top of page
..

শিকার উৎসব থেকে অরণ্য বাঁচানোর লড়াই

বর্তমানে দেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ইতিহাস নিয়ে যে ক'জন উল্লেখযোগ্য গবেষণা করছেন, তাদের মধ্যে একজন রাজা কাজমি। প্রখ্যাত কনজার্ভেশনিস্ট ও পালামৌ টাইগার রিজার্ভের প্রাক্তন অধিকর্তা এস ই এইচ কাজমির পুত্র হওয়ায় ছোট থেকেই তিনি দেখেছেন ঝাড়খন্ডে বন সংরক্ষণের কাজে কতরকমের সমস্যা আমলতান্ত্রিক দিক থেকে, তার সাথে উগ্রপন্থার উপদ্রবে। তাঁর গবেষণা ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তিনি ভারতের একটি বিরাট অংশের অরণ্যে সংরক্ষণের সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করেছেন এই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধে যা আগে Seminar পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এবার বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য বাংলা ভাষায় তুলে ধরা হল। আজ দ্বিতীয় পর্ব।


ইসব প্রথাগত শিকারের সাথে আছে প্রতিনিয়ত মাংসের জন্য বন্যপ্রাণী শিকার, যা তলানিতে ঠেকা বন্যপ্রাণীর সংখ্যাকে খাদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বন্যপ্রাণীদের প্রজননের হার কখনই এই সংখ্যা হ্রাসের সাথে তাল মিলাতে পারে না, ফলত স্থানীয় ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে তারা বিলুপ্তির পথে চলে যায়। পরিবেশবিদ কেন্ট রেডফোর্ড ‘Empty Forest’ বা শূন্য অরণ্য শব্দটি প্রয়োগ করেছেন এইসব বনের জন্য যেখানে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ রয়েছে কিন্তু নেই কোন বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী মানুষের ক্রিয়াকলাপের জন্য। পূর্ব ও মধ্য ভারতের হাজার হাজার বর্গ কিলোমিটারের বন্যজীবের উপযোগী অরণ্য ঠিক এই ধরনের হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঘের কথা তো বাদই গেল, এই মিশ্র শালবনে একসময়ে প্রচুর দেখতে পাওয়া তৃণভোজী প্রাণীদেরও আর দেখা মেলে না আজ।

প্রথমে বাঘেদের বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাবার কথা দেখি আমরা। অবিভক্ত বিহারে ১৯৭২ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল ৮৫, যার ৭০-৭২ টি বর্তমানের ঝাড়খণ্ডের অংশে ছিল। একবিংশ শতকের শুরুতে তাদের সংখ্যা এক অঙ্কের পরিসংখ্যানে নেমে আসে। তেমনি বর্তমান ছত্তিসগড়ের জেলাগুলিতে ১৯৭২ এ ছিল ১৬০টি বাঘ, যার বেশিরভাগই বস্তারে। ২০০৬ এ তাদের সংখ্যা কমে আসে ২৬ এ আর ২০১৮ এ ১৯, বস্তারে কোন বাঘই ছিল না।ছত্তিসগড়ের তিনটি টাইগার রিজার্ভের মধ্যে সীতানদী- উদান্তি টাইগার রিজার্ভে বাঘের সংখ্যা কার্যত শূন্য, আর আচানাকমার টাইগার রিজার্ভে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। বস্তারের ইন্দ্রাবতী টাইগার রিজার্ভ যা কার্যত বাঘ-শূন্য, সেখানে কখনও কখনও পাশের রাজ্যের মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর-ভান্ডারা-গোন্ডিয়া জেলার অরণ্য থেকে বাঘ চলে আসে। বিগত ৩০ বছর ধরে উত্তর ছত্তিসগড়ের সরগুজায় বাঘের অস্তিত্ব নেই- যেখানে রাজা রামানুজ সরণ শিং দেও তার কুখ্যাত ১১৫০ টি (কেউ কেউ বলেন ১৭১০) বাঘ শিকারের বেশির ভাগটাই করেছিলেন।

