top of page
  • ..

বড়গল্প: দার্জিলিঙের কাছে (শেষ পর্ব )

শারদীয়া মানেই পুজোর গল্প-উপন্যাস বাংলা ভাষায়। বনেপাহাড়ের পাতায় প্রকাশ হচ্ছে ধারাবাহিক আকারে বড়গল্প। বন -জঙ্গল, পাহাড়ের পটভূমিতেই। অপূর্ব কুমার রায়ের কলমে । শেষ পর্ব।



একটা পেগ বানিয়ে দেবলীনার হাতে তুলে দিল রোহিত। “আপনার?”, দেবলীনা জানতে চাইল।

“ আমি তো এসবে নেই!”

“সেকি! এমন প্রকৃতির মধ্যে থেকে কখনও ইচ্ছা হয়নি!”

“না ম্যাডাম! প্রকৃতির নেশাই আমায় এমন পেয়েছে যে অন্য নেশায় আর টানেনি আমাকে…”

“এটা কিন্তু ঠিক না। আমি একা গ্লাস হাতে বসে আছি আর আপনি খালি হাতে মুচকি মুচকি হাসবেন।“

“ আচ্ছা চলুন আপনার সম্মানে আজ একটা নিচ্ছি। একটাই কিন্তু হ্যাঁ? আর বলবেন না…তবে আপনার দরকার হলে যেন সংকোচ করবেন না।“

মাথার উপর কালো আকাশে তারারা জ্বলজ্বল করছে পাহাড়ে। চুপচাপ বসে থাকল ওরা কতক্ষণ তা গুনতে ভুলে গেল। আসলে গোনার প্রয়োজনই ছিল না। কিছু কিছু মুহূর্ত, সময় এমন থাকে, বিশেষত: যখন সামনে অপার প্রকৃতি তার ডানা মেলে থাকে- তখন কথার থেকে নীরবতাই অনেক বেশি যোগাযোগ তৈরি করে মানুষে মানুষে।



“ প্রকৃতি কি শুধু এখানকারই টানে আপনাকে? দেশে বা বিদেশের অন্য কোন জায়গা টানে না?”, নীরবতা ভেঙ্গে দেবলীনা জিজ্ঞাসা করল।

“ তা কেন! আমায় তো সবচেয়ে বেশি টানে মধ্য ভারত, তার লাল মাটির জঙ্গল। এই তো বর্ষাশেষে সে জঙ্গলে এখন ঘন সবুজ পাতার সমারোহ, এবারে আস্তে আস্তে শিশির পড়া শুরু হবে সন্ধ্যার পর থেকে। সেখানে ওঁৎ পেতে থাকে বাঘেরা ঘাসবনের আড়ালে, চকিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের উপর। এর পর শীত আসবে। মায়াবি কুয়াশায় ঢেকে যাবে তার শালবন আর সেগুন বন। আর তারপরেই বসন্ত। ঋতুরাজ বসন্ত। আহা! গন্ধে ম-ম করবে বন। মহুয়ার খোঁজে ভালুক মা তার বাচ্চাদের নিয়ে বার হবে গর্ত থেকে। সেই বনের পথে পথে পায়ে হেঁটে গাছপালার খোঁজে ঘোরার স্মৃতি সারাজীবন থেকে যাবে। আমার থিসিসের কাজ করবার সময় বারবার যেতাম ওই সব অরণ্যে। কানহা, পেঞ্চ, সাতপুরা, পালামৌ, আচানমাকমার। এক সে বড় কর এক সব বন”, বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে যেন সামনের পাহাড়ের ওপারে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে সেইসব অরণ্য খুঁজতে লাগল রোহিত।

“আর? আর কোন অরণ্য…?” দেবলীনা উঠে এসে দাঁড়াল ওর পাশে।

“ আর…হ্যাঁ আবার ধরুন পশ্চিমঘাট। তার পাহাড়ের পর পাহাড়ে বিস্তৃত ঘাসবন, চিরসবুজ গাছেরা। সে পান্না সবুজের মধ্যে যে নেশা তার কাছে আর সব মাদকই তুচ্ছ। আর বর্ষায় যদি তার রূপ দেখেন। কে যেন তার সবুজ রঙের কৌটো ঢেলে দিয়েছে। সে এক অলীক সৌন্দর্য।“

