সাম্প্রতিক সময়ে কন্নড় ছায়াছবি 'কান্টারা' য় বন্য বরাহের সাথ স্থানীয় মানুষের সম্পর্কের এক আশ্চর্য গল্প উঠে এসেছিল। অথচ দেশের বড় একটা অংশে বন্য শূকরদের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত মানুষজন। ভারতীয় সমাজজীবনে, সংস্কৃতিতে এই বিশ্রী দর্শন প্রাণীদের অবস্থান, বনের বাস্তুতন্ত্রে তাদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনায় ড: ঐশিমায়া সেন নাগ।
ভারতের বন্য শূকরদের সাধারণত: উঁচু নজরে দেখা হয় না। অথচ তারাও কিন্তু তাদের শক্তি, প্রাণচঞ্চলতায় কম যায় না। এমনকি তাদের দাঁতের তীক্ষ্ন আঘাতে বাঘের মত শক্তিশলী জন্তুর নাড়িভুড়িও ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে। এই লড়াকু প্রাণীরা যুগ যুগ ধরে লড়াই করে টিকে থেকেছে। কিন্তু বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষত: কৃষকদের সাথে তৈরি হচ্ছে মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাতের ক্ষেত্র। অরণ্য সংলগ্ন স্থানে মানুষের কাজকর্ম বৃদ্ধি পাওয়ায়, কৃষিজমিতে বুনো শুয়োরদের ফসলের লোভে আক্রমণ বেড়ে গেছে। ফলে জীবন জীবিকায় প্রভাব পড়ছে একটা অংশের মানুষের। তবে বর্তমানে যেমন এদের নাম গালিগালাজ হিসাবে ব্যবহার হয়,ভারতের বহু রাজ্যেই এদের ‘ক্ষতিকারক’ ঘোষণা করে মারার দাবি ওঠে- বরাবর কিন্তু তা ছিল না। বন্য শূকরদের ভারতীয় সমাজে সমীহের সাথেই স্মরণ করা হত। তাদের শুধু শ্রদ্ধার চোখেই দেখা হত না, অনেক জায়গায় তারা রীতিমত পুজো পেত। কোথাও বিষ্ণুর বরাহ অবতার রূপে, কোথাও বা টুলু সম্প্রদায়ের কাছে পাঞ্জরলি দেব হিসাবে (যেমন দেখানো হয়েছে কন্নড় ছবি ‘কান্টারা’য়)। তাই শুধু বন্যজীব হিসাবে বাস্তুতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকাতেই নয়, ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতিতেও তাদের বড় ভূমিকা ছিল।
ভারতীয় বন্য শূকর অর্থাৎ, Indian wild boar (Sus scrofa cristatus) যা বন্যশূকরদের একটি গুরুত্বপূর্ণ subspecies তাদের সহজেই চেনা যায় শরীরের পিঠ বরাবর খাড়া রোমের দ্বারা। সারা দেশেই এদের পাওয়া যায়। এদের গালে ও চোয়ালেও যে বড় রোম থাকে তা এদের চেহারায় একটি বিশিষ্ট রূপ দেয়। ছোটখাটো চেহারা সত্ত্বেও এদের বিপুল শক্তির কারণ এদের ওজন যা প্রায় ১০০ কিলোগ্রামের উপর।পাঁচ ফুটের মত হয় এদের দৈর্ঘ আর কাঁধ হয় তিন ফুট চওড়া।
এদের খাদ্যাভ্যাসই হয়ত এদের টিকে থাকার কারণ। এরা সর্বভূক। প্রাণীজ ও উদ্ভিজ - সব রকম খাদ্য এরা খেয়ে থাকে। ভারতের অরণ্যে এরা নিজেরা আবার বাঘদের জন্য খুব প্রিয় খাবার। কিন্তু বাঘকেও এদের শিকার করতে অনেক ঘাম ঝরাতে হয়, কখনও এমনকি প্রাণও হারাতে হয়।
বুনো শুয়োরদের নিয়ে বেশি কিছু গবেষণা হয়নি। এদের অরণ্যের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে দেখা হয়, মূলত: বাঘের মত জন্তুর খাবার হিসাবে। কিন্তু এটুকু অন্তত জানা আছে এদের হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। মানুষের উপর আক্রমণ করলে তাদের ধারালো দাঁতের আঘাতে প্রাণ যাবার সমূহ সম্ভাবনা। সম্প্রতি, ছত্তিশগড়ে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। এক মহিলা তাঁর ১১ বছরের মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে বন্য শূকরের আক্রমণে মারা যায়। অবশ্য তার কুঠারের আঘাতে শূকরটিও মারা যায়। দু’জনেই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যদিও এমন ঘটনা বেশ বিরল। তবে বন্য শূকরের আক্রমণে ফসলের ক্ষতি আকছাড় ঘটছে।
বন্যজীব না ক্ষতিকারক প্রাণী?
