top of page
  • ..

মধ্যভারতের বাঘ ও টাইগার করিডরগুলির সংকট

ভারতে বাঘ বেড়েছে। তা নিয়ে প্রচার ও তৃপ্তির হাসিও আছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বাঘেদের বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠিগুলির মধ্য যোগাযোগ। মধ্যভারত বাঘেদের সবেথেকে গুরুত্বপূর্ণ আবাস ভারতে। সেখানে কেমন অবস্থায় রয়েছে বাঘেদের মধ্যে যোগাযোগ? কেন এত গুরুত্বপূর্ণ করিডরগুলি রক্ষা করা? গবেষণায় কী উঠে আসছে? আলোচনায় অনুরাগ মিশ্র


বাঘেদের জন্য যাতায়াতের পথ রক্ষা করা এখন সবথেকে বেশি প্রয়োজন। ছবি: বনেপাহাড়ে।

বাঘ হল বিশ্বের সবচেয়ে চমক জাগানো ও ভয় জাগানো জানোয়ারদের মধ্যে অন্যতম, যা মানুষের সাথেও জড়িয়ে আছে তাদের সংস্কৃতি ও কিংবদন্তির মাধ্যমে। বাঘেরা ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর উত্তরে সাইবেরিয়া থেকে দক্ষিণে জাভা অবধি। বর্তমানে, বন্যজগতে মাত্র ৭ হাজারের মত বাঘ আছে এশিয়ার কিছু বিচ্ছিন্ন এলাকায়। তাদের পুরানো জগতের মাত্র ৭% এলাকায়।

গত দুই শতকেই তাদের এই দ্রুত কমে যাওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে। বন-জঙ্গলের হ্রাস আর মানুষের বিপুল সংখ্যাবৃদ্ধির সাথে। ভারতে বাস প্রায় তিন হাজার বাঘের, যা বিশ্বে বাঘের সংখ্যার ৬০%। এই বাঘেরা রয়েছে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় তাদের বনে (যেগুলো বেশিরভাগই সুরক্ষিত বনাঞ্চল)।তারা অন্য বাঘদের গোষ্ঠীর থেকে আলাদা হয়ে আছে অরণ্যগুলির মাঝের এলাকাগুলি দ্বারা যেখানে বনের আর কোন অস্তিত্ব নেই।

বাঘদের অবস্থানকারী কিছু এলাকা চিহ্নিত Tiger Conservation Landscapes (TCLs) বলে। এগুলো বনের অবিচ্ছিন্ন বা পরস্পর সংযুক্ত অংশ যা অন্তত পাঁচটি পরিণতবয়স্ক বাঘকে ধারণ করার ক্ষমতা রাখে আর যেখানে গত দশ বছরে বাঘের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।

বাঘের মত যেসব জীবপ্রজাতির জীবনধারণের জন্য বড় এলাকা প্রয়োজন হয়, তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যোগাযোগটা দরকার জিনগত বৈচিত্র্য রক্ষা করতে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলির আয়তন খুবই কম (গড়ে ৩০০ বর্গকিলোমিটারেরও কম), যেখানে অল্পই কিছু বাঘ থাকতে পারে।

ভারতের বাঘদের এক তৃতীয়াংশ এইসব সুরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরে থাকে। জিনগত বৈচিত্র নষ্ট হয়ে যায় যদি বাঘদের কোন গোষ্ঠী সংখ্যায় ছোট হয়ে আসে, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এতে তার পরিবেশে টিকে থাকা ও মানিয়ে নেবার ক্ষমতা কমে আসে। এই জন্য জিনগত ভাবে সংযুক্ত বাঘদের গোষ্ঠীগুলিকে চিহ্নিত করা দরকার , আর দরকার তাদের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করার ব্যবস্থা নেওয়া যাতে দীর্ঘমেয়াদে তারা টিকে থাকতে পারে।

