top of page
  • ..

মানসের বনে বনে

হিমালয়ের পাদদেশে অসমের মানস ন্যাশানাল পার্ক। সেখানে ভ্রমণের সুখস্মৃতি সুপর্ণা ঘোষের কলমে।


পরপর দুবার,২০২০ তে কোভিড এবং ২০২৩ এ রাজনৈতিক গণ্ডগোলের জন্য মনিপুরে টিকিট বাতিল হয়ে গেছিল। তাই অবশেষে এয়ার ইন্ডিয়ার উপদেশমতো গৌহাটিতেই নেমে যাওয়াটা ঠিক করে নিলাম।

সকালবেলায় এত পরিষ্কার আকাশ যে আমাদের অবাক করে বিমান থেকে সারা যাত্রাপথেই সঙ্গ দিল কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ  পূর্ব হিমালয়ের নাম না জানা অসংখ্য বরফমাখা শৃঙ্গ । দেড় ঘন্টার যাত্রাপথ এয়ার ইন্ডিয়ার কল্যাণে মাত্র এক ঘন্টায় সেরে ফেলে নলবাড়ির প্রনীতা রেস্টুরেন্টে বড় বড় লুচি খেয়ে আমরা চললুম মানসে।



অসম এবং ভুটানের সীমান্ত বরাবর  ৯৫০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে মানস ন্যাশনাল পার্ক। ১৯৮৫ সালে UNESCO একে World Heritage Site আখ্যা দেয়। পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে ভুটান সীমান্ত বরাবর ঘন জঙ্গলে ভরা মানস ন্যাশনাল পার্ক। এর পশ্চিম দিক বরাবর বয়ে গেছে প্রধান নদী- মানস। মানস জঙ্গল তিনটি রেঞ্জে বিভক্ত। পশ্চিমদিকে পানবাড়ি, মাঝে বাঁশবাড়ি এবং পূর্বে ভুইয়াপাড়া।মানস ন্যাশনাল পার্ক অত্যন্ত ঘন জঙ্গলে ভরা, ৫৪৩ রকমের গাছ এখনো পর্যন্ত নথিভুক্ত। মানস জঙ্গল বিখ্যাত হল - ভারতীয় একশৃঙ্গ গণ্ডার, হাতি, Wild Water Buffalo, Slow Loris, Capped Langur, Golden Langur, Pygmy Hog, Malayan Giant Squirrel এবং Great Hornbill এর জন্য। এছাড়াও আছে Indian Tiger, Indian Leopard, (wild dogs), Sloth Bear, গৌর(baison), Sambar Deer, Barking Deer, চিতল হরিণ, ভোঁদড়, Assamese Macaques ইত্যাদি সহ ৫৫ রকমের স্তন্যপায়ী, ৩৮০ রকমের পাখি, ৫০ রকমের সরীসৃপ ও ৩ রকমের উভচর প্রাণী। (তথ্যসূত্র-- শুভ্র চৌধুরী)

নদীর ধারে বাফেলো ক্যাম্পে এসে ব্যাগটা কোনোমতে নামিয়েই পঙ্কজের পাঠানো হুডখোলা বনদপ্তরের জিপে উঠে বসলাম। আমাদের সাথে ড্রাইভার ইজিকেল বার্লার আর বন্দুক নিয়ে কাঞ্চন বোরো। "জঙ্গলটা  ভার্জিন"---পাপান বলেছিলো। এত গহীন বন্য অরণ্য খুব কম দেখেছি। উত্তরবঙ্গের প্রায় প্রতিটি জঙ্গলের কোর এরিয়াতে ঘুরেও বলা যায়- এ সৌন্দর্য অন্যরকম।



