরিব্যক্তি।ট্রান্সমেমব্রেন অ্যামাইনোপেপটাইড Q জিন (Taqpep) যার মিউটেশনের কারণে এর পূর্বে অন্য বিড়াল জাতীয় প্রাণীর (চিতা) মধ্যে রঙগত বিচ্যুতির প্রমাণ পাওয়া গেছে, এক্ষেত্রেও এই জিনটির একটি মিউটেশন এই ধরনের বিচ্যুতির জন্য দায়ী। এই গবেষণার জন্য তাঁরা দেশের তিনটি চিড়িয়াখানায় (ভুবনেশ্বর, চেন্নাই এবং রাঁচি)অবস্থানরত ছদ্ম কালো বাঘের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ

করেন। সিমলিপাল অরণ্যে বাঘের মল থেকেও নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তুলনামূলক গবেষণার জন্য মধ্য ও পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন অরণ্যের বাঘের মল থেকেও নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর পর সম্পূর্ণ জিনগত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়,সকল সিউডোমেলানিস্টিক বাঘের ক্ষেত্রেই এই Taqpep জিনের ১৩৬০ তম অধিস্থানে একটি মিউটেশনের ফলে C (সাইটোসিন) এর পরিবর্তে T (টাইরোসিন) অবস্থিত যার ফলে Taqpep প্রোটিনের বিন্যাসেও একটি ত্রুটির সৃষ্টি হয়েছে, এর বিন্যাসের ৪৫৪ নম্বর স্থানে হিস্টিডিনের পরিবর্তে টাইরোসিন সংশ্লেষণ হয়েছে। জিন বিদ্যার পরিভাষায় একে " মিস সেন্স মিউটেশন" বলা হয়। এই ত্রুটিপূর্ণ Taqpep প্রোটিন ত্বকে অতিরিক্ত মেলানিন রঞ্জক সংশ্লেষণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করা হচ্ছে যার ফলে ত্বকের কোন কোন অংশে কালো ডোরাকাটার পরিবর্তে এক বা একাধিক অংশ জুড়ে কালো বড় ছোপের সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে এই ধরনের বাঘকে ছদ্ম (pseudo= ছদ্ম) কালো(melanistic) বাঘ বলা হয়। যদিও এই মিউটেশনের কারণ এবং রঙগত বিচ্যুতির পদ্ধতি নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। ভারতের অন্যান্য প্রান্তের বাঘের জিনগত বিশ্লেষণ করে এই ধরনের কোন মিউটেশনের অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি। এর থেকে প্রমাণিত যে এই ধরনের ছদ্ম কালো বাঘের উৎস একমাত্র সিমলিপাল অরণ্য এবং সিমলিপাল এবং ভারতের বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় বসবাসরত কালো বাঘের পূর্বপুরুষগত সম্পর্ক বিদ্যমান। গবেষকদের মতে সিমলিপাল অরণ্যে বসবাসরত বাঘের মধ্যে এই মিউটেশনের হার ৫৮%। এই জাতীয় উদ্যানের বাঘের মধ্যে এরকম অস্বাভাবিক হারের মিউটেশনের কারণে হয়ত এই ক্যানোপি আচ্ছাদিত অরণ্যে শিকার করার সময় এই গাঢ় কালো রঙ তাদের অভিযোজনগত সুবিধা দেয়। যদিও এর স্বপক্ষে এখনও কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তবে গবেষকদের মতে এই অস্বাভাবিক বেশি মিউটেশন হারের জন্য সম্ভাব্য কারণগুলি হল- অত্যন্ত সীমিত সংখ্যা , বিচ্ছিন্নতা এবং দীর্ঘ সময় ধরে অন্তঃপ্রজনন।

