বাল্মীক থাপারের সঙ্গে দুই দশক
- ..
- 1 day ago
- 4 min read
রণথম্বর টাইগার রিজার্ভের প্রবাদপ্রতিম একজন বন্যপ্রাণী বিশারদ ছিলেন বাল্মীক থাপার। আর এক স্বনামধন্য মানুষ ফতেহ সিং রাঠোরের স্নেহধন্য বাল্মীক থাপারকে, তাঁর কাজের পরিধিকে কাছ থেকে দেখেছেন, শিখেছেন অনেক কিছুই রাজস্থানের বিশিষ্ট বন্যপ্রাণী গবেষক ধর্মেন্দ্র খান্ডাল। ফতেহ সিং রাঠোরের তৈরি সংস্থা "টাইগার ওয়াচ" এর বর্তমান পরিচালক ধর্মেন্দ্র স্মৃতিচারণ করলেন বাল্মীক থাপারের বনেপাহাড়ের পাতায়।

প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে, আমার বালমীক স্যারকে কাছ থেকে দেখার ও তাঁর থেকে শেখার সৌভাগ্য হয়েছে । ২০১১ সালে ফতেহজির (ফতেহ সিং রাঠোর) প্রয়াণের পর থেকে এমন একটি সপ্তাহও যায়নি যখন আমাদের অন্তত চারবার কথা হয়নি। আমাদের প্রতিটি আলাপচারিতা ঘুরে ফিরে রণথম্ভোর ও তার বাঘদের নিয়েই হতো।
তিনি সবসময় রণথম্ভোরের সংরক্ষণ, বিশেষ করে বাঘদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতেন। যখনই তিনি রণথম্ভোরে আসতেন, প্রতিদিন সকাল ও বিকালের সাফারিতে যেতেন। মাঝে মাঝে আমি তাঁর সঙ্গে বিকালের সাফারিতে যেতাম— এগুলো সব সত্যিই অসাধারণ অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে ভেবে দেখলে যে তিনি তখন ৭০ বছরের কাছাকাছি। তাঁর প্রাণশক্তি ও নিষ্ঠা অতুলনীয় ছিল।
সাফারির মাঝখানে বিশ্রাম নেওয়ার কোনো প্রশ্নই ছিল না। তিনি আমাকে প্রায়ই তাঁর রণথম্ভোরের বাড়িতে ডাকতেন, কিন্তু অলস সময় কাটানোর জন্য নয়—ঘণ্টার পর ঘণ্টা রণথম্ভোর, বাঘ এবং ভারতের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ নিয়ে গভীর আলোচনা করার জন্য। সেই সময়গুলোতেও তাঁর চোখ থাকত রণথোম্বরের ভবিষ্যতের দিকে, খুঁজতেন নতুন পথ।
বালমীক স্যারের সঙ্গে সাফারি মানেই ছিল বনের মাঝে একেকটি মাস্টারক্লাস। তিনি নিজের ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা, প্রাণীদের আচরণের হাল হকিকৎ, এবং অসংখ্য চমৎকার ঘটনার গল্প শোনাতেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই, তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি বিরাট। তিনি ১৫০টিরও বেশি কমিটিতে কাজ করেছেন, ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জাতীয় বন্যপ্রাণ বোর্ডের সদস্য ছিলেন এবং বহু রাজ্যে বন্যপ্রাণী বোর্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

