এক থা টাইগার
- ..
- 3 days ago
- 3 min read
সদ্য চলে গেলেন ভারতের বিশিষ্ট বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ বাল্মীক থাপার। বনেপাহাড়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য। লিখলেন অভিষেক চক্রবর্ত্তী।

উত্তরাখন্ডের বিখ্যাত করবেট জাতীয় উদ্যান,১৯৬১ সালের এক শীতের সকাল। হাতির পিঠে সাফারিতে কাকার সাথে এক নয় বছরের বালক। হঠাৎ হলুদ ঘাসের জমিতে কিসের যেন নড়াচড়া। কাকার অঙুলি নির্দেশ অনুসরণ করে ছোট্ট বল্মীক দেখে ঘাসের বন ভেদ করে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এক বিশাল বাঘিনী। সেই প্রথম দেখা।তখন কে জানত এই দেখা একদিন পরিণত হবে অবিচ্ছেদ্য এক বন্ধনে।
১৯৫২ সালে দিল্লির এক অভিজাত পরিবারে জন্ম বল্মীক থাপারের।বাবা রমেশ থাপার এবং মা রাজ থাপার দুজনেই নামজাদা সাংবাদিক, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে যাতায়াত। আপন পিসি ছিলেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার।বল্মীক নিজেও দিল্লির বিখ্যাত সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ থেকে সমাজবিদ্যায় গোল্ড মেডেলিস্ট। এহেন ছাত্রের সামনে ছিল অধ্যাপনা, ইউ পি এস সি অথবা পারিবারিক পথে সাংবাদিক হওয়ার হাতছানি, যেমনটি থাকে রাজধানীর আর পাঁচটা মেধাবী ছাত্রের সামনে। কিন্তু জীবনের মানে খুঁজতে ২৪ বছরের যুবক যেদিন চড়ে বসেছিলেন সওয়াই মাধোপুরের ট্রেনে, সেদিনই বোধহয় লেখা হয়ে গিয়েছিল তাঁর ভাগ্যরেখা।পৌঁছে গিয়েছিলেন রণথম্ভর জাতীয় উদ্যানে। সামনে কোন লক্ষ্য ছিল না, ছিল না জিতে নেওয়ার মত কিছু। কিন্তু প্রথম দর্শনেই তরুণের মন জিতে নিয়েছিল রণথম্ভর। তার ইতিহাস, গরিমা, আরাবল্লীর অসামান্য দিগন্ত রেখা, আরণ্যক সৌন্দর্য আর রণথম্ভর এর মূল আকর্ষণ ডোরাকাটা দের নিয়ে। সময়টা ১৯৭৬ সাল, রণথম্ভর জাতীয় উদ্যানের অধিকর্তা তখন প্রবাদপ্রতিম ফতে সিংহ রাঠোর। ফতে সিংহের সান্নিধ্যে প্রথম জঙ্গল তথা বাঘে হাতেখড়ি হয় তরুণ বল্মীকের। সেই শুরু, তারপর থেকে গত ৫০ বছর ধরে রণথম্ভরের বাঘ এবং বল্মীক যেন হয়ে উঠেছিলেন একে অপরের পরিপূরক। বছরের পর বছর রণথম্ভরের বাঘের জীবনযাপন,ব্যবহার,তার বৈচিত্র্য, বংশগতি প্রত্যক্ষ করেছেন আপন নেশায়। সেই গবেষণার ফসল উঠে এসেছে বল্মীকের বাঘ নিয়ে রচিত ৩০ টির ও বেশি বইতে(Tiger, Living with Tigers, The secret life of Tigers, Tiger fire:500 years of the Tiger in India ইত্যাদি।নির্মাণ করেছেন একাধিক আন্তর্জাতিক মানের তথ্যচিত্র(Tiger,My Tiger family, Natural World,Project Tiger ইত্যাদি)।এর মধ্যে বিবিসির প্রযোজনায় 'Land of the Tiger' তথ্যচিত্র টি আন্তর্জাতিক স্তরে অত্যন্ত প্রশংসিত হয়। রণথম্ভরকে বল্মীক তুলে ধরেছেন বিশ্বের দরবারে। শুধুমাত্র বাঘের জীবনযাপন পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা নয়, ফতে সিংহের হাতে রণথম্ভরের বেড়ে ওঠা দেখেছেন একটু একটু করে । নব্বইয়ের অন্ধকার সময়ে দেখেছেন রণথম্ভরের বাঘবনে চোরাশিকারিদের দাপটে বিপন্ন বন্যপ্রাণের অসহায়তা।সরব হয়েছেন বারবার, বাঘ সংরক্ষণে সরকারি আমলাতান্ত্রিক ঢিলেমি,লাল ফিতের ফাঁসের বিরুদ্ধে।