সিমলিপালের সঙ্গে নিকটস্থ অন্য ব্যাঘ্র প্রকল্পের দূরত্ব প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। একটি বাঘ সঙ্গী নির্বাচন, নিজের এলাকা স্থাপনের জন্য গড়ে তার শৈশবের আবাসস্থল থেকে ১৫০ কিমি দূর পর্যন্ত ভ্রমণ করে। ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে অবশ্য এক হাজার কিলোমিটার দূর অবধিও যাওয়ার প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু সিমলিপালের চারপাশে প্রায় ৫০০ কিমি পর্যন্ত বাঘের উপযুক্ত আবাসস্থল না থাকায় এই অরণ্যে বাঘ অতিমাত্রায় অন্তঃপ্রজননে অভ্যস্ত। নিকট রক্তসম্পর্কের মধ্যে বারবার মিলন যে কোন জনগোষ্ঠীর জিনগত স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর ফলে ইনব্রিডিং ডিপ্রেশনের সূচনা হতে পারে যাতে কোন ক্ষতিকর জিনগত ত্রুটি যা সাধারণতঃ কোন জনগোষ্ঠীতে অবদমিত হয়ে থাকে তা পরবর্তী প্রজন্মে প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ পায়। ফলস্বরূপ জন্মগত ত্রুটি, অসুস্থতা, কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ইত্যাদি অনভিপ্রেত ঘটনার সূচনা ঘটতে পারে যা কালক্রমে কোন জনগোষ্ঠীকে অবলুপ্তির পথে নিয়ে যায়। এছাড়া কোন জনগোষ্ঠীতে অত্যন্ত কম জনসংখ্যা অনেক সময় জেনেটিক ড্রিফট নামক অবস্থার সৃষ্টি করে যার ফলে মিউটেশনের হার সেই ক্ষুদ্র জনসংখ্যার মধ্যে অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়।

গবেষকরা মনে করছেন এই সকল কারণেই সিমলিপাল অরণ্যে সিউডোমেলানিস্টিক বাঘের এই আধিক্য। গবেষণা পত্রটি প্রকাশিত হওয়ার পর তাই চিন্তার ভাঁজ পড়েছে দেশের ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞ, কেন্দ্র এবং ওড়িশা বনদপ্তরের কর্তাদের কপালে। সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানের বাঘের জনগোষ্ঠীর জিনগত স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য "Genetic rescue" কর্মসূচীর সূচনা করা হয়েছে। জাতীয় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ সংস্থা (NTCA) এর অনুমোদনের পর সূদুর মহারাষ্ট্রের তাঢ়োবা জাতীয় উদ্যান থেকে দুটি বাঘিনীকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে সিমলিপালের অরণ্যে, যাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জিন পুলের মধ্যে বাইরে থেকে আসা জিনের সংমিশ্রণ ঘটে এবং জিনগত বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায় যা এই জাতীয় মিউটেশনের হার কমাতে সহায়তা করে।

তবে সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানে চোরাশিকারিদের বাড়বাড়ন্ত দুশ্চিন্তার আরও একটি কারণ। মাত্র কয়েক দিন আগেই এবছরের শুরুতে একটি সিউডোমেলানিস্টিক বাঘের চোরাশিকার করা হয়। ঘটনায় জড়িত চারজন দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করা হলেও, অন্য রাজ্য থেকে স্থানান্তরিত বাঘ গুলিও এই অরণ্যে কতটা সুরক্ষিত, সে প্রশ্ন এসেই যায়। অন্য অরণ্য থেকে স্বাভাবিক বিচ্যুতিবিহীন বাঘের স্থানান্তর প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদী ও সময়সাপেক্ষও বটে, এই পদ্ধতির পাশাপাশি সিমলিপাল অরণ্যের অনতিদূরে অবস্থিত কুলডিহা এবং হাদাগড় অভয়ারণ্যকে বাঘের বিকল্প জনগোষ্ঠীর (metapopulation) আবাসস্থল হিসেবে গড়ে তোলা যায় কিনা সে বিষয়েও ভাবনা চিন্তা প্রয়োজন। অতি সম্প্রতি ক্যামেরা ট্র্যাপের মাধ্যমে এই দুটি অভয়ারণ্যেই বাঘের আনাগোনার প্রমাণ মিলেছে। যদিও মনে করা হচ্ছে এগুলি আবাসস্থলের সন্ধানে বেরনো straying বাঘ। কোনটিই ঐ বনাঞ্চলের

স্থায়ী বাসিন্দা নয়। কিন্তু অতীতে আজ থেকে মাত্র দশ বারো বছর আগেও এই দুটি অভয়ারণ্যেই বাঘের

