top of page

গোধাবনের খোঁজে: Great Indian Bustard এর শেষ আশ্রয় রাজস্থানের তৃণভূমিতে একদিন

  • ..
  • May 30
  • 8 min read

Great Indian Bustard ভারতের বিপন্ন হতে বসা একটা পাখি প্রজাতি। IUCN ঘোষিত Critically Endangered এই পাখির আবাস একসময় পশ্চিম , মধ্য ভারত, দাক্ষিণাত্য এমনকি, পাকিস্থানের বিস্তীর্ন অঞ্চলে থাকলেও ব্যাপক শিকার ও বাসস্থানের ধ্বংসের কারণে এই পাখির সংখ্যা এখন ১০০ থেকে ১৫০ র আশেপাশে এসে ঠেকেছে। ৯৫% উপর এই স্বল্প সংখ্যার পাখিরা টিকে রয়েছে রাজস্থানের থর মরু অঞ্চলের তৃণভূমিতে। বাড়তে থাকা উন্নয়ণ, বিশেষত: সৌরবিদ্যুতের বড় বড় প্যানেলের বিদ্যুৎবাহী তার তাদের অস্তিত্ব এখানেও সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর মধ্যেই এক কঠিন লড়াই চালাচ্ছে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত কিছু সংস্থা আর স্থানীয় বিশনোই সম্প্রদায়ের মানুষেরা এদের বাঁচাতে। পোখরানের কাছে সেই সব স্থানে এইসব কর্মকান্ড দেখে এসে জানাচ্ছেন বনেপাহাড়ের সহযোগী সম্পাদক ড: ঐশিমায়া সেন নাগ। সঙ্গে ছবিতে অক্ষিতা জৈন, ড. সুজিত নারওয়াড়ে পঙ্কজ বিশনোই



BNHS  এর তৃণভূমিতে ভারতের অনন্য সম্পদ গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড।  ছবি: ড. সুজিত নারওয়াড়ে 
BNHS এর তৃণভূমিতে ভারতের অনন্য সম্পদ গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড। ছবি: ড. সুজিত নারওয়াড়ে 

থর মরুভূমির সুবিশাল প্রান্তর আমার চোখের সামনে । চোখে পড়ার মতো সামান্য সবুজ - ইতস্তত ছড়ানো মরু ঝোপঝাড় আর এক-আধটা বিচ্ছিন্ন গাছ। যদিও তখন ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি,কিন্তু  সূর্য মাথার উপর তীব্রভাবে জ্বলছিল, তার তেজে আমার ত্বক আর চোখ ঝলসে যাচ্ছে। জলতেষ্টা পেতে আমি আধা বোতল জল একসাথে শেষ করে ফেললাম—এ ধরনের প্রতিকূল পরিবেশে জল একান্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু এই কঠিন প্রকৃতির মাঝেও এই ভূ-প্রকৃতির  আদিম সৌন্দর্য এবং এখানে বসবাসকারী জীবজগতের বৈচিত্র্য আমাকে মুগ্ধ করছিল। আমি এই রুক্ষ মরুপ্রান্তরে এসেছি  সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ও বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী অক্ষিতা জৈনের সঙ্গে । এখান বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি (BNHS), স্থানীয় বিশনোই সম্প্রদায় এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ উদ্যোগে মহাবিপন্ন  গোধাবন বা গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড (GIB)-এর আশ্রয়স্থল সংরক্ষণের যে কাজ চলছে তা দেখতে ও  নথিভুক্ত করতে এসেছি আমরা।

"চলো, এখন ফিরে চল বেসক্যাম্পে।  বিকেলে আবার চেষ্টা করব," বললেন ড. নীলকণ্ঠ বোরা—এক সময়ের দন্ত চিকিৎসক, এখন বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির (BNHS) প্রোগ্রাম অফিসার, যিনি রাজস্থানের থর অঞ্চলে গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন।

নীলকণ্ঠের নির্দেশ মেনে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। তখন প্রায় দুপুর, আর মরুভূমিরর গরম ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠছিল। BNHS-এর ফিল্ড বেস থেকে বেরিয়ে আমি আর অক্ষিতা প্রায় এক ঘণ্টা ধরে মরুভূমির মধ্যে হেঁটে বেড়িয়েছিলাম নীলকণ্ঠর সঙ্গে, Critically endangered গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড বা স্থানীয় ভাষায় গোধাবনের কোনো চিহ্ন খোঁজার আশায়, কিন্তু সাফল্য মেলেনি।

