top of page
  • ..

গ্রন্হ সমালোচনা Leopard Diaries: The Rosette in India

সুমন্ত ভট্টাচার্য্য

কলকাতায় একটা সেমিনারে একবার বিট্টু সায়গলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনার কি মনে হয় 'প্রোজেক্ট টাইগারে'র মত 'প্রোজেক্ট লেপার্ড' নেবার সময় হয়নি ভারতে? উনি সায় দিয়েছিলেন সেই প্রশ্নের উত্তরে। আসলে লেপার্ড নামক প্রাণীটি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে বরাবরই আকর্ষণ করে। তার গ্ল্যামার, তার সৌন্দর্য, তার চকিত রহস্যময় চালচলন আর দেশের বিরাট একটা অংশে ছড়িয়ে থাকা তার অস্তিত্বের কারণে বন্য বাস্তুতন্ত্রে জঙ্গলের বড় দাদা বাঘের থেকে কখনই কোন অংশে সে পিছিয়ে আছে এমনটা লাগেনি।অথচ নিত্য নৈমিত্তিক আসতে থাকে দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে এই সুন্দর প্রাণীটির প্রতিনিয়ত বিপন্ন হয়ে পড়ার খবর। বাড়ে উদ্বেগ।


"....চিতাবাঘ যখন তার চিত্র-বিচিত্র শরীরে জঙ্গলের কিনারায় চিত্রার্পিতের মত নি:শব্দে এসে দাঁড়ায়, তখন বারবারই আমার মনে হয় মিছিমিছি মানুষ হয়ে জন্মালাম।শুধু দম্ভ নিয়ে, গর্ব নিয়ে, সংস্কার নিয়ে নীচ ঘৃণিত এক সম্মানের ও ক্ষমতার লোভ নিয়ে মিছিমিছিই এই জীবনটাকে নষ্ট করে গেলাম। ওদের মত হলে কত সহজে তাঁর সঙ্গে একাত্ম হতে পারতাম। না জেনেই তাঁকে ভালোবাসতে পারতাম!" [লবঙ্গীর জঙ্গলে: বুদ্ধদেব গুহ]