“আবার হিমালয়ের সবুজ বন, বসন্তে তার রডোডেনড্রনের বাহার, শীতে তার বরফে ঢাকা রূপকথার রাজ্য। সেখানে লাদাখের উঁচু ন্যাড়া পাহাড়ে বরফে ঘুরে বেড়ায় তুষার চিতারা। নেমে আসে বাদামি ভাল্লুকের দল। আ: হিমালয়,,,সে নিজেই কত বিচিত্র। পূর্ব থেকে পশ্চিমে। কত ভাগ্য করে এমন দেশে জন্মেছি আমরা দেবলীনা দেবী বুঝলেন! “

“নিয়ে যাবে রোহিত আমায় সেই সব জায়গায়…?”, এগিয়ে এসে রোহিতের ডানহাতটা দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল দেবলীনা। আপনি থেকে তুমি –তে চলে আসার এই আকস্মিকতা এতটাই স্বতফূর্ত: ছিল যে দেবীলানা নিজেই অবাক হয়ে গেল। তারপরেই হেসে বলল," ভেবনা তোমার জ্যাক ডেনিয়েলের পাল্লায় পড়েছি…. বনের সবুজ নেশা যেন তোমার গল্পের মধ্যে দিয়ে আমার মধ্যেই সঞ্চারিত হল। আসলে হয়ে চলেছিল ক’দিন ধরে। মনে হচ্ছে বারবার যেন নিজেও এতে ডুবে যাই। আসলে….” কথা হারিয়ে ফেলল দেবলীনা একটা হঠাৎ আবেগে।

দেবলীনার হাতে নিজের বাঁ হাতটা আলতো করে রেখে রোহিত বলল,” যদি সত্যিই তুমি দেখতে চাও দেবলীনা, তবে তার থেকে আনন্দের কি হতে পারে! ঘরছাড়া এই পাগলের আসল ঘর সে তোমায় তবে দেখাবে। এত বড় দেশ আমাদের। এত অরণ্য, এখনো টিকে আছে মানুষের এত অত্যাচারের পরেও। যদি সত্যিই দু’চোখ ভরে দেখতে চাও তবে তোমায় দেখাতে পারলে আমার মত খুশি আর কে হবে!”

তারপর ওর হাত ধরে নিয়ে গেল আবার আগুনের পাশে। বার বি কিউ গুলো তৈরি হয়ে গেছে তখন।

পরদিন সকালে ম্যানেজারের বাংলোয় রোহিত এসে দাঁড়াল ঠিক ন’টার সময়ে। দেবলীনাকে সকালে ফোন করে বলেছে যে আজ দার্জিলিঙে ওকে বাইকে করে পৌঁছে দেবে। দার্জিলিঙের পথে বাইকে করে যাবার নাকি আলাদাই মজা। দেবলীনার ব্যাগপত্তর চা-বাগানের একটা গাড়িতে দার্জিলিঙে পৌঁছে যাবে।

“হ্যাপি জার্নি “ বলতে গেট অবধি এলেন ম্যানেজার মি:বিশ্বাস সস্ত্রীক। তার চোখে কি একটা দুষ্টুমি ভরা হাসি ওদের দেখে? না দেবলীনা আবার অকারণ সন্দেহ করছে? কাল রাতে মিসেস বিশ্বাস ওর জন্য অনেক রকম রান্না করে অপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু প্রায় রাত দশটায় ঘরে ফিরে আর দেবলীনা তেমন কিছু খেতে পারেনি। তবুও ওদের সাথে আড্ডা-গল্প চলল মাঝরাত অবধি। বড় মাটির মানুষ মি: বিশ্বাসরা। ওদের সাথে গল্প করা, কথা বলাও তাই বড় আনন্দদায়ক। তাই হয়তে এতদিন ধরে এতবড় একটা চা-বাগানের এত এত সাধারণ মানুষের সুখে-দু:খে জড়িয়ে থাকতে পেরেছেন।

লাল একটা জ্যাকেট আর নীলচে সাদা জিনসে দেবলীনাকে এই উজ্জ্বল সকালটার মতই লাগছিল। আঁকাবাঁকা একটা পিচে ঢালা পথ চলে গেছে চা-বাগান থেকে চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে। টাল সামলাতে রোহিতের কোমড়টা হালকা কর জড়িয়ে ধরেছে দু’হাতে। বাইকে ও অনেক চড়েছে অনেক বন্ধুর সাথে, এমনকি প্রাক্তন প্রেমিকের সাথেও। কিন্তু এই ভ্রমণের রোমঞ্চটাই ওর আলাদা মনে হচ্ছে। কিছুটা যেতেই ও হেলমেটটা খুলে ফেলল। হেলমেট পরে চারপাশটা দেখতে সুবিধা হচ্ছে না। মুখে এবার এসে পড়ছে ঠান্ডা মিষ্টি হাওয়া। তাতে সবুজ পাতা আর কুয়াশা-রোদের মিশ্র গন্ধ। বড় সুখের এই অনুভূতি। আর সুখের রোহিতের শরীর থেকে, ওর নীল সোয়েটার থেকে ছড়িয়ে পড়া উষ্ণ আমেজ আর অদ্ভুত সেই গন্ধ যা ওর ঘরে দেবলীনা পেয়েছিল।