ওড়িশায় ১৯৬৬ সালে প্রথম বাঘের জনগণনায় ৩২৬টি বাঘের সংখ্যা মিলেছে। তা নেমে আসে ১৪২ এ ১৯৭২ সালে। ২০১৮ সালে তা নেমে আসে ২৮ এ। রাজ্যের একমাত্র টিকে থাকা বাঘেরা রয়েছে সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভে। সাতকোশিয়ায় তা বিলুপ্ত। পূর্ব মহারাষ্ট্রের গাড়চিরোলিতে ১৯৭২ এ ৬০-৭০ টি বাঘ ছিল। ১৯৯০ এর মধ্যেই তাদের বিলুপ্তি ঘটে। বৃহত্তর তেলেঙ্গানা-অন্ধ্রপ্রদেশেও একই ঘটনা ঘটে। অথচ ১৯৭২ এ অবিভক্ত অন্ধ্রে বড় সংখ্যায় বাঘের সন্ধান মিলেছিল ওয়ারাঙ্গেল, আদিলাবাদ, খাম্মাম, করিমনগরের অরণ্য থেকে যা আসলে পাঁচটি অভয়ারণ্য থেকে – কাওয়াল, ইতুরনাগ্রাম,পাখাল, কিনেরসানি ও প্রাণহিতা। একবিংশ শতাব্দী হতে হতে এই সমস্ত স্থান থেকেই বাঘ বিলুপ্ত হয়ে যায়। ২০১২ সালে কাওয়ালকে টাইগার রিজার্ভ বলে ঘোষণা করা হয়, যদিও এক দশক পরেও তা বাঘশূন্য। যদিও কখনও কখনও মহারাষ্ট্র থেকে বাঘ চলে আসে সেখানে, যাদের পরে আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। পূর্ব উত্তরপ্রদেশ ও দক্ষিণ বিহার- যেসব স্থানে একসময়ে ভালই বাঘ ছিল, তা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে এসে বাঘ শূন্য হয়ে পড়ে।


এইসব তথ্য শুধু একটি প্রজাতির অন্তর্ধানের কথা বললেও তা আসলে বৃহত্তর বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেয়।সরিস্কা বা পান্নার মত সরাসরি চোরাশিকারের জন্য নয়, এখানে বাঘ ও অন্য শিকারি প্রাণীদের অবলুপ্তি ঘটে খাদ্যশৃঙ্খলের ভেঙ্গে পড়ার জন্য। প্রায় সব বড় ও মাঝারি আকৃতির তৃণভোজী যেমন গাউর, চিতল বা সম্বররা প্রথমে অবলুপ্ত হয়। এছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অবলুপ্তি হল বিলুপ্তপ্রায় বারাশিঙ্গা, কানহার বাইরে যাদের শেষ অস্তিত্ব বস্তার ও ওড়িশার সুনাবেদা অরণ্যে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ এর দশকের শেষের দিকের মধ্য বিলুপ্ত হয়ে যায় স্থানীয় অধিবাসীদের চোরাগোপ্তা শিকারের জন্য।