এই কারণেই বিশিষ্ট সংরক্ষণবিদ, লেপার্ড বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানী সঞ্জয় গুব্বির লেপার্ডের ওপর এই বইটা যখন প্রকাশ হল সংগ্রহ করতে দেরি করিনি। সঞ্জয় একজন বন্যপ্রাণের প্রতি নিবেদিত প্রাণ মানুষ। প্রথম জীবনের ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারের পেশা ছেড়ে কনজার্ভেশনের ওপর অদম্য passion এর জায়গা থেকে চলে আসেন ওয়াইল্ড লাইফ বায়োলজির পঠন পাঠনে।ডক্টরেট ডিগ্রীও করেছেন লেপার্ড সংরক্ষণের ওপর। কর্ণাটকের মত রাজ্যে যেখানে ভারতের সবথেকে বেশি হাতি, সবথেকে বেশি Lion-tailed macaque এবং বন্দিপুর টাইগার রিজার্ভ রয়েছে (ভারতের সবথেকে বেশির বাঘের সংখ্যায় পুষ্ট টাইগার রিজার্ভ)- সেখানকার প্রকৃতি তাঁকে বরাবরই আকর্ষণ করেছে এইসব প্রাণীদের জন্য কিছু করতে। তাই নিছক বৈজ্ঞানিক হিসাবে, বিভিন্ন বন্যপ্রাণী প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার বাইরেও তিনি সংরক্ষণের ধ্যান ধারনা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন বৃহত্তর জনসমাজে। তাই বারবার কলম হাতে তুলে নিয়েছেন তিনি সহজ সাধারণ ভাষায় মানুষের কাছে বন্যজীবের চিত্তাকর্ষক ঘটনাগুলো তুলে ধরবার জন্য। Leopard Diaries: The Rosette in India বইটি তাঁর এক দশক ব্যাপী গবেষণা ও মাঠে ঘাটে কাজ করার বিপুল অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। দক্ষিণ কর্ণাটকের টুমকুর জেলার মালভূমি ও বন-পাহাড় অধ্যুষিত এলাকার মানুষ হওয়ায় ছোট থেকেই লেপার্ডের নি:শব্দ আনাগোনা তাঁর নজর এড়ায়নি। সেই সাধারণ ধারনা তাকে গবেষণায় পরবর্তীতে সাহায্য করেছে কর্ণাটকের এক বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে লেপার্ডের খোঁজে। দলবল সহ প্রায় ৩০০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি পথ তাঁরা পায়ে হেঁটেছেন। সঙ্গে নিয়েছেন ক্যামেরা ট্র্যাপের মত আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য যা আজকের দিনে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা নিরূপণে সর্বোত্তম পদ্ধতি বলে স্বীকৃত। এছাড়াও রেডিও কলার থেকে লেপার্ডের মল পরীক্ষার মত পদ্ধতি তো ছিলই। সাক্ষাৎ করেছেন অসংখ্য রকমের মানুষের সাথে। বন্যপ্রাণী বিষয়ে মতামত নিয়েছেন। তাদের মধ্যে কৃষক, পশুপালক, জেলে, পোল্ট্রির মালিক, দোকানি, বনকর্মী, গৃহবধূ থেকে এল আই সি এজেন্টও রয়েছেন। বইয়ের পাতায় পাতায় উঠে এসেছে বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোচনার পাশাপাশি তাদের সব চিত্তাকর্ষক গল্পও।লেপার্ডের গবেষণা করতে গিয়ে একই সাথে অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি, ইতিহাস, মানুষের সমাজ জীবন নিয়ে যেসব অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছে তা যে তাকে ঋদ্ধ করেছে তা তিনি স্বীকার করেছেন। এবং অবশ্যই এসেছে লেপার্ডের পাশাপাশি কর্ণাটকের বনাঞ্চল ও তার বাইরের অন্যান্য বন্যপ্রাণীর কথা। লেপার্ডের জীববিজ্ঞান, তার বাসস্হান ও লেপার্ড নিয়ে গবেষণার ইতিবৃত্ত থেকে ধীরে ধীরে তিনি চলে গেছেন সেসব আখ্যানেও যা যে কোন বন্যপ্রাণী নিয়ে উৎসাহী পাঠককে সমৃদ্ধ করবে। ক্যামেরা ট্র্যাপে পাওয়া বনের গহীনে অবস্হিত প্রাণীদের আমাদের চোখের অগোচরে ঘটিয়ে চলা কীর্তি কলাপের আশ্চর্য সব বিবরণ উপস্থিত করেছেন। এবং এই লেপার্ডের খোঁজে ক্যামেরা ট্র্যাপের ব্যবহার থেকে কর্ণাটকের বনে প্রথমবার খোঁজ পাওয়া Honey badger বা brown mongoose এর মত প্রাণীদের কথাও পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন। তেমনই ক্যামেরা ট্র্যাপের ওপর চোরাশিকারিদের আক্রোশ, আবার ক্যামেরা ট্র্যাপের মাধ্যমে চোরাশিকারিদের ধরা পড়ার ঘটনাও উঠে এসেছে সঞ্জযের কলমে।

