top of page
  • ..

Aditya ‘Dicky’ Singh: বাঘ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে একটি সাহসী পরম্পরার নাম

সম্প্রতি প্রয়াত হলেন রাজস্থানের রণথোম্বরের বিশিষ্ট বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ আদিত্য সিং, যিনি পরিচিত ছিলেন বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজের জগতে আদিত্য 'ডিকি' সিং নামে। প্রথাগত ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আই এ এসের চাকরি ছেড়ে রণথোম্বরের বাঘেদের কন্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কাটিয়ে গেলেন অননুকরণীয় এক জীবন। তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণায় রাজস্থানের আর এক বিশিষ্ট বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ধর্মেন্দ্র খান্ডাল

আদিত্য ‘ডিকি’ সিং- অনেক কিছুর জন্যই তাঁকে চিনি আমরা। যেমন একজন প্রকৃতিপ্রেমিক, একজন বন্যপ্রাণী নিয়ে উৎসাহী মানুষ, দারুণ একজন চিত্রগ্রাহক, একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্ব, একজন খোলা মনের বন্ধু যার ঘর ছিল সবার অবারিত দ্বার, বাঘেদের পরম সুহৃদ। শুধু তাই নয় সব প্রাণীদের জন্যই ছিল তাঁর প্রবল অনুভূতি। একজন সদা আনন্দময় ব্যক্তিত্ব যার joie de vivre ছিল বড়ই ছোঁয়াচে এবং সমাজের বাঁধাধরা নিয়মের বেড়াজালের বাইরের একজন ব্যতিক্রমী মানুষ তিনি। এইসব সম্ভব হয়েছিল তাঁর পরিবারের থেকে যে মূল্যবান শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন সেসব কারণেই। ১৯৬৬’র ২৪শে মে তিনি এলাহাবাদ , অর্থাৎ বর্তমান প্রয়াগরাজে জন্মগ্রহণ করেন।

আদিত্যর জীবন জুড়ে তাঁর বাবা ব্রিগেডিয়ার নরেশ বাহাদুর সিং ভাদুরিয়া আর মা অরুণা সি এর আশীর্বাদ ছিল ওঁর বড় অবলম্বন। তাঁদের পরিবার আসলে মধ্যপ্রদেশের ভিন্দ থেকে, যদিও পরে তাঁরা উত্তর প্রদেশের কানপুরে চলে আসেন। নিয়তির এমনই লিখন, আদিত্য পরবর্তী জীবনে সেই চম্বল এলাকাতেই চলে আসেন, চম্বল নদীর অপর পাড়ে রাজস্থানের রণথোম্বরকে নিজের ঘর বানিয়ে ফেলে। যদিও তাঁর শৈশবে বাবার সেনার চাকরির কারণ ক্রমাগত দেশের বিভিন্ন স্থানে যেমন দিল্লী, ব্যাঙ্গালুরু, প্রয়াগরাজ, জয়পুর, বিকানেরের মত জায়গায় তাদের থাকতে হয়েছে, ওদের পরিবারের চম্বল এলাকার সাথে বরাবরই যোগাযোগ ছিল।

আদিত্য কিন্তু তাঁর মত করেই ওঁর যোদ্ধা বাবা ও দাদুর জুতোয় পা গলান। তাঁরা দুজনেই সেনায় কর্মরত ছিলেন। ওঁর ঠাকুরদা মেজর মোহন সিং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন ও অক্ষশক্তির সাথে উত্তর আফ্রিকার পাঁচটি দেশে লড়েন আর তিন বছর পরেই জম্মু-কাশ্মীর পাকিস্তানের বাহিনীর সাথেও যুদ্ধে লড়েন। তাঁর এই বিরাট অভিজ্ঞতার কারণে তিনি Special List Quartermaster পদে থাকলেও ( যা আসলে non-combat role) তাঁকে একটি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়নের কোম্পানি কমান্ডার পদ দেওয়া হয়। ১৯৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি বীরগতিপ্রাপ্ত হন। তিনিই ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসে একমাত্র কোয়ার্টারমাস্টার যিনি যুদ্ধে লড়াই করেন ও দেশের জন্য শহীদ হন। National War Memorial এ তাঁর নাম লেখা রয়েছে। আদিত্য সবসময় গর্ব করতেন তাঁকে নিয়ে। বলতেন ‘bravest man I have never met’, কারণ তাঁর মৃত্যুর একবছর পর আদিত্যর জন্ম। আদিত্যর পিতা নরেশ বাহাদুর রাজপুতানা রাইফেলের ব্রিগেডিয়ার ছিলেন ও রেজিমেন্টের কমান্ডান্ট পদে থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনিও বিভিন্ন যুদ্ধের সাক্ষী যেমন ১৯৬২-র ভারত-চীন যুদ্ধ, মেজর মোহন সিং এর সাথে ১৯৬৫-র ভারত-পাক যুদ্ধে একই সেক্টরে থেকে লড়াই আর ১৯৭১ এর যুদ্ধে। বিশিষ্ট সেবা মেডেল প্রাপ্ত সেনাসদস্য তিনি।