রাস্তার ধার থেকে খয়েরি রঙের কি একটা জঙ্গলের মধ্যে খচমচ করে পালাল। রোহিত বাইকটা একটু দাঁড় করিয়ে বলল-“বার্কিং ডিয়ার…রাতের বেলা দূর থেকে কুকুরের মত ডাকে লেপার্ড বা অন্য কোন শিকারি জন্তু দেখতে পেলে। এখানে খুব কমই আছে।“

দেখতে দেখতে কার্শিয়াং এর কাছে হিলকার্ট রোডে পড়ল বাইক। সেই পাইনে ঢাকা দার্জিলিং এর রাস্তা। দূরে পাহাড়ের বুকে কুয়াশা। পাইনগাছের মাথাগুলো রোদে ঝলমল করছে। তার উপরে শরতের নীল আকাশ। টয় ট্রেনের লাইন চলে গেছে রাস্তার এপাড়-ওপাড়। ছোট ছোট বাচ্চারা লাল নীল পোষাকে স্কুলে যাচ্ছে।

একটা ছোট কফিশপে এসে দাঁড় করাল রোহিতের বাইকটা।

“দাজু, দো কাপ কফি কড়ক সে বানা দেনা”।

হাসি দেখে বোঝা গেল দোকানের লোকটি রোহিতের চেনা। কফি শপের পিছনে একটা খোলা জায়গা। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে দূরে দার্জিলিং দেখা যাচ্ছে। আর নীচে বিস্তৃত বন, চা-বাগান, নীচের সমতলে আঁকাবাঁকা রেখার মত নদী।

কফি এসে গেল তাড়াতাড়িই। সকাল সকাল কফি শপ ফাঁকাই। কী একটা ফুলের গন্ধে এখানে বাতাসটা ভরে আছে।

“এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। মোহন দাজুর এই দোকানের একফালি লন থেকে যে কত সুন্দর দৃশ্য দেখা যায় দেখতেই পাচ্ছেন। ঘিঞ্জি হয়ে আসা দার্জিলিং, কার্শিয়াং এর মধ্যেও এমন কিছু কিছু জায়গা আছে যেখানে বসলেই চারপাশের কোলাহল থেকে আলাদা হয়ে যাবেন। আসা-যাওয়ার পথে টুরিস্টরা তার খোঁজ পাবে না।“

“সবার কি সব কিছু খুঁজে পাওয়ার সুযোগ হয় রোহিত, না সুযোগ হলেও খুঁজে পায়। আমি যেমন সামান্যই দু-তিনদিনের একটা কাজে এসে তোমার মত মানুষকে খুঁজে পেলাম রোহিত। পুরো মানুষটাকে তো পাইনি, পাওয়া সম্ভব না এই ক’দিনে। কিন্তু যেটুকু পেয়েছি……” রোহিতের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে গেল দেবলীনা।

রোহিতের মুখে সূর্যের নরম আলো পড়ে উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। এমনিতেই ওর চোখের দৃষ্টিতে একটা নম্রতা আছে যা আজকাল বিরল। হয়ত প্রকৃতির মধ্যে থাকলে, পশু পাখিদের প্রতি তটা মমত্ববোধ থাকলে সেটা বেঁচে থাকে ভাবছিল দেবলীনা। সেই আলোক-উদ্ভাসিত মুখটা দেবলীনার কাছে নিয়ে এসে ওর কপালে নিজের কপাল ঠেকাল রোহিত। তারপর কপালে কটা চুমু খেল আলতো করে। তারপরে একটু হেসে সরে এসে গার্ডেন চেয়ারে বসে পড়ল। পুরো ঘটনাটা এত তাড়তাড়িই ঘটে গেল, অথচ ওদের দু’জনেরই মনে হল এমনটা যেন হওয়ারই ছিল।

দেবলীনার যেন নিজেকে মনে হচ্ছিল সদ্য কৈশোর থেকে যৌবনে পা দেওয়া এক তরুণী। প্রেম কিনা ও জানে না, এখনও নিশ্চিত নয়। কিন্তু ভালবাসার এই আবেগ মানুষকে হয়ত এমনই তরুণ করে দেয় বারবার। সেটা ও চেনে।