এখন শুধু কিছুমাত্র বুনো মোষ আছে বস্তার ও গারচিরোলির মাঝামাঝি ছোট অরণ্যের অংশে। তারা একসময় মধ্য ও দক্ষিণ ছত্তিসগড় থেকে দক্ষিণ ওড়িশা, উত্তর অন্ধ্রপ্রদেশ অবধি ছড়িয়ে ছিল। গাউররা তো তাদের আদি বাসস্থানগুলো থেকে বাঘের আগেই বিলুপ্ত হয়। ঝাড়খন্ডে প্রায় সব গাউরই হারিয়ে গেছে বাঘ হারানোর ২০ বছর আগেই, শুধু পালামৌ টাইগার রিজার্ভের ২০ বর্গ কিলোমিটারের এক ছোট অংশে ৫০-৬০টি’র মত আছে। ঝাড়খন্ডের ৩০ শতাংশ এলাকা জুড়ে থাকা অরণ্যে একসময়ে যে অনেক সংখ্যায় সম্বার হরিণ দেখা যেত (যারা বাঘের মূল খাদ্য), তারা বাঘ নিশ্চিহ্ন হবার ২০-৩০ বছর আগেই ব্যাপক শিকারের ফলে বিলুপ্ত হয়ে যায়।ভারতের অন্যত্র সহজেই চোখে পড়ে যে চিতল হরিণ, তাও ঝাড়খণ্ডে খুব কম। পূর্ব-মধ্য ভারতের অন্য অরণ্যেও প্রায় একই ছবি। একসময় খাদ্যের অভাব ঘটলে বাঘ ও অন্যান্য মাংসাশী প্রাণীরা গবাদি পশু মারা শুরু করে। এর ফলে মানুষজনের অর্থনৈতিক ক্ষতি তো হয়ই ব্যাপক, প্রাণহানিও ঘটতে থাকে কখনও কখনও। বনবিভাগ যাদের বাস্তবে খুঁজেই পাওয়া যায় না, সে প্রশাসনিক উদাসীনতার কারণেই হোক বা উগ্রপন্থার ফলে- তারা না এইসব ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ দেবার অবস্থায় ছিল না শিকার বন্ধ করার। ফলত: বেশির ভাগ বাঘকেই গবাদি পশুর মাংসে বিষ মিশিয়ে হত্যা করা হয়।

এটা না বললেই নয় যে বন্যপ্রাণীর মাংসের জন্য এই শিকারের সাথে খাদ্য-সুরক্ষার কোন যোগাযোগ নেই। এটা মূলত: প্রথা হিসেবে বা বিনোদনের জন্যই করা হয়ে থাকে।

তা ছাড়া এই সব শিকারের সাথে চোরাশিকারের যোগ থাকে। বাঘ বা অন্য প্রাণী সহজেই এই শিকারের জন্য পাতা ফাঁদে ধরা পড়ে। তারপরে তাদের বন্যপ্রাণীর পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করা হয়। এমন ঘটনা প্রতি বছরই ঘটে।

এই ধরনের শিকারিরাই প্যাঙ্গোলিন পাচারেও যুক্ত থাকে। প্যাঙ্গোলিন একটি বহুল চোরাশিকার হওয়া প্রাণী। এছাড়াও মধ্য, দক্ষিণ ও পশ্চিম ওড়িশা থেকে নিয়মিত লেপার্ডের চামড়া, হাড়, থাবা উদ্ধার হয়। যার মধ্যে কালাহান্ডিতে ২০২১ সালে একদিনে আটটি লেপার্ডের চামড়া উদ্ধারের ঘটনাও আছে। এছাড়াও দক্ষিণ ছত্তিসগড় থেকে প্রায়ই বাঘ ও লেপার্ডের চামড়া, হাড়, নখ উদ্ধার হয়। এর থেকে এটা বোঝা যায় যে এইসব এলাকায় নির্দিষ্ট লক্ষেই এইসব শিকার হয়ে থাকে।



“ আপনার রাগ হয় না যে, হুন্ডার আপনার খাসি নিয়মিত ধরে নিয়ে যায়”, বুঢ়হা নদীর ধারে পালামৌ টাইগার রিজার্ভের দক্ষিণ ভাগে মহুয়াডাঁর নেকড়ে অভয়ারণ্যে এক পশুপালককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি উত্তরে বললেন, “ না। নেকড়ে তার ভাগ টা নেয়। তাকেও তো বাঁচতে হবে।“ মহুয়াডাঁর হল দেশের প্রথম নেকড়ে অভয়ারণ্য। এটা এমন একটা জায়গা যেখানে প্রখ্যাত প্রকৃতিবিদ-ফটোগ্রাফার ও অবিভক্ত বিহারের বনবিভাগের অফিসার এস. পি. শাহী দেশের মধ্যে প্রথম Indian grey wolf এর জীবন ইতিহাস পর্যালোচনা করেন প্রায় অর্ধ শতক আগে। যদিও পালামৌ তারপরে থেকে বেশিরভাগ বন্যপ্রাণীকে হারিয়ে ফেলেছে, কিন্তু মহুয়াডাঁরে নেকড়েরা টিকে আছে। তারা আছে স্থানীয় গ্রামবাসীদের সদিচ্ছার জোরেই, যারা তাদের ছাগল বা মুরগি চুরি করে নিয়ে যেতে বাধা দেয় না নেকড়েদের, এমনকি কোন ক্ষতিপূরণ এর জন্য না পেলেও। এমন উজ্জ্বল একটা দিক, খুব ক্ষীণ হলেও একটা আশা যোগায়।