সাত ঘন্টা ধরে বাঁশবাড়ি রেঞ্জ চষে ফেলার সাথে সাথে যেটি উপরি পাওনা তাহলো-- সাত ঘন্টায় ৬ বার হাতির পালের মুখোমুখি হওয়া, বাঘের টাটকা পায়ের ছাপ দেখা ছাড়াও আজ অসংখ্য গ্রীন এমারেল্ড ডাভের ঝাঁকের পান্নাসবুজ শাড়িতে স্বাগত জানানো, এবং সারাক্ষণই আমাদের সঙ্গী থাকা, আর রানী এবং কমলায় রঙিন ruddy kingfisher এর মনমাতানো মিষ্টি ডাক,green billed malcoa,starling এর ডানা ঝাপটানি,,  প্রায় মরসুম শেষ হয়ে গেলেও জঙ্গলের কোন কোন জায়গায় অপূর্ব অর্কিডের ফুটে থাকা, এবং মন মাতাল করা বনজ গন্ধ, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, আঁকুশি ফল খেতে হাতিদের আনাগোনা,  মাত্র চার হাত দূরে খুব বিরক্ত মুখ করে  দাঁড়ানো গম্ভীর বাইসন, অসংখ্য হরিণ,ময়ূর,গোল্ডেন লাঙ্গুর, জঙ্গলে ফুটে থাকা অসংখ্য নাম না জানা বুনো ফুল - আমার আজকের দিন কানায় কানায় পরিপূর্ণ। ২২ কিলোমিটার বনপথে  চলার পর আমরা পৌঁছলাম মাথানগুড়ি গভর্নমেন্ট রেস্ট হাউসে। পাশেই বয়ে চলেছে মানস নদী । এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে এগিয়ে চললাম ভুটান বর্ডারে।  সেখানে নিজেদের পাসপোর্ট জমা রেখে পা ফেললাম রয়্যাল মানসে,এটা ভুটান রাজার অধীনে। রাইফেল জমা রেখে(কারণ ভুটান সরকারের এলাকা) পাহাড়ী পথে জঙ্গল পেরিয়ে কয়েক ঘন্টা পর পৌছালাম পাংবং ঝুলন্ত ব্রিজ। সেখানে ভুটানি আতিথেয়তায় তাঁদের রান্না সুস্বাদু খাবার এবং অসাধারণ চিজ স্যালাড , ফলের রস সহযোগে দুপুরের খাবার সেরে আবার গহীন পথ পেরিয়ে ফিরে আসা।

বেলা শেষ। সন্ধ্যা হচ্ছে। সামনে পূর্ণিমা। মানস নদীর তীরে জঙ্গলের উপর সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে।তার মায়াময় জোছনা-চন্দনে মাখা দুধ ধোওয়া রূপ আর আলোছায়ার লুকোচুরি দেখতে দেখতে  আমরা ফিরে চলেছি ।

মানস ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন ।আজ মঙ্গলবার,দশহরা।  জঙ্গল পরিষ্কারের দিন না হলেও জঙ্গল বন্ধ। তাই ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই  বেকি নদীর পাড়ে হাঁটতে গিয়ে সুন্দর মিষ্টি ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগিয়ে, ঘাটে বাঁধা নৌকায় একটু বসে পানকৌড়িদের স্নান,গ্রামের গরুদের নদী পার হয়ে সাঁতরে ওপারে গিয়ে ঘাস খাওয়া দেখতে দেখতে কাটানো হলো।




ফিরে স্নান করে  রুটি, তরকারি, ফলের রস, ডিমসেদ্ধ এবং কলা--- ভরপুর খেয়ে আবার পঙ্কজের গাড়িতে উঠে বসা। আজ পংকজ আমাদের নিয়ে গেল সামদ্রুপ জোক্খার নামে একটি ইন্দো ভুটান বর্ডার দিয়ে সরাসরি ভূটানে। যাবার আগে ভারত এবং ভুটানের সীমান্তবর্তী তরাই অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে বেশ খানিকটা যাওয়া, তারপর রাজার দেশে পৌঁছে পাসপোর্ট জমা দিয়ে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত স্পেশাল পারমিশনে ঘোরাঘুরি করে ভুটানে দুপুরের খাবার খেয়ে, ফলের রস খেয়ে আবারো আসামের চা বাগান ঘুরে চা,গামছা কিনে,  সন্ধ্যাবেলার মানস জঙ্গলের পার্শ্ববর্তী ঘাসবনের মধ্য দিয়ে নদীর জলে ডুবে যাওয়া সূর্যকে বিদায় জানিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম ক্যাম্পে। এবার ক্যাম্পে বসেই ঘাই হরিণীর ডাক শোনার প্রতীক্ষা। ঝিঁঝিঁ দের বাজনা আর রাতের পাখির সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে একাকী গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পরবো। আগামীভোরে জঙ্গলের ঘুম ভাঙানিয়া গান শোনাবার জন্য জিপ আর ওর নিজস্ব বাইনোকুলার নিয়ে আমাদের নিতে আসবে ছেলেটি।রাখছি আজ।