আনুমানিক তথ্য অনুযায়ী, এই পাখি এতটাই দুর্লভ হয়ে উঠেছে যে বিশ্বজুড়ে এদের সংখ্যা ১০০-১৫০ এর আশেপাশে। এর মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশই রাজস্থানের জয়সলমীর জেলার থর মরু অঞ্চলে বাস করে।




“গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড (GIB) জীবনচক্রের গতি খুব ধীর। এই  কারণে এদের বিলুপ্তির ঝুঁকিপূর্ণ প্রজাতি(extinction prone) হিসেবে বিবেচিত হয়। এদের প্রধানত দু’টি অঞ্চলে পাওয়া যায়: রাজস্থানের ডেজার্ট ন্যাশনাল পার্ক (DNP) ও তার আশেপাশের এলাকা এবং পোখরান ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জের ভিতর ও চারপাশে। ভারত-পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সীমান্তের কাছে এদের একটি ছোট জনসংখ্যা—প্রায় ১০ থেকে ১৫টি পাখি—বসবাস করে বলে অনুমান” জানালেন নীলকণ্ঠ।

আমাদের হাঁটা শেষ হলো BNHS-এর ফিল্ড বেসে। একটি একতলা সিমেন্ট-ইঁটের তৈরি বাড়ি, যার চারপাশে পাথরের প্রাচীর ও খোলা প্রবেশদ্বার। বাড়িটিতে দুটি ঘর, একটি রান্নাঘর এবং একটি শৌচাগার ছিল। আমরা সবাই বাইরের খাটে আমাদের ব্যাগ, ক্যামেরা আর অন্যান্য সরঞ্জাম নামিয়ে রেখে  বিশ্রাম নিতে গেলাম।


ফিল্ড ওয়ার্কে ডা: নীলকন্ঠ বোরা ও পঙ্কজ বিশনোই। ছবি: অক্ষিতা জৈন।
ফিল্ড ওয়ার্কে ডা: নীলকন্ঠ বোরা ও পঙ্কজ বিশনোই। ছবি: অক্ষিতা জৈন

BNHS-এর এই ফিল্ড বেসটিই নীলকণ্ঠ এবং তার দলের অন্যান্য সদস্যদের কর্মস্থল। এই দলে রয়েছেন কমিউনিটি এনগেজমেন্ট অফিসার সচিন ও পঙ্কজ বিশনোই এবং সিনিয়র ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট রাজেশ পারমার। তাঁরা সবাই এখানে কাজ করেন ড. সুজিত নারওয়াড়ের নেতৃত্বে, যিনি BNHS-এর বাস্টার্ড ও ফ্লোরিকান প্রোগ্রামের ডেপুটি ডিরেক্টর। যদিও ড. নারওয়াড়ে আগের দিন জরুরি কাজে রাজস্থানের অন্য একটি BNHS ফিল্ড লোকেশনে যেতে বাধ্য হন, তিনি যাওয়ার আগে আমাদের সঙ্গে তাঁর দলের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

ফিল্ড বেসটি থরের ঘাসজমির একটি নতুন করে পুনরুজ্জীবিত  অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত, পোখরান শহর থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট দূরে। পোখরানই হল সবচেয়ে কাছের শহর, যা ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার স্থান হিসেবেও পরিচিত। আশেপাশে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত কোনো মানব বসতি নেই এখানে, এবং একমাত্র ব্যক্তিগত যানবাহনেই সেখানে পৌঁছানো সম্ভব। ফিল্ড বেসের সবচেয়ে কাছের গ্রামটি হল খেতোলাই, যা পঙ্কজ ও সচিন বিশনোইয়ের বাসস্থান।


চিংকারা হরিণ। এই তৃণভূমির বাসিন্দা। ছবি: অক্ষিতা জৈন।
চিংকারা হরিণ। এই তৃণভূমির বাসিন্দা। ছবি: অক্ষিতা জৈন

খেতোলাই এবং আশেপাশের কয়েকটি গ্রামে বাস করেন বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষ, যাঁরা বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের একনিষ্ঠ সমর্থক। কারণ বিশনোই ধর্ম তাদের সকল জীবের প্রতি করুণা প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়। খেতোলাইয়ের উত্তরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জ রয়েছে—পোখরান টেস্ট রেঞ্জ (PTR)—যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এই অঞ্চলগুলো মিলে গোধাবনের (GIB) জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল হয়ে উঠেছে, তবে পাশের ডেজার্ট ন্যাশনাল পার্কের মতো এগুলো সরকারিভাবে সংরক্ষিত এলাকা নয়।

