top of page
..

মহুয়ার নেশা, মহুয়ার অর্থনীতি ও সংকট

মহুয়া ফুল থেকে তৈরি মহুয়ার মদ শুধু একটা নেশাই নয়। তা জড়িত ভারতের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের আদিবাসী মানুষের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির সঙ্গে। কিভাবে তৈরি হয় এই পানীয়? কেমন ভাবে পাল্টে যাচ্ছে এর উৎপাদন! সংকট ঘনীভূত হচ্ছে মহুয়া গাছেদের জন্য। বিশ্লেষণে অভিজিৎ দে ও জয়দীপ চক্রবর্তী।


মহুয়া ফুল। ছবি: বনেপাহাড়ে।

মার্চের শেষ দিক। এই সময় মধ্য ভারত ও ছোটনাগপুর মালভূমির পর্ণমোচী বনাঞ্চলে মহুয়া ফুল আসার সময়। হালকা হলুদ রঙের মহুয়া ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভারী হয়ে আসে বাতাস এসময়ে। মহুয়া গাছের (Madhuca longifolia) তলা গালিচার মত ঢাকা থাকে ফুলে।

 মহুয়া একটি বনজ সম্পদ। মঙ্গল ঘটুল আর স্ত্রী পূর্ণিমা পুরুলিয়ার দিগারদি গ্রামের বাসিন্দা। পুরুলিয়া হল এই মালভূমি অঞ্চলের পূর্ব প্রান্তে। মঙ্গলের রয়েছে চারটি মহুয়া গাছ। মহুয়া গাছ তাদের জীবনধারণের একটা বড় অবলম্বন। তার ভাইদের রয়েছে আরও কয়েকটি এমন আছ। বছরের এই সময়ে মহুয়া ফুল সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন তারা। প্রতিটি পরিণত গাছ গড়ে ৬০ থেকে ৮০ কিলো মহুয়া ফুল দেয়।

 ঘটুলরা এই বছর অখুশি। তাদের সারাদিন লেগে গেছে ফুল কুড়াতে। “ আমরা সাধারণত: ভোর ৪টায় ফুল কুড়াতে শুরু করি। বেলা ১০টা বা ১১টায় আমাদের কাজ প্রায় সারা হয়ে যায়। কিন্তু এই বছর দুপুর পার হয়ে গেলেও সেটা হয়নি। অসময়ের বৃষ্টি নষ্ট করে দিচ্ছে মহুয়া। বেশি খেটেও কম জিনিস পাচ্ছি”, মঙ্গল বলছিলেন।

 অসময়ের বৃষ্টিতে তাপমাত্রা কমে আসে, আর্দ্র থাকে বাতাস। ফলে ফুল বেশিক্ষণ গাছে থাকে। সারাদিন ধরে পড়তে থাকে যেটা স্বাভাবিক নয়। যদি রোদ থাকে, তবে ফুলগুলো বেলা ১০টার মধ্যে তাড়াতাড়ি ঝরে যায়। এই ধরনের হঠাৎ মাঝেমধ্যে বৃষ্টিতে যারা মহুয়া কুড়ায়, তাদের কাজ বেড়ে যায়।

 সংগ্রহের পর ফুলগুলিকে তিন থেকে পাঁচ দিন রোদে শুকাতে হয় ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখার আগে বা বিক্রির আগে। ভেজা থাকলে ওরা পচে যায়। শুকনো ফুলের বিকিকিনি সারা বছর হয়। তাই বৃষ্টি হলেও তারা ফুলগুলি বিছিয়ে রাখে মাটিতে শুকানোর উদ্দেশ্যে। তবে নজর রাখতে হয়। তবে বারবার তুলে নেওয়া , আবার শুকোতে দেওয়ায় ফুলের মান নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়াও যে শ্রম লাগছে অতিরিক্ত, তার দাম ওঠানোও সম্ভব হয় না।


মহুয়া ফুল শুকানো। ছবি: অভিজিৎ দে।

“ বৃষ্টির ফোঁটা ফুলর উপর দাগ ফেলে দিচ্ছে। ফলে বাজারে ভাল দাম পাওয়া সম্ভব না এই বছর”, পূর্ণিমা জানালেন।

 ছোটনাগপুর মালভূমির পূর্বাংশ জুড়েই মঙ্গলদের কথার প্রতিধ্বনি। তা ঝাড়খণ্ডের পূর্বভাগে হোক বা পুরুলিয়া বা ঝাড়গ্রামে। এইসব অঞ্চলেই গত মহুয়া উৎপাদনের ঋতুতে অসময়ের বৃষ্টি হয়েছিল মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলে।