রণথম্ভোরের মানুষদের প্রতিও তাঁর গভীর ভালোবাসা ছিল। অফিসার হোক বা জুনিয়র কর্মচারী, বা গ্রামের সাধারণ মানুষ—তাঁদের কাউকেই তিনি ভুলতেন না। বরং প্রায়শই তাঁদের গল্প বলতেন এবং জোর দিতেন যে এইসব গল্প হারিয়ে যাওয়ার আগেই পৃথিবীর সামনে তুলে ধরা দরকার। তিনি যখনই আসতেন, স্থানীয় মানুষদের এক ছাদের নিচে এনে তাঁদের অবদানের কথা বলতেন এবং সবাইকে অনুপ্রাণিত করতেন রণথম্বরের ভালোর জন্য, বাঘেদের ভালোর জন্য কাজ করতে ।
ভালমীক স্যারের সাহায্য ও সমর্থন আমার ব্যক্তিগত পথচলাতেও বড় ভূমিকা রেখেছে। তিনি আমাকে রাজস্থান স্টেট ওয়াইল্ডলাইফ বোর্ডে যুক্ত করেন, যেখানে তিনি রাজ্যের বন্যপ্রাণ ও বন্য প্রকৃতির কল্যাণে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।
তিনি সবসময় অন্যের প্রশংসা করতে দ্বিধা করতেন না। দুটো বিষয় তাঁর খুব পছন্দের ছিল। কোন বাঘের দুর্দান্ত ছবি, যেই তুলুক না কেন, কিংবা বাঘের আচরণ নিয়ে নতুন কোনো তথ্য—তিনি সেসব দেখে বা শুনে আনন্দিত হতেন, প্রশংসা করতেন এবং উৎসাহ দিতেন।
বাল্মীক স্যারের বইয়ের প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা ছিল। বিশেষ করে প্রকৃতি ও তার উপর পুরানো নথিপত্র সংক্রান্ত বইয়ের প্রতি। ক্যারাকাল নিয়ে গবেষণার সময়, আমরা প্রায়ই ব্রিটিশ আমলের পুরোনো বইগুলোর খোঁজ করতাম। আমি যখনই কোনো বইয়ের নাম বলতাম, উনি সঙ্গে সঙ্গে বলতেন, "হ্যাঁ, ওই আসল বইটা তো আমার কাছে আছে।" দেশের বিভিন্ন কাবাড়ি বাজার থেকে তিনি শত শত বিরল ও দুর্লভ বই সংগ্রহ করেছিলেন, এবং ধীরে ধীরে এক বিশাল ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর সংগ্রহে কয়েক হাজার বই থাকতেই পারে।
তিনি নিজেও প্রায় ৫০টি, বা তারও বেশি বইয়ের লেখক বা সংকলক ছিলেন। যদিও তাঁর বহু বইয়ে ছবি প্রাধান্য পেয়েছে, তবুও এটাও মনে রাখতে হবে যে অনেক বই ছিল যথেষ্ট রচনাধর্মী ও তথ্যবহুল।
তাঁর সব কাজের মধ্যে, মুঘল যুগের চিত্রকলার ওপর তাঁর বইগুলো আমাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করে। বহু বছর আগে আমি একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম, যেখানে মুঘলদের অ্যাভিয়ারিগুলিতে থাকা পাখিদের নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল এই ছবিগুলির উপর ভিত্তি করে। সেই চিত্রকলাগুলোর বর্ণাঢ্য, সূক্ষ্ম বর্ডারে যে ছোট ছোট পাখিগুলো আঁকা ছিল, সেগুলো চিহ্নিত করার দায়িত্ব ভালমীক জি আমাকে, অরিজিৎ স্যারকে ও ঘনশ্যাম গাইডকে দিয়েছিলেন।
তাঁর বইয়ের মাধ্যমেই বাঘের সঙ্গে মানুষের এক গভীর সংযোগ তৈরি করার এক অনন্য পদ্ধতি ছিল তাঁর। তিনি বাঘকে এমনভাবে তুলে ধরতেন, যাতে সাধারণ পাঠকের কাছেও এই মহারাজসিক প্রাণীটি হয়ে উঠত খুব পরিচিত ও আপন।

