অথ হস্তিশিশু কথা
- ..
- Nov 4, 2022
- 5 min read
বনবিভাগের কাজে জড়িয়ে থাকে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গের বনবিভাগে কাজ করা আমলার কলমে উঠে আসছে তেমন কিছু সরস গল্প বনেপাহাড়ের পাতায়। তেমনই কিছু অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন পশ্চিমবঙ্গের Chief Conservator of Forests লিপিকা রায়।

যে সময় বাঁকুড়া (উত্তর) বন বিভাগে বদলি হয়ে এসেছিলাম তখন আমি সহকারী বিভাগীয়
বনাধিকারিক পদে কাজ করছি ।যার ইংরিজি নাম Assistant Divisional Forest Officer বা সংক্ষেপে
ADFO। পদের নাম যাই হোক, কাজ হল, বিভাগে যিনি বিভাগীয় বনাধিকারিক, তাঁকে সবরকম ভাবে
সহায়তা করা; মানে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ।
শিব্রাম চকরবরতির ভাষায় “হাতির সঙ্গে হাতাহাতি” করে ততদিনে আমি অভ্যস্ত। তাই প্রথমেই
আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল দলমা থেকে আসা হাতির দলের গতিবিধি নজরদারি করা আর দরকার মত
ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। এই “দরকার মত ব্যবস্থা নেওয়া” ব্যাপার টা বেশ গণ্ডগোলের। দেখা গেল হাতির
এই দল টা বিরাট বড়। বাবা, মা, মাসি, দিদা, কাচ্চাবাচ্চা, সব নিয়ে একেবারে যেন নেমন্তন্ন খাবে বলে
চলে এসেছে দলমা থেকে।এক হবু মা তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে গ্যাঁট হয়ে কাছে এক জঙ্গলে থানা গেড়েছে।
তার আঁতুড় না ওঠা পর্যন্ত তিনি নট নড়নচড়ন থাকবেন।গ্রামের লোকেরা একদিকে ,”আহা পোয়াতি ,
বেচারা খাবার জোগাড় করবে কি করে?” বলে কলাগাছ, কুমড়ো সব নিয়ে হবু মায়ের ডেরায় দিয়ে
আসছে। অন্যদিকে হাতির বাকি দলবল বিকেল হতে ধানের মাঠে মশমশিয়ে নেমে পড়লে আমাদের দিকে
বাছা বাছা গালাগাল ভেসে আসছে…“ আজ যদি ধানমাঠ থেকে না উঠাইছিস ওইগুলাকে তো তদের ছাল
ছাড়ায়ে টানায়ে রাইখব”।এই চলতে লাগল কয়েকদিন। রাত হয়ে গেলে অবশ্য “ অ ম্যাডাম সাহেব,
আমাদের বাড়ি দুটা ভাত মুখে দিয়্যা যাও” ও হচ্ছে। চেঁচামেচি, রাগারাগি, গালাগালি, ভাব ভালোবাসা
সব মিলিয়ে এক জগঝম্প ব্যাপার।
হাতির দলের দরকার আশ্রয়, খাবার, জল। গ্রামের লোকের ও তো একই জিনিস দরকার। কেউ
কাউকে জমি ছাড়তে রাজি নয়। মাঝে আমরা।একদিকে দামোদর নদ। ওপারে বর্ধমান। এই দলবল
বর্ধমান গিয়ে উপস্থিত হলে কি হবে ভাবতেও ভয় হয়। সেটা মোবাইল ফোনের যুগ নয়, আর যেখানে
কাজ করছি সেখানে ফোন বুথ বলে কোনো বস্তু নেই। ভরসা অয়্যারলেস সেট, তাও যতক্ষণ চার্জ
থাকবে।
গ্রামের লোকেরা হবু মায়ের ওপর খুব ই সদয়। কাজেই অনেক কথাবার্তার পর সবাই নিমরাজি
হল যে এখন ১৫ দিন ওদের তাড়ানো হবে না। “সব্বোনাশ করুক আমাদের, কি আর করা, বাচ্চা না
নিয়্যা দল তো লড়বেক নাই, আমাদের ক্ষতিপূরণের ট্যাকাগুলা তাড়াতাড়ি য্যানো পাই”।
ভাবলাম যাক, কটা দিন আপাতত যুদ্ধবিরতি। কিন্তু ২৪ ঘন্টাও কাটার আগেই আবার শুরু হল
সাজোসাজো রব। কি? না, “হাতির ছা কুয়্যায় পড়িছে, বিরাট চিঁচাইছে, এক্ষুণি আসো”। এও ছিল
কপালে! যেখানে ওই “হাতির ছা” কুয়োতে পড়েছে সেই গ্রামে ইলেক্ট্রিক নেই, বড় গাড়ি ঢোকানোর