নাগার্জুনসাগর-শ্রীশৈলম টাইগার রিজার্ভ যা দেশের বৃহত্তম টাইগার রিজার্ভ ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে । বর্তমানে অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার মধ্যে বিভক্ত এই বন ঢেকে রয়েছে নাল্লামাল্লা পর্বতমালাকে। ১৯৭২ এর টাইগার সেনসাসে এখানে ২০টি বাঘ পাওয়া গেছিল। নাল্লামাল্লায় বাস চেঞ্চু আদিবাসীদের। ৫০, ০০০ এর বেশি এই শিকারি গোষ্ঠীর বাস নাল্লামাল্লায়। আশির দশকের মাঝামাঝি যখন বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে ৪০ হল, তখনই গোটা এলাকা মাওবাদীদের প্রভাবাধীন হয়ে পড়ল। আশির দশকের শেষ দিক থেকে ২০০০ এর দশকের মাঝামাঝি অবধি প্রায় কুড়ি বছর নাল্লামাল্লা হয়ে উঠেছিল জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর মাওবাদীদের দুর্ভেদ্য দুর্গ।


এই সংঘর্ষ চলার দীর্ঘ সময়ে এই ভূ-ভাগ থেকে বন্যপ্রাণীর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি এবং বিশেষজ্ঞরা এই আশঙ্কাই করেছিলেন যে বড় বড় প্রাণীদের কোন অস্তিত্ব থাকবে না। অবশেষে ২০০৬ নাগাদ যখন নিরাপত্তাবাহিনী এলাকায় প্রবেশ করে মাওবাদীদের বাধা সরিয়ে Wildlife Institute of India এখানে তাদের প্রথম বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা করতে পারে। তাদের অবাক করে দিয়ে ৬০টি’র ও বেশি বাঘ ওই টাইগার রিজার্ভে পাওয়া যায় দুটি রাজ্য জুড়ে। পাশের গুন্ডেলা-ব্রহ্মেশরম অভয়ারণ্যেও এক ডজনের বেশি বাঘ পাওয়া যায়। নাল্লামাল্লা তখন থেকেই বাঘদের ও অন্যান্য বড় প্রাণীদের একটি ঘাঁটি বলে ধরা হয় পূর্ব-মধ্য ভারতের ভূ-ভাগে। কোন আইনরক্ষকের উপস্থিতি ছাড়াই চেঞ্চুরা এখানে শিকার করেনি নির্বিচারে এবং বড় অংশের একটা প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখতে তা উপযোগী হয়েছে।

নৃতত্ববিদ হামেসের মতে, "উপজাতি সম্প্রদায়কে সংরক্ষণে বিশ্বাস করানোর বিষয়ে কিছু তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা আছে। কোন পরিস্থিতিতে সংরক্ষণ সম্ভব তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। এটা পরিষ্কার নয় যে কেন একটি সম্প্রদায় সংরক্ষণে বিশ্বাসী, অন্যরা নয়। সংরক্ষণের ধারনাটা একটা বিশ্বাসের ব্যাপার, কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে তা তৈরি হয় বোঝা কঠিন।" ভারতের বিভিন্ন অংশে যেখানে বাস বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের, সেখানে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার ফলাফল বিভিন্ন হয়েছে যা গবেষণার দাবি রাখে। এমনকি এই পূর্ব-মধ্য ভারত অঞ্চলেও বিভিন্ন অংশে এই বন্যপ্রাণী কমে যাওয়ার হার আলাদা।

