top of page
..

পাহাড়, কাঞ্চনজঙ্ঘা আর পরিবেশ বিপর্যয়

বনেপাহাড়র পাতায় হিমালয় ভ্রমণের মনকেমন বর্ণনার সাথে সাথে উঠে এল ঘনিয়ে আসা পরিবেশ বিপর্যয়ের কথাও। কলমে মৌসুমী ব্যানার্জী






গত দুদিন ধরে আছি সবুজ জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ি গ্রামে । শহর কলকাতার ভীড়, গরমের ক্লান্তি থেকে জুড়াতে পাহাড়ের কোলে আসা। এই অঞ্চলটিতে লোকবসতি বেশী নয় মোটেও। বিশেষ করে আমরা আছি গ্রামের শেষ প্রান্তে বড় শান্ত, নিরালায় এক হোম স্টে র একমাত্র অতিথি হয়ে। ঘরের বাইরে ব্যালকনিতে এলেই পাহাড়, জঙ্গলের বড় সুন্দর ছবি – তারা সকলেই দু দিন ধরে আমার একান্ত আপনার! অন্যদিকে গাড়ি যাওয়ার রাস্তা । সকালের দিকে সে রাস্তা দিয়ে মাত্র কয়েকটি গাড়ির আসা যাওয়া। দিনের বাকি সময়ে শুধু পাখির ডাক আর পাহাড়ের হাওয়ায় বড় বড় গাছের পাতাদের সরসর শব্দ, দূরে কোথাও পাহাড়ি ঝর্ণার আপন খেয়ালে ঝরঝর করে বয়ে চলার শব্দ – সব মিলিয়ে অপূর্ব , বড় মায়াময় এক সাংগীতিক পরিবেশ !

দিন দুই আগে বৃষ্টি হয়েছিল। গাছগুলো চকচকে সবুজ পাতার সাজে ভারী চমৎকার লাগছে। সামনের পিচঢালা গাড়ি যাওয়ার ঢালু রাস্তাটায় গিয়ে দাঁড়ালে শুধু সবুজ, সবুজ আর সবুজ ! ঘন পাতার আড়াল থেকে পাখিদের নড়াচড়া, ডাকাডাকি। বড় লাজুক ওরা। কিছুতেই দেখা দেয় না। রাস্তার ধারে পাহাড়ের গা বেয়ে কোথাও সবুজ ফার্নের মনকাড়া সৌন্দর্য , তো কোথাও বা নাম না জানা অযত্নে বেড়ে ওঠা জংলী আগাছার রঙবেরঙের ফুল আর সেই পাহাড়ি ফুলের কাছাকাছি কালো ভ্রমরের গুনগুনানি, মৌচোষা পাখিদের মহা ব্যস্ততায় ওড়াউড়ি। রাস্তার ধার থেকে নীচের দিকে দেখলে আর একরকম ভালোলাগা। ইতিউতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছবির মতো টিনের চালের বাড়ি। নানারকম সবুজের মাঝে উজ্জ্বল লাল, নীল রঙা টিনের চালের বাড়িগুলো – ধাপ চাষ করা জমি নেমে গিয়েছে আর একটি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে।


সন্ধ্যে নামলেই সবকিছু বড় শান্ত এদিকটায়। উল্টোদিকের পাহাড়ের ঘরবাড়িগুলোতে জ্বলে ওঠা বিজলী বাতি অন্ধকারে কালো হয়ে যাওয়া গাছের ফাঁকে ফাঁকে ভারী চমৎকার দেখায়। সঙ্গে কীট পতঙ্গের ঐকতান। জোনাকির ঝিকিমিকি। সন্ধ্যা পার করে আঁধার নামলে মাথার উপরে আকাশ ঝলমল করে গ্ৰহ নক্ষত্রদের সাজে। দূরের পাহাড়ের গা বেয়ে যাওয়া রাস্তায় অজস্র চলমান আলোকবিন্দু নিজেদের শহুরে ব্যস্ত জীবনের কথা মনে করিয়ে দেয়।