ও এগিয়ে এসে রোহিতের গলা জড়িয়ে ওর গালে একটা চুমু খেল। আলতো করে নয়, সজোরেই। তারপরে এগিয়ে গেল রাস্তার দিকে।


দার্জিলিং এর পথে বাকি রাস্তাটা ওরা আর কেউ তমন কথা বলল না। দু’জনেই যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। এক ফাঁকে ঝিরঝির করে বৃষ্টিও হয়ে গেল। আবার রোদ উঠল। যেমনটা ওদের মনের উপত্যকায় নানা ভাবনার আলো-ছায়া খেলা করে যাচ্ছিল।

দেখতে দেখতে টুং, সোনাদা, ঘুম পার হয়ে দার্জিলিং এসে গেল। নীল আকাশে মেঘের আড়াল থেকে একটু একটু দেখা দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। এসে গেল সেই ক্লক টাওয়ার।

রোহিত বাইক দাঁড় করিয়ে খোঁজ লাগাল ফোনে দেবলীনার ব্যাগপত্তর কতদূর। ওদিকে দেবলীনার বন্ধুরা কার্শিয়াং পেরিয়ে এসেছে গাড়িতে।

“কোন হোটেল আপনার?”

“হোয়াইট ভিউ।“

“আহা…ম্যাল থেকে রাজভবনের রাস্তায়। বড় সুন্দর জায়গা ওটাই দার্জিলিং এর। আর ওই হোটেল থেকে নীচটা এত ভাল লাগে..."।

একটু চুপ করে থেকে রোহিত আবার বলল-“ এবার আসি তাহলে। ম্যালে তো আর গাড়ি যাবে না। আপনি…সরি, তুমি তাহলে ওদিক দিয়ে এগিয়ে যাও। আমায় ফিরে আবার বাগানের কাজে জুটে যেতে হবে।"

দেবলীনা চুপ করে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডব্যাগ হাতে। একসাথে ভাললাগা আর আলাদা হয়ে যাওয়ার মিশ্র অনুভূতিতে ওর মুখ দিয়ে কথা সরছিল না।

“ আবার দেখা হবে কবে?”, অস্ফুটে বলল ও।

“আবার যখন আপনি আসবেন ম্যাডাম রোহিত বোসের সবুজ দেশে। আসবে তো? তাড়াতাড়ি?”, একগাল হাসি নিয়েও রোহিতের মুখে জিজ্ঞাসা।

বাইকের হাতলে রাখা রোহিতের হাতটায় আলতো একটু চাপ দিয়ে ভেজা চোখটা ঘুরিয়ে নিয়ে ম্যালের দিকে হাঁটা দিল দেবলীনা। জ্যাকেটের হাতা দিয়ে একটু চোখ মুছে নিল কি?

ওকে যতক্ষণ দেখা গেল ম্যালের ভিড়ে হারিয়ে যেতে ততক্ষণ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে সেদিকেই তাকিয়ে ছিল রোহিত। তারপরে ফেরার পথ ধরল।

***********************************************************************

কয়েকদিন বর্ষা শেষে আজ নদীর জল স্বচ্ছ, সবুজ। তাতে সাদা সাদা ফেনা খেলে যাচ্ছে পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে। নদীর ধারে একটা পাথরে বসে রোহিত ওর দূরবীন দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল কোন পাখির খোঁজ পাওয়া যায় কিনা। পাশে ওর ক্যামেরা লেন্সটা রাখা। আজ ও কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে শরীরটা ভাল নয় বলে। আসল শরীরের আর দোষ কি! কাল দার্জিলিং থেকে ফিরেই ওর মনটা ভারী হয়ে আছে। বিশেষত: দেবলীনার বিদায় নিয়ে চলে যাবার সময়ের থমথমে কিন্তু ভারী মায়াবি ফরসা মুখটা ওর মনে এলেই শ্বাসটা বন্ধ হয়ে আসছে। থেকে থেকে সুমনের গানের সেই লাইনটা মনে আসছে-“…জানিনা হৃদয় কেন রাত জেগে পায়চারি করে!” ও অনেকদিনই নিজের এই নারী-বিবর্জিত বন্য, বোহেমিয়ান জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছিল। ওর এই জীবন যে কেউ মেনে নেবে তেমন আশাও ও করত না! কিন্তু দেবলীনা মাত্র ক’দিনেই ওর এই জীবনে একটা ছাপ রেখে গেছে রোহিতের ভাষাতেই। সেই ভাষা রোহিতের চোখ এড়ায়নি।