 

"চলো, ছাদে চলো। তোমাদের একটা জিনিস দেখাব" বললেন নীলকণ্ঠ।

তাই আমি আর অক্ষিতা দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা মই বেয়ে তাঁর পেছন পেছন ছাদে উঠলাম।

"বেড়ার দুই পাশে পরিবেশের পার্থক্যটা দেখতে পাচ্ছো তো?"—আমাদের জিজ্ঞেস করলেন নীলকণ্ঠ।

আমরা মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

আমরা দেখতে পেলাম একটি বেড়া ফিল্ড বেসের পেছন থেকে শুরু হয়ে দিগন্ত পর্যন্ত চলে গিয়েছে। বেড়ার ডানদিকে, যেখানে ফিল্ড বেস অবস্থিত, সেখানে এক সমৃদ্ধ তৃণভূমি, আর বামদিকে ছিল তুলনামূলকভাবে সবুজ এলাকা, যেখানে সারি সারি ঝোপ একে অন্যের গায়ে গায়ে বেড়ে উঠেছে।

"ওগুলো হল সোনামুখি চাষ—বা কাসিয়া অ্যাঙ্গুস্টিফোলিয়া—যা স্থানীয় জমি মালিকেরা বাঁ দিকের জমিতে ফলান। তারা এই ফসল চাষের জন্য প্রাকৃতিক উদ্ভিদ কেটে ফেলে। এটি থেকে একটি ল্যাক্সেটিভ জাতীয় ওষধি পণ্য তৈরি হয়, যা বাজারে বিক্রি হয়। তাই এই দিকটা গোধাবন ও অন্যান্য স্থানীয় বন্যপ্রাণীর জন্য একটি অনুপযুক্ত  বাসস্থান। কিন্তু ডানদিকে, যেখানে ফিল্ড বেস অবস্থিত, সেই জমি স্থানীয় বিশনোইরা আমাদের দিয়েছেন, যাতে আমরা স্থানীয় বন্যপ্রাণীর জন্য একটি নিরাপদ বাসস্থান তৈরি করতে পারি। আমরা সেখানে মেসকুইট বা প্রোসোপিস জুলিফ্লোরা-এর মতো বহিরাগত  প্রজাতি সরিয়ে দিয়েছি এবং বুই (Aerva pseudomentosa), মুরাট (Brachiaria ramosa), ভুরাট (Cenchrus biflorus), ছাগ (Crotalaria burhia), গান্থিয়া (Dactyloctenium sindicum) এবং থর অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘাসের প্রজাতি সেউয়ান (Lasiurus sindicus)-এর মতো দেশজ উদ্ভিদ পুনরায় রোপণ করেছি। তাই বেড়ার এই পাশে যে উদ্ভিদদের তোমরা দেখছো, তা একদম স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক,"—থর অঞ্চলে BNHS যেভাবে বন্যপ্রাণী বিশেষত: GIB-র বাসস্থান পুনরুদ্ধারের কাজ করছে, তা ব্যাখ্যা করলেন নীলকণ্ঠ।


ডেজার্ট ন্যাশানাল পার্কে গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের একটি দল।  ছবি: ড:রাজু কাসাম্বে/ উইকিমিয়া কমনস্
ডেজার্ট ন্যাশানাল পার্কে গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের একটি দল। ছবি: ড:রাজু কাসাম্বে/ উইকিমিয়া কমনস্

আমরা দেখতে পেলাম ফিল্ড বেসের ছাদে কিছু সৌর প্যানেল বসানো আছে। নীলকণ্ঠ জানালেন, এটাই ফিল্ড বেসের একমাত্র বিদ্যুৎ সরবরাহের উৎস। প্রচণ্ড গরমের দিনে, যখন তাপমাত্রা ৫০°C বা তারও বেশি হয়ে যায়, তখনও তাঁরা কুলার বা এয়ার কন্ডিশনার ছাড়াই থাকতে বাধ্য হন, কারণ এই সৌর প্যানেলগুলো এতটা শক্তিশালী নয় যে সেসব যন্ত্র চালাতে পারে। ফ্রিজ না থাকায় প্রতিবারই তাঁদের তাজা খাবার রান্না করে খেতে হয়।