 এইসব অঞ্চলে মহুয়ার দাম ক্রমশ কমছে। কিন্তু গত মরশুমে তা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছায়। ২০২১ এ শুকনো ফুল সংগ্রাহকরা ৬৫-৭০ টাকা কিলোপ্রতি বিক্রি করেন, ২০২২ এ তা দাঁড়ায় ৪০-৬০ টাকায়। আর ২০২৩ এ মাত্র ২০-২২ টাকা প্রতি কিলো।

  বৃষ্টির জন্য মহুয়ার মান পড়ে যাওয়া গল্পের একটা অংশ। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের মতে আসল সমস্যা তো ভেজাল।


ভেজাল মদে ধ্বস্ত মহুয়া নির্ভর অর্থনীতি


মহুয়া এইসব এলাকায় আদিবাসী ও অনাদিবাসী মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস। মহুয়া থেকে তৈরি মদই যদিও প্রধান উৎপাদন, কিন্তু বিভিন্ন রূপেই এই ফুলের ব্যবহার আছে। যেমন মহুল সিকা বলে একটি মিষ্টি মিষ্টি রসালো পদ খুব জনপ্রিয়। বা লাঠ্ঠা বলে মহুয়া থেকে তৈরি মিষ্টি। বা সেদ্ধ মহুয়া আচার আর ভাত দিয়ে মেখে খাওয়া।

 কিন্তু মহুয়ার বড় অংশটাই যায় মদ তৈরিতে। এটা স্থানীয় আদিবাসী সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাচ্চার জন্ম হোক কি বিয়ে, কোন উৎসবই মহুয়া পানীয় ছাড়া অসম্পূর্ণ। এছাড়াও আমোদপ্রমোদে এর ব্যবহার তো আছেই। তাই মহুয়া এখানে জীবন ও অর্থনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।


পুরুলিয়ার গ্রামে গাছের তলায় মহুয়া ফুলের পড়ে থাকা। ছবি: অভিজিৎ দে।

 কিন্তু প্রাকৃতিক উপাদানর বদলে কৃত্রিম রাসায়নিকের ব্যবহার হচ্ছে দ্রুত ফললাভের জন্য। এটা কিন্তু প্রথাগত পদ্ধতির বিরোধী। ষাটোর্ধ লাল সিং সরদার কে গ্রামের সবাই ভালবেসে লাল খুড়ো বলে ডাকে। তিনি বলছিলেন, "মহুয়া বানানোর জন্য আমরা রানুর ব্যবহার করতাম। রানু হল গাছের শিকড় ও ছাল-বাকলের মিশ্রণ। তারপরে ব্যবহার হতে শুরু হল গুড়ের। তারপরে এখন তো বাজে মানের গুড় আর রাসায়নিকের ব্যবহার হচ্ছে মহুয়া গেঁজিয়ে তুলতে। অল্প কিছু ফুল দিয়ে দেয় গন্ধ আনার জন্য।" হিমন প্রামাণিক যিনি একজন পাইকার-অর্থাৎ মহুয়া কেনাবেচা করেন তিনিও বলছিলেন যে, মদ উৎপাদকরা খুব অল্পই ফুল কেনে এখন।


মহুয়া বানানো এখন একটা হারিয়ে যাওয়া শিল্প


দক্ষ মহুয়ার মদ বাননোর কারিগর হরি সোরেন বলছিলেন যে, এই মদ তৈরি একটা শিল্প যা দক্ষ হাতে বানাতে হয়। তাঁর মত একজন দক্ষ কারিগরই বুঝতে পারবেন fermentation বা গেঁজিয়ে ওঠার মৃদু শব্দ, যা প্রথাগত শিক্ষার মত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত হয়। তাঁর আক্ষেপ যে এখনকার নির্মাতার এসব শিখতে আগ্রহী নন।

 শুকু মান্ডি একজন কমবয়েসি মদ উৎপাদক। তার কথা মত, "পুরাতন পদ্ধতিতে কম পরিমাণে মদ তৈরি হয় আর সময় নেয় ৭-৮ দিন। বেশি বেশি গুড় আর রাসায়নিক এই কাজটা তাড়াতাড়ি করে দেয়। কেউ আর শুদ্ধ মহুয়ার খোঁজে নেই। যে কোন নেশার জিনিস যা তাড়াতাড়ি নেশা করাবে- খরিদ্দাররা সেটাই চায়।"

 গ্রামের প্রবীণদের মতে, প্রথাগত পদ্ধতিতে তৈরি মহুয়া পরিমাণ মত পান করলে শরীরের কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু এই ভেজাল মেশানো মহুয়া আসলে শরীরের ক্ষতি করে।