যেমন এই ভূ-ভাগের উত্তর অংশে অর্থাৎ পূর্ব উত্তরপ্রদেশ, দক্ষিণ বিহার, উত্তর ও মধ্য ওড়িশা, উত্তর ও মধ্য ছত্তিসগড়ে মাঝারি ও বড় আকারের তৃণভোজীরা এবং বাঘ ও লেপার্ডের মত শিকারি প্রাণীরা প্রায় লুপ্ত হয়ে গেলেও অন্যান্য স্তন্যপায়ী যেমন, ভালুক, হনুমান, ভাম, নেকড়ে, শেয়াল ও পাখিদের সংখ্যায় তত ব্যাপক হ্রাস ঘটেনি। কিন্তু এই ভূ-ভাগেরই দক্ষিণ অংশে যেমন গাড়চিরোলি, বস্তার, দক্ষিণ ওড়িশায় অবস্থাটা আরও খারাপ যেখানে শুধু বাঘ বা বড় তৃণভোজী প্রাণীই নয়, প্রায় সব রকমের স্তন্যপায়ী প্রাণী (ভালুক ছাড়া), এমনকি বেশিরভাগ পাখিরই অবলুপ্তি ঘটেছে।যে গবেষক ও নৃতত্ত্ববিদরা বস্তারে কাজ করেন তারা দেখেছেন সেই নি:স্তব্ধ অরণ্যকে, যেখানে সাধারণ পাখিদেরও শিকার করে নি:শেষ করে দেওয়া হয়েছে।


এই পূর্ব-ভারতের অরণ্যকে কিভাবে আবার বাঁচিয়ে তোলা যায়? অধিবাসীদের মধ্যে জানোয়ারদের প্রতি সেই নিষ্ঠা জাগিয়ে তোলা যায় যেমনটা আছে তাদের জল-জঙ্গল-জমিন এর প্রতি?

একটা পদক্ষেপ হতে পারে কিভাবে বন্যজীব সংরক্ষণ করলে তা উপযোগী হতে পারে তা তুলে ধরা। বর্তমানে তারা বন্যপ্রাণীদের কোন কাজে লাগে না বলে যে ধারনা পোষণ করে, তা পরিবর্তন হতে পারে যদি সংরক্ষণের মাধ্যমে উপকারের বিষয়গুলি প্রত্যক্ষ করতে পারে সরাসরি। এর একটা মাধ্যম বন্যপ্রাণ সংক্রান্ত পর্যটনের মাধ্যমে রোজগারের ব্যবস্থা করা এবং পর্যটন সংক্রান্ত পরিকাঠামোর বিস্তার ঘটিয়ে তা গ্রাম ও সম্প্রদায়ের কাজে লাগানো।

এমনকি এইগুলোও যথেষ্ট সমাধান হয়ত নয়। তাই আরও বেশি সংযোগের প্রয়োজন। বর্তমানে যে কোন আদিবাসী আন্দোলনের মূল প্রতিবাদ অরণ্যের জমি হাইওয়ে, বাঁধ, খনি, পরিকাঠামো নির্মাণ ও একমুখী শস্য চাষের জন্য অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে এবং এইসব বন্যপ্রাণীর জন্যও ক্ষতিকর। যে Forest Rights Act (FRA) ২০০৬ সালে হয়েছে আদিবাসী ও সমাজ আন্দোলনের কর্মীদের দাবি মেনে তা অনেক সময়েই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সংরক্ষণের বিরোধী হিসাবে দেখা হয়েছে। কিন্তু আমার মতে এটা এখন সবথেকে শক্তিশালী আইনি হাতিয়ার অরণ্য বাঁচাতে। এমনকি Indian Forest Act, Forest (Conservation) Act, Environment (Protection) Act, and Wildlife (Protection) Act এইসবের থেকেও যেগুলি আসলে সরকারি ব্যবস্থায় পরিচালিত।