বাঘের জন্য সংরক্ষিত অরণ্যে মানুষের অনধিকার প্রবেশের বিরোধিতা করেছেন। ইকোট্যুরিজমের নামে ভারতের জাতীয় উদ্যানগুলিতে যে অনিয়মের বাড় বাড়ন্ত, তার বিরুদ্ধে মত রেখেছেন বারবার। আবার চেষ্টা করেছেন আফ্রিকার রেসপনসিবল্ ট্যুরিজম মডেলের আদলে ভারতেও যাতে অরণ্য সংলগ্ন গ্রামীণ জনজীবনে স্থিতিশীল উন্নয়নের প্রভাব পড়ে। বল্মীকের উদ্যোগে ১৯৮৭ সালে স্থাপিত হয় রণথম্ভর ফাউন্ডেশন।জাতীয় উদ্যানের ভিতর থেকে পুনর্বাসিত গ্রাম গুলির বাসিন্দাদের জন্য বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা, সেই সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ, ট্যুরিজম শিল্পে তাদের সামিল করা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে রণথম্ভর ফাউন্ডেশন গত প্রায় চার দশক ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে এসেছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ১৫০ টির ও বেশি কমিটির সদস্য ছিলেন ফরেস্ট্রি অথবা ওয়াইল্ড লাইফের কোন প্রথাগত ডিগ্রি ছাড়াই। আই ইউ সি এনএর ক্যাট স্পেশালিস্ট গ্রুপের সদস্য হিসেবে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে।কিন্তু বাঘ সংরক্ষণের প্রশ্নে চিরকালের ঠোঁটকাটা ,আপসহীন বল্মীকের শাণিত যুক্তি,সমালোচনা থেকে রেহাই পান নি মন্ত্রী,আমলা ,তাবড় বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞরাও। যে বনরক্ষীদের ওপরে নির্ভর করে ভারতের জাতীয় উদ্যান গুলির নিরাপত্তা তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ,প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সুযোগ সুবিধা দেওয়ার জন্য যেমন লড়াই করেছেন আজীবন, তেমনই সরকারি বিভিন্ন কমিটিতে থেকেও ভারতের চিতা প্রজেক্টের সাফল্য নিয়ে প্রকাশ্যেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। সরিষ্কা কান্ডের পর ২০০৫ সালে টাইগার স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য মনোনীত হলেও কমিটির সিদ্ধান্তের সাথে একমত হতে পারেন নি তিনি। একই হ্যাবিটেটে মানুষ ও বাঘের কোএক্সিস্টেন্স সম্ভব একথা বিশ্বাস করতেন না বল্মীক।তাঁর মতে বাঘের আবাসস্থল সম্পূর্ণরূপে মানুষের প্রভাবমুক্ত হওয়া প্রয়োজন।
বাঘ তথা বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের একনিষ্ঠ সৈনিক ভুগছিলেন মারণব্যাধি ক্যানসারে, শেষ পর্যন্ত হার মানলেন ৩১ শে মে ২০২৫, শনিবার। দিল্লির কৌটিল্য মার্গের বাড়িতে সকালে নিভে গেল ভারতের 'টাইগার ম্যান'এর জীবন প্রদীপ।
রেখে গেলেন জীবনসঙ্গিনী সন্জনা কাপুর এবং একমাত্র পুত্র হামিরকে।
বল্মীক থাপারের মৃত্যু ভারতের বাঘ সংরক্ষণ আন্দোলনের এক অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু ভারতের বাঘ সংরক্ষণ আন্দোলন এগিয়ে যাবে বল্মীকের মত একনিষ্ঠ সংরক্ষণ সৈনিকদের দেখানো পথে।
বল্মীক থাপার আর ফিরে আসবেন না প্রাণপ্রিয় রণথম্ভরে। কিন্তু জাতীয় উদ্যানের বুকে যখন রাত নামবে, ডোরাকাটার অস্ফুট গর্জন ছুঁয়ে যাবে আরাবল্লীকে,রত্নখচিত আকাশের বুকে একটি তারা হয়ত আরও একটু বেশিই উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। আর তার আলোয় আলোকিত হবে ভারতের জাতীয় পশুর ভবিষ্যৎ।
লেখক পেশায় প্রশাসনিক আধিকারিক। প্রাণীবিদ্যার ছাত্র ও বন্যপ্রাণী প্রেমী।
Comments