top of page

টাইগার টাইগার....বার্ণিং ব্রাইট(?)

  • ..
  • Jul 29
  • 8 min read

আজ ২৯ শে জুলাই,বিশ্ব ব্যাঘ্র দিবস। ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে পৃথিবীর ১৩ টি বাঘের আবাসস্থল (tiger range countries) দেশের সম্মতিতে এই দিনটিকে  'বিশ্ব বাঘ দিবস' রূপে ঘোষনা করা হয়। প্রতি বছর  কেন্দ্রীয় সরকারের বন  মন্ত্রক, বিভিন্ন রাজ্যের বন দফতর, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা,সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে আজকের দিনটি মহাসমারোহে পালিত হয়। আর হবে নাই বা কেন ,বিশ্বের সর্বাধিক বাঘের আবাসস্থল (৭০ শতাংশ) যে আমাদের দেশ ভারত। তবে কিভাবে বিপন্নতার মুখে পড়ল আমাদের জাতীয় পশুর অস্তিত্ব আর কিভাবে সেই বিপন্নতার সাথে  আজও চলছে  ডোরাকাটার ফিরে আসার লড়াই তাই নিয়েই আজকের গল্প। কলমে অভিষেক চক্রবর্তী। আজ প্রথম পর্ব


বাঘ দিবস উপলক্ষে ভারত সরকারের Ministry of Environment, Forest and Climate Change, Government of India এর বার্তা ।
বাঘ দিবস উপলক্ষে ভারত সরকারের Ministry of Environment, Forest and Climate Change, Government of India এর বার্তা ।

"আসন্ন শীতের  আকর্ষণীয় অফার:

আসন্ন শীতে অলওয়েন কুপার দিচ্ছে এই আকর্ষণীয় প্যাকেজ -

 

ফার অ্যান্ড ফেদার-   একটানা সাত দিন ধরে  একটি  রয়েল বেঙ্গল বাঘ  এবং অগুনতি বনমোরগ শিকার করার  সুবর্ণ সুযোগ।প্যাকেজ মূল্য মাত্র ৫০০০ ডলার প্রতি জন (অতিরিক্ত খরচে  টোপের সুবন্দোবস্ত করা হয়) । "

 

সকালে ঘুম থেকে উঠে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চায়ের পেয়ালা নিয়ে খবরের কাগজে চোখ বোলাতে গিয়ে এরকম একটা বিজ্ঞাপনে চোখ পড়লে  আজ নিশ্চয়ই বিশ্বাস হবে না কারোরই। কিন্তু আজ থেকে মাত্র ষাট বছর আগেও  দেশের নামজাদা সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে এরকম বিজ্ঞাপন  হামেশাই প্রকাশিত হত। বাঘ শিকার তখনও ছিল আইনসিদ্ধ।উচ্চ মূল্যের এই শিকার প্যাকেজ ট্যুর গুলির ক্রেতারা ছিলেন মূলতঃ বিদেশী ধনী অভিজাত সমাজের মানুষজন। আর এই শিকার পর্যটনের মূল উদ্যোক্তা কোম্পানি গুলির মালিক ছিলেন আমাদের দেশেরই দেশীয় মহারাজা, নবাব বা তাদেরই পরিবার পরিজন, বংশধররা।

ঊনিশ শতকের শুরুতে ভারতীয় উপমহাদেশে যে প্রাণীটি আনুমানিক চল্লিশ হাজারের আশেপাশে বিচরণ করত, আজ তার সংখ্যা চার হাজারের ও কম। তাও গত দশ পনের বছরে প্রোজেক্ট টাইগারের সাফল্যর ফলাফল এই সংখ্যা। নাহলে ২০০৬ এ সারা ভারতে বাঘের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ১৪১১ তে। ভারতীয় উপমহাদেশে বনের রাজার এই অস্তিত্ব সংকটের সূচনা এবং তার গতিপথের সুলুক সন্ধান করতে গেলে এবার উল্টে নিতে হবে ইতিহাসের কয়েকটি পৃষ্ঠা।

জীবন জীবিকার প্রয়োজনে  এ দেশের মানুষ প্রাচীন যুগে  শিকার, বনজ সম্পদ আহরণ করলেও তা কখনও শোষণের পর্যায়ে যায় নি, বরং অরণ্যের মূল নিবাসী মানুষের সংস্কৃতি, লোকাচার, বিশ্বাসে যুগ যুগ ধরে রয়েছে সংরক্ষণের পরম্পরা।