আবাসস্থল ছিল। তাই সিমলিপালের সঙ্গে এই দুটি অভয়ারণ্যের সংযোগকারী করিডোর গুলির সংরক্ষণ এক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। বর্তমানে বাঘ শূন্য সাতকোশিয়া ব্যাঘ্র প্রকল্পেও বাঘের জনগোষ্ঠী পুনরায় স্থাপনে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সিমলিপাল অরণ্যের সঙ্গে প্রাকৃতিক সংযোগরক্ষাকারী করিডোর আছে এই অরণ্যেরও। প্রয়োজনে কুলডিহা-হাদাগড়-সিমলিপাল বৃহত্তর ল্যান্ডস্কেপে বাঘ সংরক্ষণের জন্য যৌথ পরিকল্পনা রচনা করা এবং সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করাও সম্ভব যাতে সংরক্ষণের সুবিধার জন্য উল্লেখিত অভয়ারণ্যগুলিকে ব্যাঘ্র প্রকল্পের আওতায় আনা যায়।


সিমলিপালের প্রবেশদ্বার
সিমলিপালের প্রবেশদ্বার

চোরাশিকার নিরোধে শুধু আইন প্রণয়ন ও টহলদারি যথেষ্ট নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে স্থানীয় জনজাতির মানুষরা এতে জড়িত থাকছেন।পান্না জাতীয় উদ্যানের মডেল অনুযায়ী সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় অধিবাসীদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত না করলে মুষ্টিমেয় কিছু বন রক্ষীদের দিয়ে এই সুবিশাল জাতীয় উদ্যানের নজরদারি তথা সংরক্ষণ কিন্তু সহজ নয়। এ বিষয়ে ইকোট্যুরিজমের উন্নয়ন এবং তার আর্থিক সুফল যাতে স্থানীয় মানুষরা পান তা সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন।

সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানের সীমানার ভিতরে অবস্থিত ৬৫ টি গ্রামের উপস্থিতিও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের পরিপন্থী। কিন্তু তাদের স্থানান্তর প্রক্রিয়া যথেষ্ট সংবেদনশীলতার সঙ্গে করতে হবে। ইতিমধ্যে কয়েকটি গ্রামের স্থানান্তর সম্ভব হলেও সেখানে বিকল্প জমি, পানীয় জল, জীবিকার অপ্রতুলতার জন্য বাকি গ্রামগুলির বাসিন্দাদের মধ্যে অনীহা ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে,সময়ে সময়ে

সংবাদমাধ্যমের কাছেও তাঁরা নিজেদের ক্ষোভ হতাশা গোপন করেন নি। এক্ষেত্রে অতীতে কানহা বা কর্ণাটক রাজ্যের ভদ্রা জাতীয় উদ্যানের মডেল গ্রহণ করা যেতে পারে।



সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানের কালো বাঘের এই জনগোষ্ঠী আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। নতুন বাহ্যিক জিনের প্রবেশ, সংলগ্ন সম্ভাব্য বাঘের আবাসস্থলগুলির উন্নতি, ব্যাঘ্র করিডোর গুলির সংরক্ষণ, চোরাশিকার প্রতিরোধ, অরণ্যে অবস্থিত গ্রামগুলির সফল স্থানান্তর এবং সংরক্ষণে স্থানীয় অধিবাসীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এই অরণ্যের বিরল জনগোষ্ঠীর বাঘের আগামী দিন সুস্থ এবং সুনিশ্চিত করবে এই আশা করা যায়।


তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার-



1.’Born Black-The Melanistic Tiger in India' by L. A. K. Singh, 1999.


2.’High frequency of an otherwise rare phenotype in a small isolated tiger population' by Vinay Sagar, Uma Ramakrishnan and others.


ক্যামেরা ট্র্যাপে কালো বাঘের ছবি: Wikimedia commons


সিমলিপাল অরণ্যের ছবি: সুমন্ত ভট্টাচার্য্য


লেখক পেশায় প্রশাসনিক আধিকারিক। প্রাণীবিদ্যার ছাত্র ও বন্যপ্রাণী প্রেমী।

Comments


474525369_1074216644505260_833710345513391369_n.jpg
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG

Editor: Dr. Sumanta Bhattacharya
Co-editor: Dr. Oishimaya Sen Nag

  • Facebook

follow our facebook page to stay updated

© 2021 by Boney Pahare. All rights reserved.

bottom of page