ভোররাত থেকে শোনা যায় ঘরের বাইরের জঙ্গলে পাতার শিরশিরানি আর অজস্র পাখির ডাক। বিছানা ছেড়ে হালকা চাদরে নিজেকে মুড়ে নিয়ে এসে বসি ঘর সংলগ্ন বারান্দায়। বাঁদিক ঘেঁষে হালকা মেঘের চাদরে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার অবয়ব। ডানদিকে আকাশে নতুন দিনের শুরুর আভাস। গত দুদিন ধরেই হালকা, সুগন্ধি দার্জিলিং চায়ের স্বাদ নিতে সঙ্গী হয় এরাই। মন গুনগুনিয়ে ওঠে –'কি সুর বাজে আমার প্রাণে/ আমি জানি, মন জানে।'

বারান্দা ঘেঁষে এবড়োখেবড়ো রাস্তা গ্রামের দিকে চলে গিয়েছে। দিনেরবেলায় হাতেগোনা কয়েকজনের যাওয়া আসা ঐ রাস্তা ধরে । হোম স্টে র ম্যানেজার কাম সবকিছু – নাম তার রিকদেন লেপচা। বেশ ছেলে। ছোটখাটো, ফর্সা চেহারা তার। হাসিখুশি, বড়ই যত্নশীল। কথাবার্তায় পরিপাটি। ইংরেজি ভালোই বলে। ব্যালকনি ঘেঁষে জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া পথটা ধরে একটু গেলেই ওদের বাড়ি। সকাল হতেই ঐ পথ ধরে হাসিমুখে সে এসে হাজির হয় হোম স্টে তে। হোম স্টে র রান্না ও খাবারঘরে তখন ব্যস্ততার ছবি। রিকদেনের এক গ্রামতুতো 'আন্টি' –তাঁর হাতের রান্না করা প্রতিটি পদই ভারী চমৎকার! সঙ্গে থাকে প্রণয় শেরপা। প্রণয় বেজায় হাসিখুশি। বছর পঁচিশ কি তারও কম হবে ওর বয়স।

নীল আকাশের নীচে

ঐ গ্রাম্য জঙ্গলে বাঁক নেওয়া পথটা দেখলে দুদিন ধরেই মনে হচ্ছে –'পথ দিয়ে কে যায় গো চলে, ডাক দিয়ে সে যায়। .... অতঃপর 'আমার ঘরে থাকাই দায়।' –এমন ডাকে ঘর ছেড়ে বেরিয়েই পড়লাম। রিকদেনের জুনিয়র প্রণয় শেরপা চলল আমাদের সঙ্গী হয়ে। আর প্রণয়ের পিছনে তার চারপেয়ে সাগরেদ ডাল্লু। খুব আলাপী সে। আমি নিজেও এমন সঙ্গী সাথীর সঙ্গে আলাপে উৎসাহী।

বড় বড় সবুজ গাছ ঘেরা পায়ে চলা রাস্তা। রাস্তার ধারে লিলি ফুলেদের আনন্দের উৎসব চলছে। গোলাপির কত রকম তাদের অঙ্গে! হালকা হাওয়ায়, নীল আকাশের নীচে, বড় বড় সবুজ গাছেদের কোলে ওদের সুখের প্রকাশ। কিছুটা দূরে এক থোকা গোলাপি রঙে চোখ আটকে গেল। কাছে গিয়ে দেখা গেল জংলী আদা গাছের ফুলের বাহারি, মনোহরা গোলাপি পোশাক। গ্রাম ঠিকই, তবে বাড়ি ঘর খুব কম। ফুলগাছে সাজানো সব বাড়িতেই ধাপ কেটে ভুট্টার চাষ হচ্ছে। তাছাড়াও আছে কিছু শাক সব্জির চাষবাস। মুরগী, ছাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়ির জমিতেই। মহিলারা কাজের ফাঁকে মুখ তুলে প্রণয়কে স্থানীয় ভাষায় কিছু বলছেন, সঙ্গে প্রণয়ের অতিথিদের উদ্দেশ্যে সরল হাসিমুখে অভিবাদন। এগিয়ে চললাম আমরা। আমাদের সঙ্গে ডাল্লুও।

