বুদ্ধদেব গুহ'র স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মারোমার বনবাংলো: রাখা হল তাঁর প্রতিকৃতি
পালামৌ টাইগার রিজার্ভের মারোমার বনবাংলো। যার কথা রূপকথার মত ছড়িয়ে আছে বুদ্ধদেব গুহ'র লেখায়, পুরানো আলাপচারিতায়। সেখানে সম্প্রতি বুদ্ধদেব গুহ'র অনুরাগীদের পক্ষ থেকে রেখে আসা হল তাঁর একটি প্রতিকৃতি।
বনেপাহাড়ে ডেস্ক

সদ্য চলে গেলেন বাংলা ভাষার বিশিষ্ট সাহিত্যিক শ্রী বুদ্ধদেব গুহ। একের পর এক উপন্যাস, বড় ও ছোটগল্পে এবং বিভিন্ন প্রবন্ধে জীবনভর তিনি শুধু নিজেই তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেননি বিভিন্ন বয়সের পাঠকের কাছে, মানুষের সামনে বইয়ের জানালা দিয়ে জনপ্রিয় করে তুলেছেন পালামৌ, সিমলিপাল, সাতকোশিয়া, কানহা-পেঞ্চ বা অসমের যমদুয়ারের মত অরণ্যকে। বাঙালী দশকের পর দশক ছুটে গেছে সেই সব অরণ্যকে শুধু চাক্ষুষ দেখতেই না, খ্যাপার মত খুঁজে খুঁজে ফিরেছে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদেরও।শুধু জনপ্রিয়ই নয়, অরণ্য ও বন্যপ্রাণের প্রতি অনুসন্ধিৎসু করে তুলেছে কত মানুষকে তাঁর একের পর এক লেখা। এমনকি বনবিভাগের চাকরিকেই পাথেয় করেছেন তাদের অনেকেই। এটাই হয়ত একজন লেখকের 'লার্জার দ্যন লাইফ' ইমেজ তৈরি করে দেয় অজস্র সাহিত্য অনুরাগীর মধ্যে। বাংলা ভাষায় যার আর কোন বিকল্প নেই।

পুরাতন সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি একটি কুসুম গাছের ওপর 'কুসমি' ট্রি-হাউসের ছবি। যার নামকরন লেখক করেছিলেন কনজার্ভেটার কাজমি সাহেবের অনুরোধে। পরবর্তীতে মাওবাদিদের বাহিনীর হাতে এটি পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়।

বর্তমানে সেই স্হানেই নির্মিত নতুন একটি কংক্রিটের ট্রি-হাউস।
সেই কবে ৮০ এর দশকে বেতলা ন্যাশানাল পার্কের বিশিষ্ট বনাধিকারিক ও বর্তমানে পালামৌ টাইগার রিজার্ভের গভর্নিং বডির সদস্য শ্রী সঙ্গম লাহিড়ী লেখককে বলেছিলেন, "বেতলাতে যত ট্যুরিস্ট আসেন, তার বেশির ভাগই বাঙালী। আমরা একটা কোশ্চেনেয়ার তাদের প্রত্যেককে হ্যান্ড -আউট করেছিলাম। তাঁদের মধ্য নাইন্টি পার্সেন্ট উত্তরে লিখেছেন যে আপনার বই এবং বিশেষ করে 'কোয়েলের কাছে' পড়েই তাঁরা এখানে এসেছেন।"

এবং সেই ট্রাডিশান সমানে চলিতেছে, ওয়াজেদ আলির কথা ধার করে বলতে হয়। আজও বহু পাঠক চাক্ষুষ না দেখলেও তাঁর লেখার কালিতেই খুঁজে পায় সেইসব স্হানকে। এমনই এক স্হান দক্ষিণ পালামৌ টাইগার রিজার্ভের গারু রেঞ্জের মারোমার বনবাংলো। অমর হয়ে আছে তা বুদ্ধদেব গুহর কলমে 'ভালুমার' নামে কোজাগর বা কোয়েলের কাছের মত উপন্যাসে। এই বাংলো বড় প্রিয় ছিল লেখকের। বাংলোর হাতা থেকে দেখতে পাওয়া হুলুক পাহাড়ের সবুজ-নীল অবয়ব উস্কে দিয়েছে তাঁর কত কল্পনাকেই। তাঁর পুরানো দিনের সঙ্গীরা আজও রোমন্থন করেন সেই বাংলোয় লেখকের সাথে বারবার ফিরে যাওয়ার স্মৃতি। কত আড্ডা, গল্প, গানের স্মৃতি ছড়িয়ে সেখানে আজও মারোমারের লাল মাটিতে।

সেই বনবাংলোয় কিছুদিন আগেই, ১২.০৯.২১ তারিখে তাঁর একটি প্রতিকৃতি রাখা হল সামনের সেই অলিন্দে। বনেপাহাড়ে ওয়েবজিনের সম্পাদক সুমন্ত ভট্টাচার্য্যের উপস্হিতিতে পুরো কাজটি সম্পন্ন করেন মারোমার বনবাংলোর কর্মচারীরা। বুদ্ধদেব গুহ'র সকল পাঠক ও অনুরাগীদের পক্ষ থেকে এই কাজে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য পালামৌ সাউথ ডিভিশানের ডি এফ ও এবং ঝাড়খন্ডের সংরক্ষণবিদ রাজা কাজমির। মারোমার ও বেতলায় গুহসাহবের স্মৃতিতে আরোও কিছু করার ভাবনা তাঁদের রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।


সবার প্রিয় লালসাহেবের পা আর তাঁর ভালবাসার মাটিতে পড়বে না হয়ত। তবে মনে মনে আমরা জানি যতদিন এই অরণ্যকে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারব, যতদিন বাংলাভাষায় চলবে সাহিত্যচর্চা- ততদিন তিনি অমর হয়ে থাকবেন এইসব স্হানের নদী, পাহাড়ে, অরণ্যে, রাতের অন্ধকারে জোনাকির আলোয়। মারোমারের বাংলোর বারান্দা থেকে ঋতুবদল দেখবেন হুলুক পাহাড়ের বুকে।
"বনের রঙ জলের রঙ সন্ধ্যার রঙ মেঘের রঙ সব মিলেমিশে একাকার হয়ে চতুর্দিকে নরম সবুজে হলুদে সাদায় এমন একটি অস্পষ্ট ছবির সৃষ্টি হল, আমার বড় সাধ হল যে আবার আমার মায়ের গর্ভে ফিরে গিয়ে নতুন করে জন্মাই। নতুন করে ছোটবেলা থেকে এই রুমান্ডিতে একটি ওঁরাও ছেলের মতো বাঁশি বাজিয়ে বড় হবার অভিজ্ঞতা, বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা, মোষের পিঠে চড়ে তিল তিল করে নতুন করে উপভোগ করি।" (কোয়েলের কাছে)

ছবি: ডা: কৌশিক লাহিড়ী, শ্রী অনির্বান গাঙ্গুলি, ডা: সুমন্ত ভট্টাচার্য্য।
বনেপাহাড়ে- বাংলায় প্রথম বন্যপ্রাণ ও পরিবেশ বিষয়ক ওয়েবজিন।
Click here to join us at Facebook. LIKE and Follow our page for more updates.