বারেবারে লেপার্ড ও মানুষের সংঘাতে তাঁকে ছুটে যেতে হয়েছে। নিতে হয়েছে অকুস্হল থেকে লেপার্ডদের বন্দী করে অন্যস্হানে ছেড়ে দেবার দায়িত্ব। মাঝের কিছু সময়ে এইসব স্হানান্তরিত লেপার্ডদের রেডিও কলার দিয়ে অনুসরণ করার যে চেষ্টা তিনি করেছিলেন, সেই পদ্ধতির প্রযুক্তিগত আলোচনা সহজ ভাষায় যেমন পাঠকের জন্য লিখেছেন তেমনই সেইসব ঘটনার অভিজ্ঞতা তাঁকে কতটা সমৃদ্ধ করেছে তার বিবরণ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে বেঙ্কি নামে একটা লেপার্ডকে (যার নাম তাঁর শিশুপুত্র দিয়েছিল। কন্নড় ভাষায় বেঙ্কি শব্দের অর্থ-আগুন)দীর্ঘদিন রেডিও কলারের মাধ্যমে অনুসরণ করায় যে একাত্মতা সেই প্রাণীটির প্রতি তাঁর মধ্যে তৈরি হয়েছিল তা যে কোন সুখপাঠ্য গল্পের মতই। একটি চেনা লেপার্ডকে চাষিরা যখন বিষ দিয়ে মেরেছে- একজন নিছক বৈজ্ঞানিকের বাইরে একজন নিখাদ প্রকৃতিপ্রেমিক ও নিবেদিতপ্রাণ সংরক্ষণবিদের যন্ত্রণা তার ভাষায় ফুটে উঠেছে। "It was five in the evening when the post-mortem was completed, and the animal was placed on pieces of wood to burn the carcass as per official procedures........From the other corner, two hind paws-paws that I had carefully measured a few months earlier-jutted out of the fire. I moved away from the fire unable to take my eyes off the paws."

গুব্বি বারবার বলেছেন লেপার্ড নিয়ে গবেষণা করে থেমে থাকা তাঁর কাজ নয়।কিছু তথ্য আহরণ করে পরিবেশন করাটাই যথেষ্ট নয়। তিনি সেই ভবিষ্যৎ দেখতে চান যেখানে শিশুদের যেন লেপার্ডের গল্প শুনে বা ছবি দেখেই না দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়।যেন লেপার্ডরা আজকের মতই চলেফিরে বেড়াতে পারে হলদে বিদ্যুতের মত। তাই তিনি ঘনিয়ে ওঠা বিপদগুলোর কথাও তুলে ধরেছেন যা শুধু লেপার্ড নয় ভারতের মত জনবহুল দেশে অন্য বন্যপ্রাণীদের অস্তিত্বও সংকটে ফেলে দিচ্ছে। বিগত দশকগুলোয় বাজার অর্থনীতির বিস্তারের সাথে সাথে আমাদের জীবনযাত্রায়, দেশের অর্থনৈতিক বিপুল কর্মযজ্ঞে যে পরিবর্তনগুলো আসছে তার সাথে মানিয়ে নিয়ে টিকে থাকা প্রকৃতির এই সন্তানদের পক্ষে দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। বাড়তে থাকা হাইওয়ের জাল যেমন লেপার্ডের বাসস্হান ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে তেমনই বাড়তে থাকা নগর খেয়ে ফেলছে বিভিন্ন অরণ্য অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী বন্যপ্রাণী করিডরগুলো। তার কী কী বিপদ তা যেমন তিনি তুলে ধরেছেন তেমনি উদাহরণ হিসাবে হাজির করেছেন ব্যাঙ্গালোর বা মাইসোরের মত গ্লোবাল শহরের উদাহরণকে। Economic boom এর চকমকানির নীচে যে রিয়াল এস্টেটের বাড়বাড়ন্ত ঘটছে তা কেমনভাবে গ্রাস করছে এই শহরগুলির আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা লেপার্ডের বাসস্হানগুলোকে এবং বাস্তুচ্যুত লেপার্ডরা কিভাবে মানুষের মধ্যে গিয়ে পড়ছে, জন্ম নিচ্ছে মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাতের একের পর এক ঘটনা তার রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার উপলব্ধি এই বইয়ের পাতায় পাতায়। সেই রক্ত যেমন হাইওয়েতে গাড়ির ধাক্কায় পিষে যাওয়া লেপার্ডের, তেমনি আটক পড়া লেপার্ডকে বাঁচাতে গিয়ে তাঁর নিজের সেই লেপার্ডের হাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার কাহিনী। বস্তুত: ২০১৬ সালে ব্যাঙ্গালোরের হোয়াইটফিল্ডে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটি বিবিসি সহ বিশ্বের তামাম সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছিল। তবে অদম্য passionate সঞ্জয় হাসপাতালে শুয়েও খোঁজ রেখেছিলেন সেই লেপার্ডের। যখন জানতে পারেন বানেরঘাটা অরণ্যের কাঁচা থেকে সেই লেপার্ড পালিয়ে গিয়েছে- সঞ্জয় যেন নিশ্চিন্ত হন ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার খবরে। এছাড়া ভারতীয়দের মধ্যে বাড়তে থাকা মাংস খাবার খাদ্যাভ্যাসের জন্য গ্রামাঞ্চলে বেড়ে চলা গবাদি পশু পালন কিভাবে বাস্তুচ্যুত লেপার্ডদের সাথে মানুষের সংঘর্ষ বাড়িয়ে দিচ্ছে তাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে তাঁর গবেষণা। ইঁদুর দৌড়ের এই সময়ে মানুষের সহনশীলতা, বন্যপ্রাণীর প্রতি সহজাত নৈকট্যের যে চিরাচরিত ঐতিহ্য ভারতে ছিল তাতে যে ভাঁটার টান তা তাঁর অভিজ্ঞতায় মালুম হয়েছে। (বস্তুত: এই লেখা যখন লিখছি তখন খবর ও ছবি এল হাওড়ার বাগনানে রাজ্যপ্রানী তিনটি পূর্ণবয়স্ক বাঘরোল বা fishing cat কে বিষ দিয়ে মেরে ফেলার।নীরিহ এই 'ছোট লেপার্ড' দের দোষ হয়ত ছিল পুকুর থেকে মাছ খেয়ে নেওয়া। অর্থাৎ জীববৈচিত্র নিধনে গোটা দেশ এগিয়ে চলেছে একই গতিতে) এছাড়া চোরাশিকারের অদম্য গতি, রাজনৈতিক টালবাহানার বাস্তবচিত্রগুলো এই অভিজ্ঞ বন্যপ্রাণ বিজ্ঞানীর অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে বার হয়ে এসেছে।