জঙ্গলের পথে

আজ আকাশ বেশ নীল। একটু মেঘ ভাসছে আকাশে যদিও। রোদ ঝলমল করছে। বেশ চড়া রোদ। বুনো গন্ধে চারিদিক মেতে আছে। আলো আঁধারির পথে দিনের বেলায়ও কত রকম ঝিঁঝিঁ পোকাদের অর্কেস্ট্রা চলছে। গিয়ে পৌঁছলাম ঘন জঙ্গলের মাঝে এক ছোট্ট গির্জার সামনে। গির্জার চত্বরটি কিছুটা সমতল। কিছু গোলাপের গাছ সেখানে। বন্ধ দরজা। । অনেক পুরনো গির্জা। সম্ভবত উনবিংশ শতকের। প্রণয়ের কাছ থেকে জানলাম রিকদেনরা এই গির্জা তেই উপাসনা করে থাকে বলে। প্রণয় একই গ্রামে থাকে। ওরা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। এক এক জায়গায় জঙ্গল এতটাই ঘন যে সোজা হয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। জানতে চাইলাম কোনও জানোয়ার আছে কি না! তেমন সদুত্তর পেলাম না। শুধু জানলাম ভয় পাওয়ার কিছু নেই বলে। ওরই মধ্যে দু একজন গ্রামবাসী গাছের ডাল কেটে নিয়ে যাচ্ছে পিঠে বেঁধে। ইদানীং শহরে গাছপালা র অভাব তার উপর জলবায়ু পরিবর্তনের ছাপ বড় প্রকট হয়ে উঠেছে। তাই গাছ কাটতে দেখে মন একটু যেন কেমন করে উঠল। কিছু দূর যাওয়ার পর গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ধাপ চাষ করা পাহাড়ের ঢালে সাদামাটা অথচ বড় সুন্দর ছবির মতো বাড়ি। ভারী পরিচ্ছন্ন, রঙবেরঙের লিলি, অর্কিডে ঘেরা সেই বাড়ি। প্রণয় জানাল যে এ হল রিকডেনদের বাড়ি।

মনটা হারিয়ে গেছিল এই পথেই

আমাদেরকে দেখে ওর বাবা বেরিয়ে এলেন হাতজোড় করে। ভদ্রলোক পেশায় স্কুল শিক্ষক। ঘরের পাশ দিয়ে ধাপে ধাপে চাষ হচ্ছে ভুট্টা। আর একপাশে কিছু সবুজ শাক সব্জির ক্ষেত পার করে ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন উঠোন। উঠোনের একপাশে একটি ঘেরা ও টিনের চাল দেওয়া জায়গায় কাঠ কেটে জমানো হয়েছে। কাঠ দেখে কিছুক্ষণ আগের অস্বস্তি আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। একটু এগিয়েই ওদের রান্নাবাড়ি। সেখানে দিলাম হানা। রান্নার কাজে ব্যস্ত ঐ পরিবারের অনাত্মীয় কোনও মহিলা। সাদামাটা রান্নাঘর , খুব পরিষ্কার। বাসনপত্র ঝকঝক করছে। গ্যাস বার্নারে বসানো কুকারে কিছু সিদ্ধ হচ্ছে। পাশেই দেওয়ালে কাঠের সাধারণ তাকে রান্নার সরঞ্জাম। এক কোণে দেখা গেল মাটির উনুনে কাঠের জ্বালে বসানো আছে একটি বাসন। উল্টোদিকে টেবিলে কিছু বাসনপত্র।সব মিলিয়ে যত্ন ও পারিপাট্যের ছাপ সুস্পষ্ট।

আমি নিজেই আলাপ করলাম ভদ্রমহিলার সঙ্গে। প্রসন্ন মুখে তিনি কথাও বলতে লাগলেন। প্রণয় শেরপা ও ভদ্রমহিলার কথায় জানলাম যে ওঁরা কাঠের ব্যবহার করেন ঠিকই তবে কোনও গাছকে কেটে ফেলে নয়। বেশ কিছু গাছ লাগানো হয় গরু , ছাগল ইত্যাদির খাবারের সংস্থানের জন্য। গাছের ডাল ছেঁটে তাঁরা কাজে লাগান।

পাহাড়ি রান্নাঘর

জলবায়ু পরিবর্তনের আঁচ পাহাড়েও লাগতে শুরু করেছে। এ কথা ঐ সরল মানুষেরা সকলে হয়তো বোঝেন না। শুধু বলেন, এত গরম পাহাড়ে আগে হত না। কিন্তু ওঁরা বোঝেন যে গাছ না বাঁচলে পাহাড় বাঁচবে না। গাছের শিকড় পাহাড়কে আঁকড়ে ধরে রেখেছে, মা যেমন তাঁর বাচ্চাকে আগলে রাখেন, সেইরকম। গাছ কেটে ফেললে পাহাড়ে ধ্বস নামে। এমন করে পাহাড়ী মানুষেরা কিভাবে বাঁচবেন? আর আপনারাই বা কেন আমাদের এখানে আসবেন? টুরিস্ট আসলে ওঁদের আয়পত্র হয়। তাই এই গ্রামের অধিবাসীরা প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চান।