ভারতীয় উপমহাদেশে বাঘের আগমন নিয়ে ঐতিহাসিক দের মধ্যে মতভেদ থাকলেও অনুমান করা হয় খ্রীষ্টপূর্ব ১২০০০ থেকে ১৪০০০ এর মধ্যে এই উপমহাদেশে প্রথম বাঘের আগমন ঘটে। মধ্যপ্রদেশের  ভিমবেটকায় মেসোলিথিক যুগের গুহাচিত্রে বাঘের ছবি পাওয়া গিয়েছে, গুহাচিত্র টির আনুমানিক বয়স  খ্রিস্টপূর্ব ১২০০০ বছর। তাই অনুমান করা যায় সে সময় এই দেশের অরণ্যভূমিতে বাঘের উপস্থিতি ছিল। বিজ্ঞানী উমা রামকৃষ্ণন এবং দিব্য ধনুষ সিংহদের মতে ভারতে বাঘের আগমন ঘটে সম্ভবতঃ দক্ষিণ চীন সীমান্ত অতিক্রম করে পূর্ব হিমালয়ের পথ ধরে। তারপর প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণ  মহাভারত হোক অথবা ভগবান বুদ্ধের জাতকের কাহিনী, ডোরাকাটার উল্লেখ উঠে এসেছে বারবারই। কালের স্রোত ধরে এই মহামানবের সাগরতীরের সমাজ, ধর্ম, কৃষ্টি, লোকাচার অথবা সাহিত্য শিল্পে মিশে গেছে এই অনিন্দ্যসুন্দর প্রাণীটি। হয়ে উঠেছে  একাধারে ভয়,সম্ভ্রম অন্যদিকে সৌন্দর্য, বীরত্ব ও শৌর্যের প্রতীক। ভারতবর্ষে সহনশীলতার দেশ, সহাবস্থানের দেশ। তাই জীবন জীবিকার প্রয়োজনে  এ দেশের মানুষ প্রাচীন যুগে  শিকার, বনজ সম্পদ আহরণ করলেও তা কখনও শোষণের পর্যায়ে যায় নি, বরং অরণ্যের মূল নিবাসী মানুষের সংস্কৃতি, লোকাচার, বিশ্বাসে যুগ যুগ ধরে রয়েছে সংরক্ষণের পরম্পরা।  প্রাচীন কাল থেকেই এই সংরক্ষণে ও সহাবস্থান ঐতিহ্যের সযত্ন লালনে বেড়ে উঠেছে ভারতের জীববৈচিত্র্য। সমগ্ৰ প্রাণীকুলের মত তার সুফল ভোগ করেছে বাঘও। পূর্ব হিমালয়ের তুষারচ্ছাদিত পর্বতমালা থেকে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য, রাজস্থানের শুষ্ক অঞ্চল থেকে পশ্চিমঘাট পর্বতের বৃষ্টি অরণ্য, উপমহাদেশের প্রায় সকল ভৌগোলিক অঞ্চলেই অবাধ হয়ে উঠেছিল তার  গতিবিধি।

পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় মধ্যযুগে।

সুলতানি  আমল থেকে শিকার আর শুধু প্রয়োজন নয়, তদানীন্তন  অভিজাত রাজপুরুষদের শখ,অবসরযাপন এবং বীরত্ব তথা পৌরুষের প্রতীক হয়ে ওঠে। সুলতানি যুগের ঐতিহাসিক বারাণীর লেখায় তুঘলক সুলতান এবং অভিজাতদের  শিকারের প্রতি আসক্তি এবং  তার বিবরণ পাওয়া যার।  এই শিকারের একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল বাঘ, সিংহ এবং চিতাবাঘের মত  সর্বোচ্চ খাদক  পর্যায়ের প্রাণী।হাসান নিজামীর লেখাতেও দিল্লির সুলতানদের শিকার যাত্রার বর্ণনা রয়েছে। রাজপুতদের চিত্রকর্ম গুলি থেকে রাজপুত রাজাদের শিকার প্রীতির কথা জানা যায়।