বাঘদের যাতায়াতের উপর সরাসরি কোন তথ্য পাওয়া সহজ নয়, কিন্তু জিনগত বিশ্লেষণ থেকে ধারনা করা যায় তারা এমনকি ৭০০ কিলোমিটার দূরত্বও যেতে পারে, এমনকি মানুষের ঘনবসতি এলাকা দিয়েও। এখানেই বন্যপ্রাণী করিডরের গুরুত্ব। করিডর হল এমন একফালি আবাস বা স্থান বন্যপ্রাণীদের জন্য, যার দ্বারা রাস্তা, জনবসতি বা কৃষিজমি দিয়ে বিচ্ছিন্ন অরণ্যগুলির পৃথক পৃথক বন্যপ্রাণীদের গোষ্ঠীগুলি এক অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে।


বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যোগাযোগ না থাকলে তা আদতে সংরক্ষণের পক্ষে উপযোগী হচ্ছে না।

কোন এলাকার সর্বজনীন সুরক্ষার ব্যবস্থা করা গেলে হয়ত বন্যপ্রাণীদের জন্য খুবই ভাল হত। তবে বাস্তবে তা সম্ভব নয়। কারণ তা ওখানকার মানুষের জীবনযাপনের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, বিশেষত যারা গ্রামে থাকে ও বন সংলগ্ন এলাকার অধিবাসী। বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যোগাযোগ না থাকলে তা আদতে সংরক্ষণের পক্ষে উপযোগী হচ্ছে না। তাই করিডরগুলিকে বাঁচানোতে জোর দেওয়াটাই গুরত্বপূর্ণ বলে মতপ্রকাশ করলেন Wildlife Institute of India-র গবেষক মৌলিক সরকার।

ভারতের ২৮% বাঘ মধ্য ভারতে অবস্থান করে যা মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও ছত্তিশগড়ের মত তিনটে রাজ্য মিলিয়ে হচ্ছে ৩,৮৪,৫০৮ বর্গ কিলোমিটার। এই বিরাট ভূ-খন্ডে রয়েছে ১৬টি সংরক্ষিত অরণ্য (Protected Areas), যার মধ্যে ১১টি হল টাইগার রিজার্ভ। এদের চারিপাশে রয়েছে ছোট ছোট বন, কৃষিজমি, গ্রাম ও শহর।

National Centre for Biological Sciences এর গবেষক মেঘনা নাতেশের ডক্টরাল গবেষণার বিষয় ছিল বাঘেদের মধ্যে যোগাযোগের উপর। তাঁর মতে ভারতে বাঘদের গোষ্ঠীগুলি বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বিভিন্ন গবেষণায় এই করিডরগুলিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে যাতে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী প্রজাতির যাতায়াতের পথে যে বাধাগুলি আছে তাদের সনাক্ত করা যায়।

সম্প্রতি একটি গবেষণায় ভারত, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের একদল গবেষক পাঁচটি আলাদা আলাদা গবেষণাকে একত্রে বিশ্লেষণ করেন যেগুলি মধ্য ভারতের ভূ-ভাগে বাঘদের করিডরের উপর করা হয়েছিল। ২০২২ এর মার্চ মাসে প্রকাশিত এই গবেষণায় দেখানো হয়েছে মধ্য ভারতের গুরুত্বপূর্ণ টাইগার করিডরগুলির বড় অংশই মানুষের কাজকর্মের জন্য সংকটে।

বর্তমান যেভাবে সংরক্ষণ হচ্ছে তাতে সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুরক্ষিত থাকলেও তার বাইরে নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংস চলছে উন্নয়নের নামে আর যার ফলে বন্যপ্রাণীদের আবাস্থলের শেষমেশ ক্ষতি হচ্ছেই।

পাঁচটি পূর্বতন গবেষণাতেই যে যে এলাকাগুলিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের Consensus Connectivity Areas (CCAs) বা সর্বসম্মত সংযোগরক্ষাকারী এলাকা বলে চিহ্নিত করেছে এই গবেষণাপত্রটি। এইসব তথ্যগুলি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কাজে যারা নিযুক্ত তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এইসব এলাকার ৭০% দেখা যাচ্ছে গ্রামের এলাকায় পড়ছে যা ইঙ্গিত করছে যে বন্যপ্রাণীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এইসব এলাকায় মানুষের তাৎপর্যপূর্ণ উপস্থিতি।