রাস্তা নেই, কোদাল ছাড়া মাটি কাটার কোনো ব্যবস্থা নেই। আছে শুধু আমাদের কটি নিধিরাম সর্দার
স্টাফ, যাদের বাকি হাতি তাড়া করে এলে ভয় দেখানর জন্য blank fire করার উপযুক্ত বন্দুক পর্যন্ত
নেই। আছে অদম্য সাহস, কিছু পটকা, মশাল, যার চলতি নাম হুলা। আর আছে গ্রামের লোকরা,
যাদের সাথে আমাদের ভাব ভালবাসা আর ঝগড়াঝাঁটি একসাথে চলতে থাকে। । সবাই এই পরিস্থিতিতে
হারিকেন, হ্যাজাক, কোদাল সম্বল করে “ছ্যানা টা কে তুলতে হবে বাবু, কে কে আসবি আয়” বলে
ঝাঁপিয়ে পড়ল।
বোঝা গেল, ছোটো একটা দল চুপচাপ মাঠে ধান খেতে নেমে পড়েছিল; বাচ্চা কখন গুটিগুটি
এদিক ওদিক করতে গিয়ে পড়ে গেছে মেঠো কূয়োর ভেতর। এরপর একদিকে মায়ের আর্তনাদ, একদিকে
কুয়োর ভেতর থেকে ছানার কান্না। মা হাতি তার দলবল সমেত দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের নজরে রেখেছে,
একটুও তেড়ে আসার ভাব নেই। ও যেন নিশ্চিত জানে আমরা তুলে আনব বাচ্চাটা কে।
রাত কেটে গেল। ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে, “হেঁইও, হেঁইওঃ” করে সাহসী ছেলেরা সব
কাদামাখা ভুত হয়ে কাদামাখা হাতির ছা কে তুলে আনল। এরপর যে নাটক শুরু হল তার জন্যে
আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না।
“ হেই যাঃ যাঃ, মায়ের ছ্যানা মায়ের কাছে যাঃ”…..হাতির ছানা টলমল করতে করতে মায়ের
কাছে যেতেই মা দিল এক ধাক্কা। আমরা ভাবছি বকুনি দিচ্ছে।এই চলতে লাগল বেশ কয়েকবার। হঠাৎ
এক জন বলে উঠল,” আরে মা টা কান্না করে ক্যানো? হেই যা, মা টা নিবে না রে ছ্যানা টাকে”
সে এক মর্মবিদারক দৃশ্য। মা হাতির চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়ছে, বাচ্চা হাতি মাকে
সাধ্যসাধনা করছে, বেলা বেড়ে যাচ্ছে, কাদামাখা ছেলেরা কাদা মাখা হাতে চোখের জল মুছছে আর
পাশের পুকুর থেকে জল এনে বাচ্চা হাতির গায়ে ঢালছে। কিন্তু না, খর রোদ উঠে যাওয়ার আগে মা
হাতি দলের সঙ্গে আস্তে আস্তে চলে গেল, বাচ্চা কে আমাদের কাছে ছেড়ে দিয়ে।
আমরা সারারাতের পরিশ্রমের পর আস্ত এক খানা হাতির বাচ্চা নিয়ে কি করব না বুঝতে পেরে
ভোম্বলদাসের মত দাঁড়িয়ে আছি।যথারীতি সকলে ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে, নির্দেশের অপেক্ষায়। সবচেয়ে
কাছের বীট অফিসও অন্ততঃ চার কিলোমিটার দূর। এই হাতির বাচ্চা কে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া
কোনও উপায় দেখা যাচ্ছে না।এগিয়ে এলেন আমাদের সুভাষবাবু, বীট অফিসার। ওনার ট্রেডমার্ক গামছা
খানা কাদামাখা ইউনিফর্মের কাঁধে।
“কত কাঁড়ার (মোষ) বাচ্চা টানিছি , এটা ত একটু মোটা বাচ্চা…এই যা”।আমি চমৎকৃত
হওয়ার সময় পাওয়ার আগেই সুভাষবাবু নিজের গলা থেকে গামছাখানা হাতির বাচ্চার গলায় বেঁধে টানটি
দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতির বাচ্চার ওইটুকু মাথার এক গুঁতোয় কুপোকাত।“হাতির বাচ্চা হাতি ই বঠ্যে, হিঃ
হিঃ” …একদিকে হাসির কলরব, অন্যদিকে সুভাষবাবুর কুঁইকুঁই, “এই বাচ্চাটা বেশি মোটা বট্যে”।“তা