তাছাড়া, সক্রিয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা আসলে কাজ করে ঘোষিত সুরক্ষিত অঞ্চলগুলোয় যার মধ্যে ৫১টি টাইগার রিজার্ভ, ১০৪টি জাতীয় উদ্যান, ৫৬৬ টি অভয়ারণ্য, ৯৭টি সংরক্ষিত অরণ্য ও ২১৪টি সম্প্রদায়গত অরণ্য (Community Reserves)। অনেক স্বল্প পরিচিত সুরক্ষিত বনাঞ্চলের আশেপাশের অরণ্য অনেক সময়েই অধিগ্রহণ করা হচ্ছে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবিদদের জানার বাইরে। Forest Rights Act (FRA) এইসব ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষের প্রতিবাদের হাতিয়ার হতে পারে। যেমন বেদান্ত’র বাঘমারা খনি প্রকল্প যা ছত্তিসগড়ের বারনোয়াপাড়া অভয়ারণ্য সংলগ্ন সোনাখান অরণ্যে পড়েছিল, তা স্থানীয় মানুষের অধিকারে হস্তক্ষেপ করায় প্রতিবাদ হয়।

তেমনই ছত্তিসগড়ে বোধঘাট জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধেও দীর্ঘ প্রতিবাদ চলছে যাতে ইন্দ্রাবতী নদীতে ন’টি বাঁধ দেবার কথা আছে বোধঘাট, কুটরু, নুগুর, ভোগালগতনম ও ইঞ্চামপল্লীতে যার ফরে বস্তারের ইন্দ্রাবতী টাইগার রিজার্ভের কয়েকশ’ বর্গ কিলোমিটার জলে ডুবে যাবে। গোদাবরীর উপরে পোলাভারাম প্রকল্প নিয়েও আছে বিতর্ক উচ্ছেদজনিত কারণে। কেউ কেউ জানে যে এটির ফলে বন্যপ্রাণে সমৃদ্ধ অন্ধ্রপ্রদেশের পাপিকোন্ডা ন্যাশানাল পার্কের অনেকটাই ডুবে যাবে। সংরক্ষিত অরণ্যের বাইরে ছাড়পত্র জোগাড় করা তো আরও সহজ কোন প্রকল্পের জন্য। তাই আদিবাসী ও তাদের সহযোগীরাই এক্ষেত্রে অরণ্য নিধনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

ওড়িশার করলাপাত ও কোটগড় অভয়ারণ্যের সংলগ্ন নিয়মগিরির আন্দোলন বা ছত্তিসগড়ে আচানাকমার টাইগার রিজার্ভের পূর্ব সীমায় হাসদেঁও আরন্দ অরণ্য বাঁচানোর লড়াই আমরা জানি। এই স্থানগুলি পূর্ব-মধ্য ভারতের সংরক্ষিত অরণ্যাঞ্চলের সাথে মধ্য ভারতের বাঘ ও অন্য বন্যপ্রাণে সমৃদ্ধ অরণ্যগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ। এমনকি আদিবাসীরা পুলিশের বুলেটের সামনে পড়েছেন অরণ্য বাঁচানোর জন্য যেমন ঝাড়খন্ডের পশ্চিম সিংভূমে কোয়েল-কারো জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ২০০১ সালে। এই প্রকল্প যে খনির কারণে ধ্বস্ত পশ্চিম সিংভূমের অরণ্যকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে তাই নয়, পালামৌ টাইগার রিজার্ভের সাথে সিমলিপাল ও উত্তর ওড়িশার অন্য অরণ্যের সংযোগও নষ্ট করে দেবে।

এইসব ঘটনায় একটা বিষয় দেখা যাচ্ছে যে সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলি অনুপস্থিত থাকলেও আদিবাসীরা প্রতিবাদ করছেন। ন্যাশানাল পার্ক ও সংরক্ষিত অরণ্যের বাইরে যে এলাকা সেখানে আদিবাসীরাই প্রতিবাদে সামনের সারিতে।