বাঘ শিকারের প্রাচীন চিত্র
বাঘ শিকারের প্রাচীন চিত্র

মোঘল যুগের ইতিহাসে এই ধারার কোন পরিবর্তন হয় নি।  আবুল ফজল রচিত আকবরনামা তে মোঘল বাদশা আকবরের শিকার প্রীতির বিবরণ পাওয়া যায়। কথিত আছে তাঁর অধীনে প্রায় এক হাজার  পোষ মানানো চিতা ছিল যাদের শিকারের জন্য ব্যবহার করা হত। আকবরের পুত্র এবং পরবর্তী বাদশা জাহাঙ্গীর ও ছিলেন শিকার অনুরাগী। জাহাঙ্গীরনামার একটি বিবরণ অনুযায়ী তিনি  তাঁর রাজত্বকালে আনুমানিক ৮৬ টি বাঘ শিকার করেছিলেন। এছাড়া জাহাঙ্গীর পত্মী নূরজাহানের চারটি বাঘ শিকারের বর্ণনাও এই বইতে উল্লেখ করা হয়েছে।

কালের নিয়মে বণিকের মানদণ্ড রাজ দণ্ডে পরিণত হলে সূচনা হয় ব্রিটিশ শাসনের। মধ্যযুগের ঢাল তলোয়ার, বল্লমের পরিবর্তে আসে  আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের যুগ। আমূল পরিবর্তন হয় শিকারের পদ্ধতিতেও।অতি সহজে হাতির পিঠে অথবা মাচানে বসে নিরাপদ দূরত্ব থেকে নিখুঁত লক্ষ্যভেদে শিকারের যুগ শুরু হয়। প্রধান লক্ষ্য থাকে একই - বনের রাজা বাঘ।ভারতে ব্রিটিশ দের আগমন এবং বন্দুক সহজলভ্য হয়ে ওঠায় শিকারের ব্যপকতা বহগুণ বৃদ্ধি পায়। আগে যা  রাজা বাদশা বা সমাজের উচ্চ বংশীয়  অভিজাত সমাজের একচেটিয়া বিনোদন ছিল, বন্দুকের কল্যাণে তা ছড়িয়ে পড়ে সমাজের অন্যান্য স্তরেও।দূর প্রবাসে ব্রিটিশ সামরিক অফিসার , বড় ছোট ব্যবসায়ী অথবা সরকারী কর্মকর্তা সকলের ই প্রিয় অবসরযাপন হয়ে ওঠে শিকার বা 'গেম'।

ree

  ব্রিটিশ কর্ণেল নাইটিঙ্গেল ১৮৬০ এর দশকে তিনশোটির বেশি বাঘ শিকার করেন।  প্রায় সমসাময়িক ক্যাপ্টেন ফরসেথ একশোটির ও বেশি বাঘ শিকার করেন। ১৮৭৬ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলস ভারত ভ্রমণকালে একাধিক বাঘ শিকার করেছিলেন, তাঁর সম্মানেই সে বছর ক্যালকাটা প্রেস ক্লাব ভারতীয় বাঘকে 'রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার' নামে অভিহিত করে।  ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত ফরেস্ট অ্যাক্ট দ্বারা ভারতের অরণ্যে ব্রিটিশ সরকারের একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপিত হয়। অরণ্যের মূল নিবাসী দের জল জমি জঙ্গলের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ঔপনিবেশিকতার শিকলে বাঁধা পড়ে ভারতের বন্যজীবন। পাল্লা দিয়ে বাড়ে শিকার। ভারতের বড়লাট লর্ড কার্জন   নিজে একজন খ্যাতনামা বাঘ শিকারি ছিলেন। ১৯১১ সালে  ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জ তাঁর রাজ্যাভিষেককে স্মরণীয় করে তোলার জন্য নেপালের তরাই অরণ্যে শিকার অভিযান করেন। মাত্র দশ দিনের সেই অভিযানে ৩৯ টি বাঘ শিকার করা হয়।

বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ তাঁর শাসনকালে গোয়ালিয়র রাজ্যের শিব পুরীর জঙ্গলে শিকার অভিযানে একদিনে আটটি বাঘের শিকার করেছিলেন। আর এক বড়লাট লর্ড লিনলিথগো ১৯৩৮ সালে নেপালে শিকার সফর করেন এবং ১২০ টিরও বেশি বাঘ শিকার করেন।

স্বাধীন ভারতে বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মানে সরকারি উদ্যোগেও এই ধরনের শিকার সফরের আয়োজন করা হত। এমনকি ভারত সরকারের পর্যটন বিভাগ ১৯৫৮ সালে এই দেশের শিকার পর্যটনকে বিশ্বের মানচিত্রে তুলে ধরার জন্য বহু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যায় করে  'Tiger Shikar in India'  নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করায়।