এছাড়াও, ১৬৫ টি CCA কোন সরলরৈখিক নির্মাণ (linear infrastructure) যেমন, রাস্তা, রেলপথ, বৈদ্যুতিক লাইন বা খনির এক কিলোমিটারের মধ্যেই আছে। যেমন, মধ্যপ্রদেশের যেসব বনাঞ্চলকে খনি ও অন্যান্য পরিকাঠামোর জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে তার ৭৮%ই সেইসব জেলায় যেখানে গুরুত্বপূর্ণ সর্বসম্মত সংযোগরক্ষাকারী এলাকাগুলি আছে।

আমাদের নীতিনির্ধারকদের জরুরি ভিত্তিতে এবার এইসব দিকে মন দিতে হবে যেখানে একই এলাকায় মানুষ ও বন্যপ্রাণী থাকে। অনেকসময়েই এইসব সর্বসম্মত সংযোগরক্ষাকারী এলাকাগুলি ভাগাভাগি হয়ে থাকে বনবিভাগ ও গ্রামসভার এলাকার মধ্যে। তাই তাদের যৌথ ব্যবস্থাপনা একটু সমস্যার। তাই স্থানীয় স্তরে এই সমস্যাগুলি নিয়ে ভাবতে হবে। বনবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলিকেও দরকার।

বর্তমান যেভাবে সংরক্ষণ হচ্ছে তাতে সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুরক্ষিত থাকলেও তার বাইরে নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংস চলছে উন্নয়নের নামে আর যার ফলে বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থলের শেষমেশ ক্ষতি হচ্ছেই। এটা নিয়ে ভাবা দরকার। National Tiger Conservation Authority (NTCA) তাই এখন জোর দিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বিভাগের সমন্বয়ের মধ্যে Tiger Conservation Landscapes গুলিতে, যা বনবিভাগকে করিডরগুলি নিয়ে পরিকল্পনা করতে সাহায্য করবে।


এই Consensus Connectivity Areas এর বিষয়টা মাথায় রেখেই এইসব অঞ্চলে উন্নয়নের পরিকল্পনাগুলি করা দরকার। দীর্ঘমেয়াদি উপায়ে যেন বন্যপ্রাণী, স্থানীয় মানুষ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্বার্থ বজায় থাক সেদিকে নজর দিতে হবে।

এই গবেষণাটির মুখ্য গবেষক রুথ ডিফ্রায়েসের মতে, “পাঁচটি আলাদা গবেষণাকে একসাথে বিশ্লেষণ করায় বোঝা গেল বৈজ্ঞানিকেরা একমত যে, কোন কোন এলাকাগুলি মধ্য ভারতে গুরুত্বপূর্ণ বন্যপ্রাণীদের যোগাযোগের জন্য। কয়েক বছর আগে Central India Landscape Symposium এ গবেষক, নাগরিক সমাজ ও প্রশাসকদের মধ্যে যৌথভাবে কাজ করার যে বিষয়টির উপর জোর দেওয়া হয়েছিল, তাতেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব”।


লেখক পরিচিতি: লেখক একজন Indian Forest Service (IFS) এর ওড়িশা ক্যাডারের ট্রেনি। তিনি IISER Pune থেকে বায়োলজিতে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট । NCBS, Bangalore ও ETH Zurich এ পূর্বে গবেষণা করেছেন।


মূল প্রবন্ধটি Mongabayপত্রিকায় প্রকাশিত। ইংলিশ প্রবন্ধটির অনুমতিক্রমে অনুবাদ করা হল বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য। মূল প্রবন্ধটির লিঙ্ক:

https://india.mongabay.com/2022/05/commentary-connecting-corridors-for-tigers-in-central-india/

70 views0 comments
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page