খুব কিছু পাখি টাখি ও পেল না। ওই সেই বক, কিছু হর্নবিল, উড পেকার। সন্ধ্যা হয়ে এল।

উঠে যাওয়ার আগে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ও দেখতে পেল এক ঘন্টা আগে দেবলীনার একটা মেসেজ এসেছে হোয়াটস অ্যাপে। তাড়তাড়ি সেটা খুলে দেখল ও। “রোহিত, কেমন আছ? কী করছ? মাথার চোটটা কেমন? হয়ত ভাবছ এসে তোমার আর খোঁজ নিলাম না। বন্ধুদের মধ্যে পড়ে তোমার কথা ভুলে গেছি। তবে যদি সত্যিই আমার চোখের ভাষা পড়ে থাক রোহিত, তো বুঝবে তেমনটা হওয়ার কথা নয়। আমি আসলে তোমাকে ফোন করে কথা বলার শক্তি পাচ্ছিলাম না রোহিত। এত আবেগ আর নানান চিন্তা মাথায় ভিড় করে আসছে যে কাকে কী বলব বুঝে উঠতে পারছি না। এখানে দার্জিলিঙে এত হইচইও আমার ভাল লাগছে না। বন্ধুরা সবাই এখন জু’তে গেছে। আমি টায়র্ড এই বলে কাটিয়ে দিলাম। হোটেলের বড় ব্যালকনিটায় বসে তোমায় লিখতে বসলাম। সামনের ভ্যালি থেকে মেঘ উঠে আসছে এই বিকালে। বড় ভাল, বড় সুন্দর চারপাশটা। কত পাখি উড়ে আসছে, উড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, তুমি যদি কাছে থাকতে চিনিয়ে দিতে রোহিত।

রোজকার আমাদের এই জীবন থেকে কত আলাদা পাখিদের জীবন। শুধু পাখিদের কেন, যারা প্রকৃতির কাছে থাকে তাদের জীবন। যেমন তুমি। গত ক’দিন খালি ভাবছি এমন করে তো আগে দেখিনি জীবনকে। দেখতে পারলে হয়ত কত সহজেই আনন্দে থাকা যায় কৃত্রিম সব সংকটকে পরোয়া না করে। আর ভাবছি, কেমন হবে যদি তেমন পথে পা বাড়াই? তুমি তো আছ! পারবে না আমাকে সঙ্গে নিতে?

ভাবছি কলকাতার চাকরি ছেড়ে তোমাদের চা-বাগানের হসপিটালের জেনারেল ফিজিশিয়ানের একটা চাকরি নিয়ে নেব। আমি বাড়ি ফিরেই তোমাদের ম্যানেজারবাবুকে জানাব এই বিষয়ে। নাই বা হল বড় পদ, বছর বছর বাড়তে থাকা মাইনে। মেকি স্ট্যাটাসের মোহ ছেড়ে আনন্দের জীবনে পা বাড়ানোর সৌভাগ্য ক’জনের হয়। যে পথের খোঁজ পেয়েছি তোমার থেকে তা ছেড়ে আসাটা মূর্খামি হবে রোহিত। তুমি থাকবে তো সঙ্গে?

এখন তুমি কি করছ জানিনা। কাজে ব্যস্ত? আমার মন বলছে, তুমি নদীর ধারে আছ। আমি জানি মন ঠিকই বলছে। জানিও আমি ঠিক ভেবেছি কিনা। শুধু এটা না। সবকিছুই। আমি ঠিক ভাবছি কিনা। "

দ্বিতীয় মেসেজ: “তোমার গালে কাল চুমু খাওয়ার স্বাদটা বড় মিষ্টি ছিল। এখনও ঠোঁটে লেগে আছে। ইউ আর এ সুইটহার্ট রোহিত। তোমার পাখিদের মতই।"


মেসেজ পড়া শেষ হতেই মাথার উপরে গাছের ডালে কিচমিচ ডাক শুনে তাকিয়ে রোহিত দেখত পেল সেই একজোড়া স্কারলেট মিনিভেট। পুরুষ ও স্ত্রী। উড়ে উড়ে বসছে এই ডালে ওই ডালে। কত কী কথা বলছে। কী কথা বলছে? ওদের নিজেদের কথা? না রোহিত আর দেবলীনার কথা? পাখিরা সব জানে।


(শেষ)

Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page