এই পরিসংখ্যান থেকে মনে করার কোন কারণ নেই যে শুধু মাত্র ব্রিটিশ সাহেবরাই এদেশে বন্যপ্রাণ তথা বাঘের বিপন্নতার জন্য দায়ী ছিলেন। পিছিয়ে ছিলেন না আমাদের দেশীয় রাজা মহারাজা নবাব অভিজাতরাও। সরগুজার মহারাজা তাঁর রাজত্বকালে একাই ১১০০ র বেশি বাঘের শিকার করেছিলেন। জয়পুরের  কর্ণেল কেশরী সিংহ তাঁর জীবনকালে হাজারেরও বেশি বাঘের শিকার করেন।  ১৯২৫ সালে কোটার মহারাজা উমেধ সিংহ (দ্বিতীয়) তাঁর রোলস্ রয়েস গাড়িতে একটি ল্যানটানা  কামান, একটি  মেশিনগান  এবং রাতে শিকারের উপযুক্ত আলো সংযুক্ত করেন এবং সেটিকে তাঁর শিকার বাহন রূপে ব্যবহার করেন। রেওয়ার মহারাজা সিংহাসনে আরোহণ করার পর ১০৯ টি বাঘ শিকার করেছিলেন।আজ আমাদের দেশে যে জাতীয় উদ্যান অথবা ব্যঘ্র প্রকল্পগুলি অবস্থিত তার অধিকাংশই তখন ছিল এই দেশীয় রাজাদের ব্যক্তিগত শিকারের ক্ষেত্র ( private hunting reserve) ।  এই অরণ্যে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও  নিয়মিত রাজারা শিকার সফরে আসতেন।জাঁকজমকে পূর্ণ সেই সব সফরে কখনো ৩০/৪০ টিরও বেশি পোষা হাতি নিয়ে যাওয়া হত। থাকতেন স্থানীয় শিকারি, ভৃত্য  পাচক, পেয়াদা ,বরকন্দাজ সহ বহু লোক লস্কর। বিলাসবহুল অস্থায়ী ক্যাম্পে থাকত অঢেল খাদ্য পানীয়ের আয়োজন। কোন কোন অরণ্যের ভিতরে তো এই ধরনের শিকার সফরের জন্য স্থায়ী শিকার প্রাসাদও ( hunting palace) নির্মাণ করা হয়েছিল।এই সফরে কখনো সঙ্গী হতেন রাজা বা নবাবের বিশেষ  অতিথিরা। কখনো বা ব্রিটিশ বড়লাট অথবা রাজপুরুষদের সম্মানে এ ধরণের শিকার অভিযানের রাজকীয় বিলাসবহুল আয়োজন করা হত। শিকারের পর হতভাগ্য বাঘ অথবা  চিতাবাঘের মৃতদেহের ওপরে বন্দুক হাতে  দাঁড়ানো মহারাজা ও তাঁর সম্মানীয় অথিতিদের ছবি ক্যামেরাবন্দী হত।  আর বাঘের ছাল, স্টাফ করা শরীর স্থান পেত রাজপ্রাসাদের বৈঠকখানায়। কখনো বা সেই সব ট্রফি উপহার হিসেবে  বিশিষ্ট বিদেশি অথিতিদের সঙ্গে  জাহাজে চড়ে যাত্রা করত ইউরোপের পথে।  তারপর মধ্য ভারতের জঙ্গলে নিহত নিরপরাধ কোন বাঘের দেহের ছাল লন্ডনের কোন প্রাসাদ বা ভিলার বৈঠকখানার শোভাবর্ধন করত।ইতিহাসবিদ মহেশ রঙ্গরাজনের মতে ১৮৭৫ সাল থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যে এদেশে  আশি হাজারের বেশি বাঘ শিকার করা হয়েছিল।সম্প্রতি  প্রকাশিত একটি পুরনো সরকারি নথি অনুযায়ী, শুধুমাত্র ১৮৭৮ সালেই সারা ভারতে ১৫৭৯ টি বাঘ শিকার করা হয়েছিল।


 ১৮৭৫ সালে প্রিন্স অব  ওয়েলসের ভারত সফরে এসে বাঘ শিকার
১৮৭৫ সালে প্রিন্স অব ওয়েলসের ভারত সফরে এসে বাঘ শিকার