সংরক্ষণের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা ছিল অসীম। অনেক সময় এমন কাজেও নিজেকে নিয়োজিত করতেন, যা তাঁর সরাসরি দায়িত্ব ছিল না—কিন্তু তিনি তা করতেন নিঃশব্দে, কোথাও কোন অভিযোগ না করে। আমি এখনো মনে করতে পারি, এপ্রিলের শেষদিকে আমরা যখন কৈলাদেবী বনে যাই, সেই ভয়াবহ গরমেও তিনি দিনভর জঙ্গলে কাটিয়েছিলেন গাড়িতে । এমনকি সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও, মে-জুনের তীব্র গরমে তিনি সাফারিতে যেতেন—ভেজা তোয়ালে মাথায় জড়িয়ে একটু আরাম পেতে। কিন্তু কখনও পিছু হটতেন না। অরণ্য আর বাঘের জন্য তাঁর 'প্যাশান' কোনদিন কম পড়েনি।
চরম গরমের দিনে আমি বালমীকজিকে কৈলাদেবী ভ্রমণের জন্য রাজি করাই। তিনি সম্মত হন এবং পুরো একদিন ধরে অভয়ারণ্য ঘুরে দেখেন। অভয়ারণ্যের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য ও সংরক্ষণের বিপুল সম্ভাবনা দেখে তিনি গভীরভাবে আলোড়িত হন। সেখান থেকেই তিনি শীর্ষ বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং এই প্রায়-উপেক্ষিত এই অঞ্চলের জন্য বাড়তি সহায়তার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন।
তাঁর দ্রুত হস্তক্ষেপের ফলস্বরূপ কৈলাদেবী অভয়ারণ্যের সংরক্ষণের জন্য বিশেষভাবে ৫ কোটি টাকার অনুদান অনুমোদিত হয়।

সেই সময়েই আমি তাঁকে একটি প্রস্তাবিত মাঝারি আকারের বাঁধ প্রকল্প সম্পর্কে জানাই, যার জন্য বনভূমির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। বালমিকজির সক্রিয় সহায়তায় সেই প্রকল্পের উপর স্থগিতাদেশ জারি করা সম্ভব হয়, এবং আজও সেটি পর্যালোচনার পর্যায়ে রয়েছে।
তাঁর একটি বিরল গুণ ছিল—তিনি অত্যন্ত দ্রুত এবং কার্যকরভাবে কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারতেন। তাঁর সহায়তায় আমরা এই অঞ্চলে আরও কয়েকটি অপ্রয়োজনীয় নির্মাণ প্রকল্পও বন্ধ করতে পেরেছিলাম—যেগুলোর প্রতিটিই এই বনের ভবিষ্যৎ রক্ষায় খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে।

তিনি বয়সজনিত সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন। মাটিতে পা রেখে চলতেন তিনি। জানতেন কখন নিজেকে সরিয়ে নিতে হবে। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে, তিনি বুঝতে পারছিলেন যে সময় শেষের দিকে, এবং কাজ গুছিয়ে নিয়েছিলেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগেও নিয়মিত 'ভয়েস-নোট' পাঠাতেন। বরাবরের মতই তাঁর কণ্ঠে ছিল সেই চিরচেনা দৃঢ়তা ও নির্ভীকতা।

২০২৫ সালের ১২ মে পর্যন্ত তিনি তাঁর নতুন বই নিয়ে আলোচনা করছিলেন—রণথম্ভোরের ৫০ বছর উদ্যাপন করে একটি বিশাল দুই খণ্ডের গ্রন্থ, সম্পূর্ণ নিজের লেখা। এই বই যখন প্রকাশ হবে তা হবে তাঁর শেষ ও চূড়ান্ত অবদান, তাঁর দীর্ঘ সময়ের বিস্তৃত ও গভীর কাজের শরিক।
আমার জীবনে, বালমীক স্যারের মতো অনুপ্রেরণাদায়ক ও উৎসাহ দান করা মানুষ আমি আর কাউকে পাইনি। ফতেহজি ও তিনি- এই দুজন আমার কাছে সবচেয়ে গভীর অনুপ্রেরণার উৎস।

প্রবন্ধে প্রকাশিত সব ছবি : লেখক
লেখক পরিচিতি: ধর্মেন্দ্র খান্ডাল একজন বিশিষ্ট বন্যপ্রাণী গবেষক ও সংরক্ষণকর্মী, যিনি মূলত রণথম্ভোর জাতীয় উদ্যানে বাঘ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণ রক্ষার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি Tiger Watch নামক বন্যপ্রাণী সংস্থার বর্তমান পরিচালকদের একজন ।
Comments