 এই ভাবে মহুয়া ফুলের চাহিদা কমে যাওয়ায় মহুয়া গাছই বিপন্ন হয়ে পড়ছে এইসব এলাকায়। পবিত্র হিসাবে গণ্য এইসব গাছ মূলত: ব্যক্তিগত জমিতে বা কৃষিজমির আশপাশে পাওয়া যায়। কিছু কিছু গ্রামবাসী এদের কাঠের জন্য বিক্রি করে দেবার কথাও ভাবছেন। পূর্ব ঝাড়খণ্ডের সিরাম গ্রামের বয়স্ক মানুষ মঙ্গল হাঁসদা বলেন, " যদি দেবতা আমাদের ক্ষুধা না মিটাতে পারে, তাকে পুজো করে কি লাভ আমাদের!" কিন্তু মহুয়া গাছের কমে যাওয়া স্থানীয় অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রে ও জীববৈচিত্রে গভীর প্রভাব ফেলবে।


 অন্যান্য রাজ্যে মহুয়া নির্ভর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে


কিন্তু দেশের এই অংশ কিন্তু অন্যান্য রাজ্য যেমন মধ্য প্রদেশ বা ছত্তিশগড়ের থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে, যেখানে এই মহুয়ার উপরে নির্ভরশীল অর্থনীতি নতুন নতুন পথ খুঁজে পাচ্ছে। মধ্য প্রদেশ সরকার ২০২২ সালে মহুয়া থেকে তৈরি মদকে “ঐতিহ্যশালী পানীয়” বলে ঘোষণা করেছে। এটা তৈরির দায়িত্ব পুরোপুরি দক্ষ প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত কারিগরদের হাতে সমর্পণ করেছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে আদিবাসীদের তাদের প্রথাগত সংস্কৃতি থেকে অর্থ আয়ের পথ সুগম হয়েছে।

 মদ ছাড়াও মহুয়া দিয়ে তেরি অন্যান্য জিনিসও অনাদিবাসী ক্রেতাদের জন্য তৈরি করতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। ছত্তিশগড় সরকার মহিলাদের স্ব-নির্ভর গোষ্ঠীদের তৈরি লাড্ডু, কুকিজ বা হালুয়া তৈরি করে বিক্রিতে উৎসাহ দিচ্ছে।


মহুয়া গাছ: মন এক এক টি গাছ অনেক পরিমাণে ফুল দেয়। ছবি: বনেপাহাড়ে

 যদিও বিভিন্ন সরকারের এইসব সক্রিয়তার পরেও মহুয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার আইন এখনও অস্বচ্ছ। ব্রিটিশরা সেই ১৮৮০ র দশকে বম্বে আবগারি আইন , ১৮৭৮ ও মোহরা আইন , ১৮৯২ দিয়ে মহুয়া সংগ্রহ ও মদ তৈরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। যদিও এই স্বাধীন ভারতে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় বিভিন্ন রাজ্যের আবগারি আইন আলাদা। তাই ঝাড়খণ্ডের মত রাজ্যে মহুয়া সংগ্রহ, জমিয়ে রাখা, বেচাকেনা ও মদ্য উৎপাদন অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত।

 ডেমন্ড নাজারেথ ও কনরাড ব্রাগাঞ্জা এই বিধিনিষেধ যারা বাণিজ্যিকভাবে মহুয়া বিপণন করছেন ২০১৮ থেকে, এইসব নিয়ম কানুন কাছ থেকে দেখেছেন। আবগার আইনের তারতম্যে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে মহুয়া নিয়ে যাওয়া একটা কঠিন সমস্যা। ফরে কাঁচামাল পেতে বেশ সমস্যা হয়। মহুয়া থেকে তৈরি মদ একটি দেশজ সামগ্রী হলেও অন্ধ্র প্রদেশ সরকার তাদের এটিকে Indian-made foreign liquor (IMFL) বলে তৈরি করতে অনুমতি দিয়েছে। তাঁরা মনে করেন, নীতিতে স্বচ্ছতা আসলে তা সংশ্লিষ্ট সব লোকের পক্ষে উপকারী হবে আর প্রাচীন এই পেশাকে বেঁচে তাকতে সহায়ক হবে।




লেখক পরিচিতি:

 অভিজিৎ দে বর্তমানে Ashoka Trust for Research in Ecology and the Environment (ATREE) তে আদিবাসী-মহুয়া সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করছেন তাঁর Ph.D. (Conservation Science and Sustainability Studies) এর অংশ হিসাবে। জয়দীপ চক্রবর্তী একজন প্রশিক্ষিত পর্বতারোহী যিনি ছোটনাগপুর মালভূমির জীববৈচিত্র ও এর সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করছেন।


মূল প্রবন্ধটি Mongabayপত্রিকায় প্রকাশিত। ইংলিশ প্রবন্ধটির অনুমতিক্রমে অনুবাদ করা হল বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য। মূল প্রবন্ধটির লিঙ্ক: https://india.mongabay.com/2023/11/commentary-erratic-weather-altered-social-dynamics-disrupt-mahua-economy-in-eastern-india/


  

 

146 views0 comments

Comments


Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page