আদিত্য দিল্লীর বারাখাম্বা রোডে মডার্ন স্কুলে পড়াশুনা শুরু করেন। পড়াশুনায় বরাবর উপর দিকে থাকা ছাত্র। একবার পরীক্ষার উত্তরপত্র ওঁর চুরি হয়ে যায় আর দেখা যায় স্কুলের বাথরুমে বন্ধুরা সেটা থেকে নকল করছে। আজও ওঁর তোলা বাঘের ছবি নিয়েও একই ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন জায়গায় সেগুলো ব্যবহার হয়। আদিত্য একসময় ১০০ মিটার দৌড়ে একজন উৎকৃষ্ট প্রতিযোগী ছিলেন। ওকে ওর লম্বা চেহারার সদ্ব্যবহার করতে বলা হত। দিল্লীর হয়ে ও প্রতিযোগিতায় অবধি নেমেছিলেন। পরে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ভর্তি হন ব্যাঙ্গালোরের BMS College এ। ওঁর ভাই বিক্রমও তাই। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় আদিত্যর উৎসাহ ছিল সেতু বানাবার দিকে। পরে তিনি আই এ এস অফিসার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু শেষমেশ তাও ছেড়ে দেন এটা বুঝে যে এইখানে ওর মন থেকে সাড়া পাচ্ছেন না। খুব দ্রুতই তিনি লোভনীয় আমলার চাকরির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ভারতীয় সমাজে যা আজও বিস্ময় উদ্রেক করার মত একটা ব্যাপার। এইসময়েই ওঁর জীবনে পুনমের আগমন, নতুন পরিবারের সূচনা।


আদিত্য আর পুনম ১৯৯৮ তে রণথোম্বরে চলে আসেন আর রণথোম্বর হয়ে ওঠে তাদের বাঘের আড্ডা। তখন সোশাল মিডিয়া তো ছিল না, খুব কম লোকই বাঘের বিষয়ে খোঁজখবর রাখত। কিন্তু আদিত্য রণথোম্বরের বাঘেদের প্রজন্মগুলিকে অনুসরণ করতেন, উৎসাহী মানুষজন অপেক্ষা করত এই নিয়ে তাঁর ব্লগের। রণথোম্বরের বন বিভাগের একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিলেন আদিত্য। তাদের হয়ে আদিত্য কি না করেছেন! না ছিল নাম করায় উৎসাহ, প্রচণ্ড পরিশ্রমী, মানুষের সাথে নিবিড় যোগাযোগ আর নতুন নতুন ভাবনা- এই ছিলেন আদিত্য।

আদিত্য সিং এর ক্যামেরায় রণথোম্বরের বিখ্যাত বাঘিনী- আ্যারোহেড। ছবি ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।

বিবিসি-র রণথোম্বরের উপরে ডকুমেন্টরি ছবিটির সাফল্যের পর আদিত্যর মূল্যবান পরামর্শ ছাড়া রণথোম্বরের উপর কোন ফিল্ম বানানোর কথা ভাবা অসম্ভব ছিল। বিশ্বের বিখ্যাত সব বন্যপ্রাণী চলচ্চিত্রকারদের সাথে কাজ করেছেন, বাঘেদের ছবি পেতে সাহায্য করেছেন। National Geographic, Animal Planet, Discovery, Disney এমন সব সংস্থার সাথে তিনি কাজ করেছেন।

প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী নিয়ে খোলাখুলি মত ব্যক্ত করতেন আদিত্য, অনেকসময় রূঢ়ভাবে হলেও সত্য বলতেন সবসময়। কোনরকম ভণিতা না করে নিজের স্বার্থের কথা না ভেবেই উচিত কথা বলতেন। তিনি রনথোম্বরের বাঘেদের কন্ঠ ছিলেন। আদিত্য ও পুনমের রণথোম্বরের বন্যপ্রাণীদের নিয়ে এই ক্রমাগত ভাবনার ফলশ্রুতিতে ওরা অরণ্যের বাইরে ৩৫ একরের পরিক্তত্য জমি কিনে নেন আর ২১ বছরের চেষ্টায় সেখানে একটা অরণ্য বানিয়ে ফেলেন। এই জায়গাটায় এখন হাজার হাজার গাছের অবস্থান আর এখানে বাঘেরা ও তাদের শিকার করার প্রাণীরাও আশ্রয় নেয়।

আদিত্য সিং এর ক্যামেরায় রণথোম্বরের বিখ্যাত বাঘ - উস্তাদ। ছবি ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।

এই বছর সেপ্টেম্বারের ৬ তারিখ আদিত্য চিরবিদায় নিলেন। আমরা যারা ওঁকে জানার সুযোগ পেয়েছিলাম তাদের হতচকিত ও শোকে মুহ্যমান করে দিয়ে। তবে একটা বিষয়ে আমরা আশান্বিত থাকব যে আদিত্য যে অদ্বিতীয় পরম্পরা তৈরি করে গেলেন তা পরবর্তী প্রজন্মকে আগামী অনেক বছর উৎসাহ জোগাবে যারা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, ফটোগ্রাফি নিয়ে কাজ করবে, যারা ভাবনা চিন্তায় অন্য রকম হবে। আর এই বিষয়টা খুব সত্যি ওর ছোট্ট কন্যা নিরার জন্য যে ক্যামেরা হাতে বাবার মতই সহজাত দক্ষতা দেখাচ্ছে এই বয়সেই।



লেখক পরিচিতি: ধর্মেন্দ্র খান্ডাল রনথোম্বরের Tiger Watch সংস্থার সাথ যুক্ত একজন বিশিষ্ট বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ।


আদিত্য সিং ওর ছবি ও তাঁর তোলা বাঘের ছবি ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।


Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page