হোম স্টে তে ফিরলাম। বেশ গরম লাগছে। জামা কাপড় অল্প বিস্তর ঘামে ভিজে গিয়েছে। দুপুরের খাওয়া সেরে বিশ্রাম করতে এলাম। বিছানায় শুয়ে কাঁচের জানলা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকালাম। ঘোলাটে মেঘে ঢাকা। ঐদিকে চেয়ে থাকা অবস্থাতেই অনুভব করলাম সিলিং ফ্যান থাকলে যেন ভালো হত! নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউ রুমে থেকেও ফ্যানের অভাব প্রকট হয়ে উঠছে বলে!

জঙলী আদার ফুল

সারা বিশ্বজুড়ে উষ্ণায়নের কড়া নাড়া বেশ কিছু আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে। জেনেছিলাম বরফে মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফের পোশাকের পরত একটু একটু করে আলগা হতে শুরু করছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা! আপামর বাঙালীর আবেগ, আহ্লাদ এর বিষয়। তার অস্তিত্বও আজ সংকটে। কোন অজানা, ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের পথে আমরা এগিয়ে চলেছি? শুধুমাত্র ঐ একটি বা আরও দু একখানা গ্রাম গাছ বাঁচিয়ে কি পাহাড়কে বাঁচাতে পারবে? আমরা যারা নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত তাদের কি কিছুই করবার নেই? ডুয়ার্সের জঙ্গল কেটে শুরু হয়েছে আর এক পৈশাচিক যজ্ঞ। ধরিত্রী মায়ের সন্তান শুধুমাত্র মানুষ নয়, ঐ জঙ্গল ,জঙ্গলের প্রতিটি প্রজাতির পশু পাখিরাও তাঁর সন্তান। পৃথিবীর মাটিতে সমান অধিকার তাদেরও। একথা আমরা কেন ভাবি না? লোভের বশবর্তী হয়ে যে বা যারা এমন কাজ করছেন বা এমন কাজকে উৎসাহ দিচ্ছেন তাঁর বা তাঁদের আয়ু কতদিন? একবারের জন্য ভবিষ্যৎ বংশধরদের কথা কখনোও কি এঁরা ভাবেন? সমতলে চাষ জমিতে গজিয়ে উঠছে বহুতল আবাসন। জলা জমি বুজিয়ে আবাসনের পর আবাসন। ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা থেকে রেহাই পেতে এয়ারকণ্ডিশনার। মুঠোফোন আর অন্তর্জালের জগতে আমরা নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলেছি আষ্টেপৃষ্ঠে। বড় বড় টাওয়ার যত্র তত্র। নদীর মাঝে –ধানক্ষেতের মাঝে – জঙ্গল – পাহাড়েও! সারাবছর ইট, কাঠ, লোহার জঙ্গলে বাস করে আমরা যাই পাহাড়ে এমন সব পরিবেশে প্রকৃতির কোলে দিন কাটাতে – চোখের আরাম, বুকভরা অক্সিজেন, মনের আরামের জন্য। আমরা পেতে চাই এমন পরিবেশ, এমন আবহাওয়া – কিন্তু বুঝি না যে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট যে কোনও অঞ্চল হয়ে গেলে কিছুই আর বাঁচানো যাবে না। আমাদের আশ্রয় , এই সুন্দর পৃথিবী আজ চরম সঙ্কটে।

কয়েকদিন আগেই গেল 'বিশ্ব পরিবেশ দিবস'। কিছু গাছের চারা লাগিয়ে নিশ্চয়ই কিছু উপকার হয়তো হবে। কিন্তু যে সর্বনাশী খেলায় মানুষ মেতে উঠেছে তা এই মুহূর্তে বন্ধ হওয়া দরকার। আমাদের কোনও কাজ প্রকৃতির কষ্টের কারণ যেন না হয় এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া খুব দরকারি। প্রকৃতি আমাদের মা। মা কে কষ্ট দিয়ে কোনও সন্তান কি ভালো থাকতে পারে? একমাত্র সচেতনতা হয়তো মহাবিপর্যয়কে ঠেকাতে পারবে।


ছবি: লেখক



Comentarios


Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page