এই শুষ্ক অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকে জল সংগ্রহ করতে হয়, যা একটি কঠিন কাজ, এবং সেই জলও অত্যন্ত মেপে খরচ করতে হয়। গ্রীষ্মকালে ধুলিঝড় বা বালিঝড় একেবারে সাধারণ ঘটনা এবং সময়মতো সুরক্ষা আশ্রয় না নিলে তা শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে। শীতকালও একইভাবে চরম; তখন তাপমাত্রা কখনও কখনও ১°C পর্যন্ত নেমে যায়। তখন কোনো হিটার বা উষ্ণ করার যন্ত্র না থাকায়, উষ্ণ পোশাক আর মোটা চাদরই ঠান্ডা রাতগুলোয় টিকে থাকার একমাত্র ভরসা।

আমরা যখন আরও জানলাম সেখানে বসবাসকারী BNHS কর্মীদের জীবনযাত্রার ধরণ সম্পর্কে, তখন বুঝতে পারলাম  কার্যক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে কতটা ধৈর্য, নিবেদন, উৎসাহ এবং সংকল্প প্রয়োজন।

 

নীচের তলায় ফিরে এসে আমরা দেখতে পেলাম কমলেশ কুমার বিশনোইজী আমাদের অপেক্ষা করছেন। নীলকণ্ঠ তাঁকে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন স্থানীয় বন দপ্তরের সহকারী ফরেস্টার হিসেবে। নীলকণ্ঠ আগেই আমাদের কমলেশজীর কাজকর্ম সম্পর্কে নানা গল্প শুনিয়েছিলেন, বিশেষত" থর অঞ্চলে গোধাবন সংরক্ষণে তার অসাধারণ ভূমিকার কথা। সেই দিন তাঁকে দেখে এবং তাঁর সঙ্গে থরের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে অনেক কথাবার্তা বলতে বলতে আমরা সত্যিই অনুপ্রাণিত হলাম।

কমলেশজী একটু পরে বিদায় নিলেন , তাঁর গাড়িতে অফিসের পথে রওয়ানা দিলেন।  আমরা পঙ্কজের বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম, খেতোলাই গ্রামে। সেখানে তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করব আমরা।  তাঁর পরিবারও সেই জমির মালিকানার অংশীদার যা BNHS এখন বেড়া দিয়ে ঘিরে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য কাজ করছে।


 মা ও সন্তান।  ছবি: পঙ্কজ বিশনোই।
মা ও সন্তান। ছবি: পঙ্কজ বিশনোই

সিনিয়র ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট রাজেশ পারমারজী, যাঁর BNHS-এ কাজের অভিজ্ঞতা ১৭ বছরেরও বেশি, তিনি আমাদের গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ফিল্ড বেস থেকে খেতোলাই প্রায় পনেরো মিনিটের দূরত্বে। নীলকণ্ঠ ও পঙ্কজ আমাদের সঙ্গে ছিলেন, আর সচিন বেসেই থেকে গিয়েছিলেন। পথে আমরা দেখতে পেলাম একটি রেললাইন ঘাসভূমির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে—এই সরলরৈখিক পরিকাঠামো বা linear infrastructure  বন্যপ্রাণীর জন্য  একটা বড় বিপদ। কারণ ট্রেনের সাথে সংঘর্ষের কারণে এখানকার বন্যপ্রাণীর হতাহতের ঘটনা ঘটে প্রায়ই।

"ওদিকে দেখো," নীলকণ্ঠ গাড়ির জানালা থেকে বাইরে ইশারা করলেন। "দেখো একটি মরুভূমির বিড়াল -Indian desert cat। যত দ্রুত সম্ভব তোমাদের ক্যামেরায় ছবি তুলে নাও। ও সোজা  আমাদের গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে দেখো," তিনি বললেন।

আমরা সবাই খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। অক্ষিতা এবং আমার জন্যই  প্রথমবার এই প্রাণীটি দেখার সুযোগ হল। এটি একটি ছোট বন্য বিড়াল, এশীয় বন্য বিড়ালের একটি উপপ্রজাতি, যা প্রায় গৃহপালিত বিড়ালের আকারের। বালি রঙের লোমের ওপর কালো ছোপ ছোপ দাগ থাকে এদের।


