নেকড়ে, স্ট্রাইপড হায়না জাতীয় প্রাণীদের সংরক্ষণের কাজ হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন স্হানে যার খবর বনেপাহাড়ে'র পাতায় আগেই প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু বাংলাতেও বিভিন্ন স্হানে এমন সব প্রাণী ছড়িয়ে রয়েছে তাদের জন্য কতটা ভাবছি আমরা? দুর্গাপুরের অদূরে রাঢ়বঙ্গের ছোট ছোট যে বনভূমি রয়েছে সেখানকার নেকড়েদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন ক্রমশ বন-জঙ্গল কমে আসায় ও বাড়তে থাকা কয়লাখনির দাপটে। দুর্গাপুর এলাকার এই canid গোত্রের প্রাণীদের সম্পর্কে জানালেন অর্নিশ বসু।
সেটা ২০১৪ সাল।আমার প্রথম নেকড়ে'র (Indian Grey Wolf) সম্মুখীন হওয়া। ঠিক রাস্তা পার করে দুটো নেকড়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। জায়গাটা দুর্গাপুর থেকে ২০-২৫কিমি. দূর মাধাইগঞ্জ-লাউদহা বলে একটা এলাকায়। আমার তখন উখড়া ইলেক্ট্রিক অফিসে পোস্টিং । সেই প্রথম দেখা থেকেই শুরু হল আমাদের (আমার তখন থেকে নেকড়ে খোজার সাথী ছিল প্রাণবন্ধু চ্যাটার্জি ওরফে ছত্তু) নেকড়ে'র খোঁজে অভিযান ।
লাউদহা থেকে প্রায়ই নেকড়ে'র খোঁজে বেরিয়ে পরতাম। এখানে স্হানীয় মানুষ নেকড়েকে বলে হুরাল। লাউদহা'র কাছাকাছি বড় এলাকা জুড়ে ঝোপ-জঙ্গল , ঘাসবন আর শাল গাছের জঙ্গল, যেইটা গড়ের জঙ্গলের সাথে যুক্ত। এই বন-জঙ্গল শেয়াল আর black naped hare'র জন্যও ভাল বাসভূমি । নেকড়ে র খোঁজ করতে গিয়ে এনাদের সাথে বহুবার সাক্ষাৎ হয়েছে। তবে শিকার উৎসব আর বন-জঙ্গল নষ্ট করে ফেলার জন্য আস্তে আস্তে Bengal fox আর black naped hare এর সংখ্যা খুব এই কমে গেছে এখানে। আরও জানতে পারলাম যে জঙ্গলে খাদ্যের অভাবের জন্য নেকড়েরা পাশের আদিবাসী গ্রাম থেকে ছাগল আর বাছুর তুলে নিয়ে যায় মাঝে মধ্যেই, যে কারণে গ্রামবাসীদের মধ্যে অনেক ক্ষোভ আছে ।
এমন বন জঙ্গলেই বাস ওদের
২০১৪-১৫ অব্ধি ৭-৮ টা একসাথে নেকড়ের দলের দেখা পেয়েছি কিন্তু ২০১৯-২০২০ এ শুধু ৩টে- ৪টে একসাথে দেখা যেত। সাথে ২০২০ র মার্চে খবর এল যে স্থানীয় গ্রামবাসী দের হাতে নেকড়ের বাচ্চার মৃত্যুর, যেটার কারণ ছিল নেকড়েদের ছাগল শিকার করা। কিন্তু ছবির অভাবে এই এলাকাতে যে নেকড়ে আছে সেটা বন বিভাগ কে বিশ্বাস করানোটাই খুব মুশকিল হয়ে উঠছিল। শেষ-মেষ ২০২১ এ ছবি ওঠানো সম্ভব হল। ছবি গুলো বন দপ্তরের আধিকারিকদের দেখানর পর তারাও নেকড়েদের বাঁচানোর উদ্যোগ নিয়েছেন । শিকার উৎসবের বিরুদ্ধে সচেতনতা প্রচার করে ভালই সাড়া পাওয়া গেছে। বছরের প্রথম দিন প্রথম নেকড়ের ছবির পর (Alpha Female), ৮টা আলাদা পৃথক নেকড়ের ছবি পাওয়া গেছে , তার মধ্যে ২টি sub-adult-ও আছে।
প্রাকৃতিক খাদ্য (natural pray base) যেসব প্রাণী তারা এখানে না থাকার জন্য , নেকড়েদের খাদ্যর জন্য পুরোটাই নির্ভর করতে হয়ে গ্রামবাসীদের ছাগল আর গরুদের উপর। ক্ষতিপূরণের ব্যবস্হা না করা হলে, নেকড়ে আর গ্রামবাসীদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্হান হওয়া খুবই মুশকিল। জঙ্গল ঘিরে চারিদিকে কয়লা খনি চালু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বাড়ছে তাদের এলাকা। এই কয়লা খনির জন্য নেকড়েদের বাসস্হান আর কতদিন টিকে থাকবে এইটাই বড় প্রশ্ন ! আশেপাশের অরণ্য অঞ্চলের সাথে যোগাযোগের করিডরগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এই কয়লা খনির জন্য নেকড়েদের জঙ্গল আর কতদিন টিকে থাকবে এইটাই বড় প্রশ্ন !
এখানে অনেক রকমের raptors , শজারু , মদনটাক ও আরও অনেক প্রজাতির বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে। বলাই বাহুল্য যে এই প্রাকৃতিক বাসস্হানের সুরক্ষিত থাকা খুবই দরকার। তার সাথে সাথে আদিবাসী গ্রামগুলোতে সচেতনতামূলক প্রচার প্রয়োজন। তবেই নেকড়েদের বাঁচানো সম্ভব।
লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় প্রযুক্তিবিদ । বন্যপ্রাণী নিয়ে উৎসাহী ।
ছবি: লেখক।
Comments