লেপার্ডের হাতে আক্রান্ত হবার সেই ঘটনার ভিডিও



লেপার্ড এমন একটি প্রাণী যে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরেও বিভিন্ন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তার প্রাকৃতিক বাসস্হান- বনাঞ্চল বা পাথুরে পাহাড়ি এলাকাগুলো ধ্বংস হয়ে গেলে সে চাষের ক্ষেত বা চা বাগানে টিকে থাকবে সহজে। তার জীবন হয়ে যাবে কঠিন, মানুষের সাথে নিয়ত সংঘাতে তার প্রাণ হবে বিপন্ন। তেমনই সেইসব স্হানের মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য তা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। তাই লেখক লেপার্ডের বাসস্হান নিয়ে শুধু আলোচনাই করেননি, তাদের বাঁচাবার উপায় নিয়েও মতামত রেখেছেন একজন বিশেষজ্ঞ হিসাবে। লেপার্ডের টিকে থাকা তাই শুধু বনাঞ্চল নয়, এক বৃহৎ প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্হ্যের সাথে জড়িত বলে আমরা বুঝতে পারি। লেখক আশা করেছেন বৃহত্তর নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসার । তাদের নিজেদের স্বার্থেই, তাদের ভবিষ্যতের স্বার্থে। তাই এই বই যেমন লেপার্ডের মত প্রাণীকে নিয়ে ভারতের মাটিতে হওয়া কাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় তুলে ধরে, চিত্তাকর্ষক গল্প শোনায়, তেমনই পাঠককে সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের বৃহত্তর দর্শন নিয়ে ভাবায়।




বই: Leopard Diaries: The Rosette in India 
লেখক: Sanjay Gubbi
প্রকাশক: westlandbooks

Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page