এইসব আন্দোলন অবশ্যই বন্যপ্রাণীদের কথা ভেবে নয়, বরং নিজেদের অরণ্যের জমি বাঁচানোর লড়াই। তা সত্ত্বেও পরোক্ষভাবে এই আন্দোলন বন্যপ্রাণীদের বাসস্থান বাঁচানোর কাজ করছে। তেমনই, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রকল্পও অরণ্য বাঁচাতে সাহায্য করে যা আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এই যে দুটি সমান্তরাল আন্দোলন, তাদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়নোটা সময়ের দাবি। যেসব অরণ্যে বড় বড় বন্যপ্রাণী ও গুরুত্বপূর্ণ ছোট প্রজাতি রয়েছে সেই সব অরণ্যকে অধিগ্রহণ করা সহজ নয় “প্রাণী শূন্য অরণ্য” এর তুলনায়। তেমনই নতুন সংরক্ষিত অরণ্যের ঘোষণা এই বন বাঁচানোর কাজে আরও সাহায্য করবে। তবে এর জন্য সংরক্ষণ-বিদ ও বনবিভাগকে এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে সংরক্ষিত বনের প্রতি যে অসূয়া আছে তা কাটানো যায়। যেমন- বনের মধ্যে যাতায়াতের সুবিধা দেওয়া ও বনজ সম্পদের স্থিতিশীল ব্যবহার, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুবিধা, বন্যপ্রাণী জনিত ক্ষয়ক্ষতির উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ। নতুন সংরক্ষিত অরণ্যে এইসব সম্প্রদায় সিদ্ধান্ত নেওয়া ও পরিচালনা করার জায়গায় থাকবে তেমন পদক্ষেপ নেওয়াও প্রয়োজন।

এইসব আন্দোলন অবশ্যই বন্যপ্রাণীদের কথা ভেবে নয়, বরং নিজেদের অরণ্যের জমি বাঁচানোর লড়াই। তা সত্ত্বেও পরোক্ষভাবে এই আন্দোলন বন্যপ্রাণীদের বাসস্থান বাঁচানোর কাজ করছে। তেমনই, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রকল্পও অরণ্য বাঁচাতে সাহায্য করে যা আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

যদিও কিছু কঠিন বাস্তবতার থেকে আদিবাসী গোষ্ঠীগুলি ও সমাজ আন্দোলন কর্মীদের মুখ ফিরয়ে থাকলে হবে না। তাদের যে বিশ্বাস আছে যে সম্প্রদায়গতভাবে অরণ্য সংরক্ষণ করলেই বন্যপ্রাণী বাঁচবে তা একটি ভুল ধারনা। পূর্ব ও মধ্য ভারতের ‘empty forests’ গুলি ইঙ্গিত দেয় যে বৃক্ষের আচ্ছাদন অক্ষুণ্ণ থাকলেও প্রাণীজগৎ সেখানে অনুপস্থিত থাকতে পারে। বন্যপ্রাণীর কিছু বিশেষ জৈবিক ও পরিবেশগত চাহিদা আছে অরণ্য থেকে যার জন্য সেগুলো বুঝে অরণ্যের যথাযথ ব্যবহার করতে হবে মানুষকে, যাতে বন্যপ্রাণী টিকতে পারে। এর মধ্যে স্বেচ্ছায় প্রাণীজগতের জন্য কিছু সংবেদনশীল এলাকা ছেড়ে স্থানান্তরিত হবার বিষয়ও থাকবে যা FRA, 2006 (Section 2(b) read with Section 4) এবং WLPA, 1972 অনুযায়ী হবে।


একইভাবে , কৃষিজমির বিস্তার ও বন অধিকার আইন অনুযায়ী তার আইনি অনুমোদন সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, কিন্তু উপত্যকা ও নিচু জলাজমিতে তা মাঝারি আকৃতির তৃণভোজী প্রাণীর অস্তিত্বের জন্য ক্ষতিকারক। প্রকৃতপক্ষে ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডের একটা বড় অংশে এই ধরনের কৃষিজমি ও জনবসতির যে বিস্তার হয়েছে অরণ্যের মাঝে তা তৃণভোজী প্রাণীর অস্তিত্ব সংকটের কারণ যারা এইসব উপত্যকার উপর চারণভূমি ও জলের জন্য নির্ভরশীল।