সম্প্রতি সময়ে সংবাদমাধ্যমে বন্য বরাহের কথা অনেকবার উঠে এসেছে। যদিও তা ভাল কোন কারণে নয়। বিভিন্ন রাজ্যেই কৃষকরা আভিযোগ করছেন এদের দ্বারা তাদের ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। অনেকেই দাবি করছে এদের Vermin বা ক্ষতিকারক প্রাণী ঘোষনা করা হোক, এদের মারবার অনুমতি দেওয়া হোক। বিষয়টি বেশ বিতর্কিত। কিছু বিশেষজ্ঞ এতে সায় দিচ্ছেন, আবার অনেকেই তীব্র বিরোধিতা করছেন। যারা সায় দিচ্ছেন তাদের মতে, বন্য শূকরদের মারলে কৃষকদের ক্ষতি কম হবে ও বন বিভাগের সাথে তাদের সম্পর্ক ভাল হবে। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন এই license to kill এর অপব্যবহার হবে এবং এতে শুধু বন্য শূকর নয়, এমনকি অন্য বন্যপ্রাণী শিকারের সম্ভাবনা তৈরি হবে। এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে যেখানে বেআইনিভাবে গ্রামবাসী বা চোরশিকারিদের পাতা বন্য শূকর ধরার ফাঁদ বা বিদ্যুৎবাহী তার বাঘসহ নানা বন্যপ্রাণীর মৃত্যুর কারণ হয়েছে। তাই বন্য শূকর মারার অবাধ অনুমতি থাকলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন তা বন্যপ্রাণ ও বাস্তুতন্ত্রের অনেক কিছু ক্ষতি করবে।
বন্য শূকররা যে ফসলের ক্ষতি করছে তার বড় একটি কারণ হল অরণ্যের নির্বিচার ধ্বংস। আবাস ও প্রাকৃতিক খাদ্য কমে আসায় এই প্রাণীরা মানুষের বসবাসের স্থানে চলে আসে খাবারের সন্ধানে। বন এলাকার আশেপাশে জঞ্জাল ফেলে রাখলে তাও এদের আকৃষ্ট করে।
জলবায়ু পরিবর্তনও এদের উপরে প্রভাব ফেলছে। যেমন বিগত বছরগুলোয় কাশ্মীরেও এদের দেখা যাচ্ছে। ঊনবিশ শতকে এখানকার এক রাজা এদের নিয়ে আসে শিকারের জন্য। কিন্তু ১৯৮০’র দশকেই এদের অবলুপ্তি ঘটে গেছিল। এদের সংখ্যা বাড়ানোর কোন উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। কিন্তু মনে করা হচ্ছে এই অঞ্চলে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এদের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে এরা ফসলের ক্ষতি তো করছেই এমনকি রাজ্যপ্রাণী অতি বিপন্নগোষ্ঠীভুক্ত হরিণ- হাঙ্গুলের খাদ্যের সংকট তৈরি করছে।
এদের দাঁত দিয়ে ফসল উপড়ে ফেলার যে কারণে এদের ক্ষতিকারক মনে করা হয়, মেরে ফেলা হয়, অদ্ভুতভাবে, সেই দাঁতের জন্য ও উচ্চ জন্মহারের জন্য এদের প্রাচীন ভারতে কৃষিসংস্কৃতি ও উর্বরাশক্তির প্রতীক বলে গণ্য করা হত।
ধর্ম ও উপাসনা
সাম্প্রতিক সময়ে কন্নড় ভাষায় নির্মিত রোহিত শেট্টির সিনেমা ‘কান্টারা’ বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তার ভারতর বিভিন্ন ভাষায় ডাবিং হয়েছে, দেশে-বিদেশে হইহই করে চলেছে। চলচ্চিত্রের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে ‘পাঞ্জরলি’ নামের স্থানীয় টুলু ভাষাভাষি আদিবাসী সম্প্রদায়ের দেবতাকে ঘিরে। এই সম্প্রদায় থাকে কর্ণাটকের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল বরাবর। স্থানীয় ভাষায় পাঞ্জরলি শব্দটির অর্থ হল বন্যবরাহ। এই দেবতার সাথে অনেক লোককথা জড়িয়ে রয়েছে এখানে।