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে স্বাধীনতার সূর্য উঠলেও দেশের বন্যজীবনে তার প্রভাব পড়ে নি। ভারতের সংবিধান রচনা কালে বন সংরক্ষণকে রাজ্য তালিকায় ঠাঁই দেওয়া হয়। বনবিভাগ গঠিত হলেও সেসময় অরণ্য সৃজন এবং শিকারের পারমিট দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তাদের কার্যক্রম।বিখ্যাত ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞ এবং প্রাক্তন বন আধিকারিক কৈলাশ সাংখালা রচিত  'Tiger!The story of the Indian Tiger'  বই থেকে জানা যায় কিভাবে সেই সময় বন আধিকারিকরা  নিজেরাই যথেচ্ছ  বাঘ শিকারে লিপ্ত হতেন।বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের কোন ধারণা তখনও এদেশের সরকারি মহলেও তৈরী হয় নি। বরং সরকারের অনুমোদন ক্রমে গজিয়ে উঠেছিল অনেক শিকার কোম্পানি।অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই কোম্পানি গুলির মালিক ছিলেন সদ্য রাজত্ব হারানো দেশীয় রাজ রাজড়া নবাব বা তাদের বংশধররা,কখনো কখনো আংশিক মালিকানা থাকত দেশত্যাগী ব্রিটিশ ধনী ব্যবসায়ীদের হাতেও। উচ্চ মূল্যের বিনিময়ে বিক্রি হত শিকারের প্যাকেজ ট্যুর। উপভোক্তারা অধিকাংশই ছিলেন ইউরোপ আমেরিকার ধনী ব্যবসায়ী বা অভিজাত সমাজ। স্বাধীন ভারতে বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মানে সরকারি উদ্যোগেও এই ধরনের শিকার সফরের আয়োজন করা হত। এমনকি ভারত সরকারের পর্যটন বিভাগ ১৯৫৮ সালে এই দেশের শিকার পর্যটনকে বিশ্বের মানচিত্রে তুলে ধরার জন্য বহু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যায় করে  'Tiger Shikar in India'  নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করায়। পরিচালনায় ছিলেন হলিউডের বিখ্যাত পরিচালক এলিস ডুঙ্গন।

ree

দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার যোগান অন্যদিকে বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতির অন্যতম হাতিয়ার হয়ে ওঠে এই শিকার কূটনীতি ( shikar diplomacy)।

স্বাধীন ভারতের নীতি নির্ধারকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল জনগণের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মত মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা। প্রথম দুটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ভারী শিল্প স্থাপনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। শিল্প কারখানা, বহুমুখী নদী পরিকল্পনাগুলি স্থাপন করতে গিয়ে নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করা হয়, নদীর গতিপথ বদলানো হয়,এই তথাকথিত উন্নয়ন  ভারতের বন্যজীবনের ওপর বিষময় প্রভাব ফেলেছিল একথা বলাই বাহুল্য।

পঞ্চাশ ষাটের দশকে পশ্চিমী দুনিয়ার নতুন ফ্যাশন হয়ে উঠেছিল পশুর চামড়ার পোশাক, সবথেকে জনপ্রিয় ছিল বাঘ , চিতা এবং লেপার্ডের চামড়ার তৈরী পোশাক। সেকালের হলিউড তারকা থেকে শুরু করে বিশ্বখ্যাত পপ্  গায়ক সকলেরই পছন্দের তালিকায় উঠে আসে এই ধরনের পোশাক।পশ্চিমী  বাজারের এই চাহিদা মেটাতে উদ্যোগী হয় দেশীয় শিকার কোম্পানি গুলি।তাদের উদ্যোগে

প্যাকেজ ট্যুরের পাশাপাশি বিনা পারমিটে শুরু হয় অবাধ চোরাশিকার। বিখ্যাত পোশাক সংস্থার পাঠানো ফরমাশ অনুযায়ী এদেশের বাঘ, লেপার্ড এবং অন্যান্য প্রাণীর চামড়া অবাধে রপ্তানি হতে থাকে পশ্চিমী দেশগুলিতে। এছাড়া দিল্লী,কলকাতার মত বড় শহরে অবৈধ ভাবে চোরা বাজারেও সহজলভ্য হয়ে উঠেছিল বাঘ, লেপার্ড সহ  বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর চামড়া ও  দেহাংশ।