উল্টোদিকে মানুষের উপস্থিতি মানেই ক্ষতিকর এমনটা নাও হতে পারে যেমনটা কঠোর সংরক্ষণের নিয়মে ভাবা হয়। তামিল নাড়ুর সত্যমঙ্গলম টাইগার রিজার্ভ বা কর্ণাটকের বি আর হিলস্ এর যে বনে সলিগা আদিবাসীরা থাকে সেগুলো এর প্রত্যক্ষ উদাহরণ।

দিনের শেষে এটাই বলার, ভারতের বনে ততটাই বাঘ থাকতে পারবে যতটা এর অসংখ্য বনবাসীরা মেনে নিতে পারবে, যাদের সাথেই বাঘেরা থাকবে একই বাসস্থানে। এখন আমাদের কাজ সেই অবস্থা তৈরি করা যাতে আরও বেশি বাঘাহুত-কে তারা মেনে নেয়। এইসব জটিল বিষয়ে নাড়াচাড়া করা মানে প্রতিটি এলাকাকে তাদের আলাদা আলাদা blueprint নিয়ে এগোতে হবে। এবং এর জন্য আদিবাসী জনগোষ্ঠী, বনবিভাগ, সংরক্ষণবিদ ও সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা সংগঠন, আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন সবার মিলিত উদ্যোগের প্রয়োজন।


(সমাপ্ত)


Footnotes:




1. R. Hames, ‘Wildlife Conservation in Tribal Societies’, in Biodiversity: Culture, Conservation, and Ecodevelopment. Westview Press, Boulder, Colorado, 1991, pp. 172-99.


2. R.S. Chundawat, The Rise and Fall of the Emerald Tigers: Ten Years of Research in Panna National Park. Speaking Tiger Publishing, New Delhi, 2018.


3. G. Shahabuddin, Conservation at the Crossroads. Permanent Black, Ranikhet, 2010.


4. Ashish Kothari, Neema Pathak, R.V. Anuradha and Bansuri Taneja (eds.), Communities and Conservation: Natural Resource Management in South and Central Asia. Sage Publications and Unesco, New Delhi, 1998.


5. https://www.survivalinternational.org/articles/3462-tigerconservationists


6. E. Rooke, Wild Animals and Birds of Bastar. Unpublished manuscript in files of Bombay Natural History Society. Bombay, 1908.


7. D. Sharma, ‘Parad or Butchery of Wild Life in Bastar’, Indian Forester 84(6), 1958, pp. 350-353.


8. G.B. Schaller, The Deer and the Tiger: A Study of Wildlife in India. University of Chicago Press, Chicago,1967, p. 101.


9. https://www.conservationindia.org/articles/hunting-festivals-of-west-bengal-an-untold-story-of-wildlife-massacre


10. Kent Redford, ‘The Empty Forest’, BioScience 42(6), 1992, pp. 412-422.


11. Schaller, op. cit., p. 101.


12. Madhu Ramnath, Woodsmoke and Leafcups: Autobiographical Footnotes to the Anthropology of the Durwa People. HarperCollins/Litmus, Delhi, 2015.


13. S.P. Shahi, Backs to the Wall: Saga of Wildlife in Bihar, India. Affiliated East-West Press, India, 1977.




** প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব।




Copyright :Seminar Publications, Delhi

ইংরাজিতে প্রবন্ধের লিঙ্ক: https://india-seminar.com/2021/744/744_raza_kazmi.htm




লেখক পরিচিতি: লেখক পরিচিতি: রাজা কাজমি একজন সংরক্ষন বিশেষজ্ঞ, বন্যপ্রাণীর ইতিহাস নিয়ে গবেষক, লেখক।

Comments


Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page