Indian desert cat। ছবি: অক্ষিতা জৈন।
Indian desert cat। ছবি: অক্ষিতা জৈন

আমরা বিড়ালটির ছবি তুলে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময়, মরুভূমির মধ্য দিয়ে একটি হাই-ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক পাওয়ার লাইন দেখতে পেলাম। নীলকণ্ঠ গাড়ি থামানোর নির্দেশ দিলেন এবং আমাদের বুঝিয়ে বললেন যে এই হল গোধাবন এবং অন্যান্য পাখিদের জন্য আরেকটি বড়  বিপদ।

"গোধাবনের সামনে থেকে দেখার ক্ষমতা ভালো নয়, তাই তারা প্রায়ই এই বৈদ্যুতিক লাইনের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা যায়— সংঘর্ষের ধাক্কাতেই বা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে," তিনি বললেন। "তাদের শরীরও ভারী, ফলে দ্রুত দিক পরিবর্তন করতে অসুবিধা হয়। তাই  এই  বিপদে তারা আরও বেশি পড়ে।"

তিনি আমাদের দেখালেন যে, এই সমস্যার মোকাবিলায় পাওয়ার লাইনে পাখিদের সতর্ক করার জন্য বার্ড ডাইভার্টার এবং ব্লিঙ্কার বসানো হয়েছে। তবে তিনি বললেন, সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল পাওয়ার লাইনের ভূগর্ভে স্থাপন করা।


 তৃণভূমির উপর দিয়ে চলে যাওয়া হাই-ভোল্টেজ বিদ্যুৎবাহী তার।  ছবি: অক্ষিতা জৈন।
তৃণভূমির উপর দিয়ে চলে যাওয়া হাই-ভোল্টেজ বিদ্যুৎবাহী তার। ছবি: অক্ষিতা জৈন

আমরা যখন আবার সামনে এগোতে থাকলাম, তখন দূরে একটা খয়ের গাছের নিচে একটি উঁচু বালুর টিলা পেরিয়ে আমি কিছু সরে যেতে দেখলাম। রাজেশ জীকে গাড়ি থামাতে বললাম। দূরবীণ দিয়ে তাকাতেই দেখতে পেলাম মরুভূমির একটি শিয়াল! সেটাও কৌতূহল নিয়ে যেন  আমাদের গাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল।  এদের হোয়াইট-ফুটেড ফক্সও বলা হয়। এটি মরুভূমির বিড়ালের মতই এই অর্ধশুষ্ক ঘাসভূমির বাস্তুতন্ত্রের মাংসাশী প্রাণীদের একজন। এরা মরুভূমির বিভিন্ন প্রাণী যেমন জারবিল বা বড় ইঁদুর, বালির ইঁদুর, ছোট পাখি ইত্যাদি খেয়ে বাঁচে।

 যাওয়ার পথে  আমরা দেখতে পেলাম গৃহপালিত গরু ও উট ঘাসভূমিতে চরে বেড়াচ্ছে। এরা মূলত পরিত্যক্ত প্রাণী—যাদের মালিকেরা ছেড়ে দিয়েছেন এবং এখন তারা বুনো পরিবেশের অংশ হয়ে গেছে। স্থানীয় বন্যপ্রাণীদের, যেমন চিঙ্কারা—যাদের আমরা প্রচুর সংখ্যায় দেখতে পেলাম— তাদের সঙ্গে খাদ্যের জন্য প্রতিযোগিতা করে টিকে আছে এক পরিবেশে ।

কিছু বুনো শূকর ও নীলগাইও দেখতে পেলাম। জানতে পারলাম যে এরা এই বাস্তুতন্ত্রের স্থানীয় নয়। ক্যানাল নির্মাণের ফলে  এখানে জলের পরিমাণ বাড়ায় তারা এ অঞ্চলে আসতে শুরু করেছে। আমরা আরও বিভিন্ন প্রজাতির পাখিও দেখতে পেলাম—Griffon,  একটি Egyptian vulture,  একটি steppe eagle আর  red-vented ও white-cheeked bulbuls।

অচিরেই আমরা খেতোলাইয়ের ছোট্ট বিশনোই গ্রামে পৌঁছে গেলাম। অক্ষিতা ও আমাকে পঙ্কজ তাঁর বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন, যেখানে পরিবারের মহিলারা আমাদের মুখভরা হাসি দিয়ে স্বাগত জানালেন। তাঁরা তাঁদের ঐতিহ্যবাহী রাজস্থানী পোশাকে পরে ছিলেন—উজ্জ্বল রঙের ঝলক আর অনেক গয়নায় ভরপুর।