--"ওই ভেসে আসে কুসুমিত উপবন-সৌরভ,

ভেসে আসে উচ্ছল-জলদল-কলরব,

ভেসে আসে রাশি রাশি, জ্যোৎস্নার মৃদু হাসি, ভেসে আসে পাপিয়ার তান।

আজি, এমন চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো,

সে- মরণ স্বর্গ সমান"।।



আজ মানসে আমাদের তৃতীয় দিন।গতরাতে সাড়ে আটটার মধ্যেই রাতের খাবার শেষ করে বাংলোর বারান্দায় মোম জোছনায় গা ভিজিয়ে চুপকরে বসে এই নিবিড় ঝিমধরা নৈঃশব্দ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ বনদপ্তরের কর্মীদের ফেলা সার্চলাইটে দেখি দুটো চিতল হরিণ। ঘুম ভেঙে গেলো রাত ৩-৩০ নাগাদ।উঠে আবার বারান্দায় সবুজ অন্ধকারে বসে রইলাম সূর্যোদয়ের অপেক্ষায়।পঙ্কজ ফোন করে জানাল টায়ার বদলে আসতে দেরী হবে।স্নান সেরে রেডি হয়ে রাস্তায় নেমেই দেখি বনদপ্তরের একজন কর্মী দাদা আমাকে  ডাকছেন।দেখি  রাস্তার পাশেই বৈদ্যুতিক বেড়ার ওপাশেই চারটে গন্ডার

ঘুরছে।দিনের শুরুতেই চমক। গাড়ি এলে আমরা রওনা  হলাম ভুইয়াপাড়া রেঞ্জ এর দিকে।এটা পুরোটাই savana grassland,প্রায় ঘন্টা তিনেক ঘোরাঘুরি করে ব্রাউন কোকিল, অসংখ্য ট্যা ট্যা করা টিয়ার ঝাঁক ছাড়া আর কিছু চোখে পড়লো না।তবে ভুটান পাহাড়ের কোলে এই বিস্তীর্ণ হরিদ্রাভ তৃণভূমি চোখ জুড়িয়ে দিলো দুপুরে আজ  Assamese cuisine খাব বলে অন্য একটা গাড়িতে করে গেলাম অন্য একটি হোটেলে।খেলাম সুগন্ধি চালের ভাত,পটল পাকোড়া, বেগুন ভাজা,মুসুরডাল,কচুশাক,সবজি,মাছের টেঙ্গা,ব্যাম্বু চিকেন।



রওনা হলাম জিপসিতে বিকেলের সাফারি তে।বার কয়েক হাতি,বুনো শুয়োর,ধনেশ,মাছরাঙা দেখতে দেখতে হঠাৎ এক জায়গায় গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল।কাছেই হাতির পাল।তাদের বড়কর্তা ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।পেছনে হাতির পাল।ভিডিও করছি,দমটা সত্যি ভেতরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।সামনে পঙ্কজ আর বন্দুকধারী প্রহরী নির্বিকার। ফিসফিসিয়ে বলছি গাড়ি পেছাও,হাতি এগোচ্ছে।ওরা বললো কিছু করবে না।আপনারা চুপ থাকুন। কিন্তু বড় হাতিটা আরো একটু এগিয়ে এলো।এবার পঙ্কজ গাড়ি স্টার্ট করে গাড়ীটা পেছালো। অবশেষে হাতি থমকে গেল।আস্তে আস্তে দল ধরে ওপাশে নেমে গেল।আমাদেরও ধড়ে প্রাণ এলো।



পরিশেষে জানাই আমাদের ২৬ বছর বয়সী গাইড পঙ্কজ এর কথা। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা উচ্চশিক্ষিত পংকজ শুধু পশুপাখি এবং গাছপালাকে ভালোবেসেই একজন দক্ষ গাইড। পাখিদের সম্বন্ধে এত বিশদে জ্ঞান দেখে অবাক হতে হয়।চিতা,বাইসন,কোবরা সাপ বা হাতির পাল-- সবেতেই সে নির্বিকার,শান্ত ।

৫-৩০ বেজে যাচ্ছে। জঙ্গলে সন্ধ্যা নামছে। তৃণভূমির অপরদিকে পাটে বসা কমলা রঙের সূর্যকে দেখতে দেখতে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। রাস্তার পাশে বনদপ্তরের কুনকি হাতিদের স্নান, আর বউ কথা কও পাখির ডাক আপনাদের জন্য তোলা রইলো।পেছনে পরে রইলো মায়াবী বনপথ।


বিদায় মানস।


ছবি: লেখক


লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় শিক্ষক। প্রকৃতি প্রেমী। ভ্রমণ রসিক।

 




Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page