এই উপসনা কিভাবে শুরু তা সম্পূর্ণ বোঝা না গেলেও, মনে করা হয় তা আসলে বন্যবরাহের শস্য ধ্বংস করার যে ক্ষমতা, তা থেকে তাকে নিবৃত্ত করতেই তাকে এইভাবে তুষ্ট করার একটা প্রক্রিয়া। হিন্দু ধর্মের মূল ধারাতেও পাঞ্জরলির অস্তিত্ব মিশে গেছে। লোককথা অনুযায়ী, দেবী পার্বতীর একটি ছোট বন্য বরাহ পোষ্য হিসাবে ছিল। কিন্তু সে ছিল খুব দুষ্টু আর ভগবান শিবের বাগান তছনছ করে দেয়। তার ব্যবহারে রেগে গিয়ে শিব সেটিক মেরে ফেলতে চান, কিন্তু পার্বতী এসে অনুরোধ করেন তা না করতে। শিব তখন তাকে না মেরে বলেন মর্ত্যে চলে যেতে এবং সেখানে মানুষজনকে রক্ষা করতে পাঞ্জরলি দেব রূপে।
তবে এই পাঞ্জরলিদেব রূপেই শুধু বন্য বরাহের আরাধনা সীমিত নয়। ২০২২ সালে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া মধ্য প্রদেশের বান্ধবগড়ে একটি বরাহ দেবতার মূর্তি আবিষ্কার করেন যার আনুমানিক নির্মানকাল খ্রীষ্টিয় নবম থেকে একাদশ শতক। এটিকে বিশ্বে সবথেকে বড় বরাহদেবতার মূর্তি বলে মনে করা হচ্ছে।
হিন্দু পুরান অনুযায়ী, ভগবান বিষ্ণুর একটি অবতার হল বরাহদেব। এই রূপে তিনি দানব হিরণাক্ষ্য কে বধ করেন, যিনি মহাজাগতিক সমুদ্রের তলদশে পৃথিবীকে লুকিয় ফেলেছিলেন। দৈত্য বধ করার পর নিজের দাঁত দিয়ে পৃথিবীকে উদ্ধার করেন বরাহরূপী শ্রীবিষ্ণু। বরাহ অবতারের এই কর্মের সাথে বন্য শূকরের দাঁত দিয়ে মাটির তলা হতে গাছের মূল উপড়ে আনার কথা ভাবা যায়।
এছাড়াও দেবী বরাহীর কথা জানা যায়, যাকে রাত্রিকালে তান্ত্রিক পদ্ধতিতে উপাসনা করা হয়। তবে অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতি ভারতে আগমনের ফলে এই জীবদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন আসে। কিছু কিছু সংস্কৃতিতে এদের অপরিষ্কার মনে করা হয়, অসুখ বিসুখের সাথে এদের জড়িয়ে থাকার কথা মনে করা হয়। ফলে এই ধরনের চিন্তা ভাবনার প্রভাবে বন্য শূকরের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীতে একটা ঘৃণার ধারনা এসে মেশে।
এখন ভারতে বন্য বরাহের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গী তা মিশ্র। কোথাও কোথাও কৃষকরা এদের মেরে ফেলতে উদ্যত, কোথাও বা গ্রামের দেবতার রূপে এদের স্থান। এদের নাম ব্যবহার করে কেউ বা গালিগালাজ করে, কোথাও এদের মূর্তি বানিয়ে মালা পরানো হয়। প্রকৃতি সংরক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে কিন্তু এদের স্থান সর্বত্রই গুরুত্বপূর্ণ- খাদ্য শৃঙ্খলে এদের ভূমিকার কথা মাথায় রেখে।
লেখক পরিচিতি: ড: ঐশিমায়া সেন নাগ বায়োকেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট। বর্তমানে বন্যপ্রাণ ও সংরক্ষণের কাজে নিবেদিত। কানাডা থেকে প্রকাশিত শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট worldatlas এর অন্যতম সম্পাদক। বর্তমানে বাংলা ওয়েবজিন 'বনে-পাহাড়ে'র সহযোগী সম্পাদিকার দায়িত্বেও তিনি যুক্ত।
Comments