কলকাতার চোরা বাজারে সে সময় মাত্র এক হাজার ডলারের বিনিময়ে মাথা সমেত একটি আস্ত বাঘের চামড়া পাওয়া যেত।

বাসস্থান ধ্বংস এবং অবাধ শিকার, এই যুগপৎ আক্রমণ সামলাতে পারে নি বনের রাজা। ভারতের অরণ্যে দ্রুত হারে হ্রাস পেতে থাকে বাঘের সংখ্যা। সে সময় বনবিভাগের তরফ থেকে কোন সমীক্ষা অথবা পশু গণনার ব্যবস্থা না থাকায় যা অগোচরেই থেকে যায় সরকারের। ইতিমধ্যে ১৯৬৬ সালে  প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন ইন্দিরা গান্ধী। প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণের প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ। সে সময়েই ভারতের অরণ্যে বাঘের ক্রমহ্রাসমান সংখ্যা নিয়ে নিজ উদ্যোগেই সমীক্ষা করছিলেন কৈলাশ সাংখালা, যিনি  পেশায় ছিলেন একজন বন আধিকারিক। ১৯৬৭ সালে ভারতে বাঘের বিপন্নতা সংক্রান্ত তাঁর একটি প্রবন্ধ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার প্রথম পাতায় স্থান পায়। কি ভাবে দেশে বাঘের সংখ্যা কমছে এবং প্রায় বিলুপ্তির দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে তার বর্ণনা ছিল এই প্রবন্ধের মূল বিষয়বস্তু। প্রবন্ধটি দেশের প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণ প্রেমীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। চোখ এড়ায় নি মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীরও। ১৯৬৯ সালে আই ইউ সি এন এর (IUCN) দশম সাধারণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় নয়াদিল্লিতে। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে কৈলাশ সাংখালা, অ্যান রাইটের মত সংরক্ষণবিদরা এই সভায় যোগদান করেন।

কৈলাস সাংখালা
কৈলাস সাংখালা

কৈলাশ এই সভায়  'Vanishing tigers ' শিরোনামে একটি উপস্থাপনায় ভারতে বাঘের বিপন্নতা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন। তিনি IUCN এর কাছে অনুরোধ জানান, তাদের Red data Book এ বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় ভারতের রয়েল বেঙ্গল বাঘকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। কৈলাশ IUCN এর কাছে ভারতে বাঘ সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্যের আবেদন করেন। কৈলাশের  এই দাবি গৃহীত হয়। IUCN  এর বিপন্ন প্রাণীর লাল তালিকায় স্থান পায় ভারতের বাঘ। সেবছরই প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে  ইন্ডিয়ান বোর্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ (IBWL) বাঘ, লেপার্ডের চোরাশিকার এবং সব ধরনের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের আমদানি রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই সিদ্ধান্ত কে চ্যালেঞ্জ করে দিল্লি হাইকোর্টে মামলা করে ইন্ডিয়ান শিকার আউটফিটার্স অ্যসোসিয়েশন। কিন্তু  ১৯৭১ সালে দিল্লি হাইকোর্টের রায়ে বাঘ, লেপার্ড ,প্যান্থারের চামড়া ও সকল প্রকার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বাণিজ্যের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ১৯৭০ সালে ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত প্রখ্যাত সংরক্ষণবিদ অ্যান রাইট বাঘের চামড়া ও দেহাংশের চোরাকারবার  নিয়ে 'দ্য স্টেটসম্যান' পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। কলকাতার চোরা বাজারে সে সময় মাত্র এক হাজার ডলারের বিনিময়ে মাথা সমেত একটি আস্ত বাঘের চামড়া পাওয়া যেত। প্রবন্ধটি দেশের শিক্ষিত সমাজে  এতটাই আলোড়ন তোলে যে সংসদের বিতর্ক সভাতেও এটি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল।


(চলবে)


লেখক পেশায় প্রশাসনিক আধিকারিক। প্রাণীবিদ্যার ছাত্র ও বন্যপ্রাণী প্রেমী।






ree



Comments


86060474-00b1-415d-8c11-9c4471c9c5e7.png
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG

Editor: Dr. Sumanta Bhattacharya
 

  • Facebook

follow our facebook page to stay updated

© 2021 by Boney Pahare. All rights reserved.

bottom of page