বিশনোই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা জাম্বেশ্বরজি ভগবান
বিশনোই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা জাম্বেশ্বরজি ভগবান

তাঁরা আমাদের পরিবেশন করলেন সদ্য তৈরি ছাচ, যা গরুর দুধ দিয়ে বানানো দইয়ের মত  একটি পানীয়। সম্ভবত আমাদের জীবনে খাওয়া সেরা ছাচ ছিল।

আমরা পঙ্কজের ঠাকুমার সঙ্গেও দেখা করলাম। বয়স আশির ওপরে, তবু তিনি এখনও খুব চনমনে ও সবল। তিনি আমাদের হাত নিজের হাতে ধরে রাখলেন এবং স্থানীয় মারওয়াড়ি ভাষায় অনেক কথা বললেন, যা পঙ্কজের কাকিমা আমাদের বোঝার সুবিধার জন্য হিন্দিতে অনুবাদ করে দিচ্ছিলেন।

আমরা জানতে পারলাম কীভাবে পঙ্কজের এই বিশনোই পরিবার এবং খেতোলাই গ্রামের আরও অনেক পরিবার তাঁদের জমি দিয়েছেন  BNHS-কে ঘেরা  একটি বিচরণভূমি বানানোর জন্য, যাতে গোধাবন এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণী সেখানে নির্বিঘ্নে থাকতে পারে নিরাপদে।







পঙ্কজের বিশনোই পরিবার। ছবি: অক্ষিতা জৈন।
পঙ্কজের বিশনোই পরিবার। ছবি: অক্ষিতা জৈন


 এই ধরনের মহানুভবতা একমাত্র বিশনোইদের কাছ থেকেই আশা করা যায়—যাঁরা সর্বদা প্রাণী ও উদ্ভিদ রক্ষায় সর্বস্ব দিতে প্রস্তুত, যেমনটি তাঁদের গুরু জাম্বেশ্বরজি আজ থেকে পাঁচ শতাব্দী আগে তাঁদের শিখিয়েছিলেন।

“এই বিশনোই পরিবারগুলি শুধু BNHS-কে বাস্টার্ডদের জন্য একটি আদর্শ ঘাসভূমির বাসস্থান তৈরি করতে জায়কা দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেননি, বরং  ওদের রক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এছাড়াও অন্য গ্রামগুলির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করতে  সহায়তা করেছেন ওরা,” বলছিলেন  নীলকান্ত।



BNHS-এর ফিল্ড বেসে ফেরার পথে মরুভূমির ওপরে অস্তগামী সূর্য এক মায়াবী দৃশ্য সৃষ্টি করেছিল। আমাদের চোখ তখনও খুঁজে চলেছিল। যদি একবার মাত্র Great Indian Bustard এর  ঝলক দেখা যেত! আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমি কল্পনা করতে পারছিলাম তাকে—সোনালি ঘাসের ফাঁকে, কালো টুপি-পরা তার সাদা মাথা উঁচু করে তাকিয়ে আছে দূরে কোথাও এই বিশাল তৃণভূমিতে।

আমি জানতাম, যদি এই পাখিকে বাঁচানোর কোনো আশার আলো থাকে, তা এখানেই—এই মাটিতে, যেখানে বিষ্ণোইরা এখনো তাকে ভালোবাসে আর স্বাগত জানায় , ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বনবিভাগ তাকে রক্ষা করে, আর BNHS তাকে উপহার দিয়েছে এক সমৃদ্ধ ও নিরাপদ আবাসভূমি।




লেখক পরিচিতি: ড: ঐশিমায়া সেন নাগ বায়োকেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট। বর্তমানে বন্যপ্রাণ ও সংরক্ষণের কাজে নিবেদিত। কানাডা থেকে প্রকাশিত শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট worldatlas এর অন্যতম সম্পাদক। বাংলা ওয়েবজিন 'বনে-পাহাড়ে'র সহযোগী সম্পাদিকার দায়িত্বেও তিনি যুক্ত।







Kommentarer


86060474-00b1-415d-8c11-9c4471c9c5e7.png
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG

Editor: Dr. Sumanta Bhattacharya
Co-editor: Dr. Oishimaya Sen Nag

  • Facebook

follow our facebook page to stay updated

© 2021 by Boney Pahare. All rights reserved.

bottom of page