হাতির ছ্যানা তুমার মত রুগা হবেক বাবু? হিঃ হিঃ” এর মধ্যে পলায়নপর বাচ্চা হাতি কে কব্জা করে,
আমাদের বিচিত্র মিছিল যখন বীট অফিসের সামনে এল, তখন বেলা একটা বাজে।
মুখে মুখে খবর রটে গেছে। সেকালে সোস্যাল মিডিয়া তো দূর, গ্রামদেশে খবরের কাগজ আসত
বিকেলের বাসে।আমরা গিয়ে দেখি ছাগল চরানো ফেলে রাখালবাচ্চা, ঘোমটা মাথায় বাচ্চা কোলে বউ,
গিজগিজ করছে। বীট অফিসারের বউ ভাত বসিয়েছেন, না হাতির বাচ্চার জন্য নয়, আমাদের জন্য।
হাতির বাচ্চাকে স্নান করানো হল, দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করানো হল, তারপর রওনা দেওয়া
গেল অফিসের পথে, পুরো ঘটনা জানিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা করার জন্য। পরের কদিন এদিকে বীট
অফিসের উঠোনে হাতির বাচ্চা “মানুষ” হতে থাকল আর ওদিকে আমরা খবর রাখতে রাখলাম জঙ্গলের
মধ্যে এর তুতো ভাই বা বোন কিছু জন্মালো কিনা। অবশেষে উত্তরবঙ্গে আমাদের ই পিলখানার এক সদ্য
মা হওয়া হাতির কাছে পাঠানো হল বাচ্চা টাকে। সবাই মিলে আবার একচোট কেঁদেকেটে ফুলের মালা
পরিয়ে ট্রাকে তুলে দিল তাকে।ওর বিদায় সম্ভাষণে একজন প্রাথমিক স্কুলের মাস্টারমশাই বোধহয়
“শকুন্তলা” থেকে কোটেশন দিতে গিয়ে আবেগভরে, “ এই যে মা হারা হরিণশিশু”, ইত্যাদি বলায়
অন্যরা “আরে হাতিশিশু বলেন মাস্টারবাবু” বলে হা হা হি হি জুড়ে দিল।
দিন দুয়েকের মধ্যেই খবর পাওয়া গেল জঙ্গল থেকে নতুন জন্মানো পুঁচকে নিয়ে মা বেরিয়েছে।
আমরাও লেগে পড়লাম। আর নয়, এবার এই গ্রাম থেকে বাস ওঠাতে হবে হাতির দলের । আবার সেই
সন্ধ্যে হতেই হইহই, হ্যাটহ্যাট, রাগারাগি, গালাগালি, গলাগলির “কম্বো ডিনার” রান্না শুরু। আরো পাঁচ
সাত দিন চেষ্টার পর অবশেষে বিদায় করা গেছিল তাদের।
এই পর্যন্ত পড়ে অনেকেই ভাবছেন ট্রাকে চেপে উত্তরবঙ্গে যাওয়ার পর মা হারা হাতির ছানার
কি হল? তাদের জন্য বলি, সে মাসি হাতির কাছে পরম আদরে একটু বড় হয়ে উঠে মাহুতদাদার পেছন
পেছন জঙ্গলে গিয়ে গাছের পাতা ভেঙ্গে নিজে নিজে খেতে শিখল। মাসি হাতি হল রীতিমত ফরেস্ট
ডিপার্টমেন্টের স্টাফ, আমাদের মত তার ও সার্ভিস বুক আছে, মানে সোজা করে বললে সে হল গিয়ে
আমাদের সহকর্মী। পিঠে হাওদা নিয়ে ট্যুরিস্ট বসিয়ে তাদের জঙ্গলে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া ছিল তার
ডিউটি। পিছু পিছু যেত আমাদের এই হাতির ছানা। আস্তে আস্তে সে মাহুতদাদার নির্দেশ বুঝতে শিখল।
আর একটু বড় হয়ে সেও দিব্যি পিঠে হাওদা বসিয়ে লোক নিয়ে জঙ্গলে বেড়ানোর ডিউটি পেতে শুরূ
করল। পথে গন্ডার দেখতে পেলে, একটুও ভয় না পেয়ে সোজা দাঁড়িয়ে গন্ডারের চোখে চোখ রাখতেও
শিখে গেল।ও জেনে গেছিল পিঠে যে দুপেয়ে গুলো বসে আছে, ওদের প্রাণ রক্ষার দায়িত্ত্ব ওর। কারণ ওই
দুপেয়ে গুলোই মা চলে যাওয়ার পর ওকে এখানে নিয়ে এসে বড় করেছে। মায়ের কথা ওর মনে পড়ত
কিনা আমরা ঠিক জানতে পারিনি, কারণ ও মাহুতদাদার কথা বুঝলে কি হবে, আমরা মানুষরা তো ওর
ভাষা শিখতে পারিনি!
লেখক পরিচিতি: লেখক পশ্চিমবঙ্গের বনবিভাগের Chief Conservator of Forests পদে কর্মরত।
Comments