top of page

সজারু আর বনরুই-এর সহাবস্থানের প্রথম প্রমাণ মিলল পুরুলিয়ায়

..

আশ্চর্য প্রকৃতি। তাকে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করলে প্রতিদিনই আবিষ্কার করা যায় আশ্চর্য সব ঘটনার সমাবেশ। তেমন এক বিরল ঘটনা উঠে এল গবেষকদের ফিল্ড ওয়ার্কে পশ্চিমবঙ্গেরই বনে। লিখছেন

তক্ষক


আমরা ছোটবেলাতে জীববিজ্ঞান বইয়ের পাতাতে পড়েছি অভিযোজন, অভিব্যক্তি বা বিবর্তনের

নানা ঘটনা। সাথে এটাও বুঝেছি, এই ধরনের ঘটনাগুলি হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা নয়। এইগুলি আস্তে আস্তে সময়ের সাথে ঘটতে শুরু করে। এগুলির কোন চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া অতটাও সহজ নয়। কিন্তু এই বছরেই পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের জঙ্গলে এমনই একটি বিবর্তনবাদের ঘটনার উপর গবেষণামূলক একটি লেখা বের হয়েছে, ভারতের নামকরা গবেষণামূলক পত্রিকা, ‘জার্নাল অফ থ্রেটেন ট্যাক্সা’ - তে।



পত্রিকার নিবন্ধ অনুযায়ী, পুরুলিয়ার জঙ্গলে, সজারু এবং বনরুই, এই দুই স্তন্যপায়ী প্রাণী

একসাথে একই স্থানে বসবাস করছে। যা পূর্বে কখনও দেখতে পাওয়া যায়নি বা লিপিবদ্ধ করা হয়নি।

কিন্তু এটি কেন হচ্ছে, তা জানার আগে, একটু প্রাণী দুটি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক;

প্রথমে আসা যাক, বনরুইতে। বনরুই হল ‘ইন্ডিয়ান প্যাঙ্গোলিন’ (Manis crassicaudata) যা

একটা সময়ে পুরুলিয়া তথা সমগ্র ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে খুবই সহজে দেখতে পাওয়া এক স্তন্যপায়ী প্রাণী। অযোধ্যা পাহাড়ের আদিবাসীদের স্থানীয় ভাষায় (সাঁওতালি) বনরুই-কে বলা হয়, ‘সূর্যমুখী’।



পাহাড়ের স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ-দের থেকে জানা যায়, যেহেতু এই প্রাণীটিকে ধরতে গেলে এটা গুটিয়ে যায়, আর সেই গুটিয়ে যাওয়ার পর এটাকে একদম সকালের সূর্যের মত দেখতে লাগে, তাই এটাকে ‘সূর্যমুখী’ বলে ডাকা হয়। এই প্রাণীটি খুব লাজুক প্রকৃতির; রাতের বেলাতে বের হয় খাবারের সন্ধানে, গর্তে থাকে গভীর জঙ্গলের ভিতরে। এদের থাকার গর্তের সাধারণত দুই দিকে মুখ থাকে (যা একে অপরের থেকে ১০০ থেকে ২০০ মিটার পর্যন্ত দূরে হতে পারে) যাতে একটা দিক দিয়ে কখন কোন প্রাণী থেকে বিপদ বুঝলে অন্য গর্ত দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। এমনকি প্রতিটা দিকেও আরো ৪ থেকে ৮ টা করে ছোট ছোটো গর্ত থাকে, যাতে কখন কোন গর্তের ব্যবহার হবে তা যেন কোনভাবেই বোঝা না যায়। কিন্তু এদের সংখ্যা বিগত কয়েক দশকে খুব বেশিই কমে গিয়েছে পুরো অঞ্চল জুড়ে। তার পিছনে প্রধান কারণ হল, এদের অবাধে হত্যা। গ্রামের আদিবাসী মানুষ আগে (২০০০ সালের আগের কথা) এই প্রাণীটিকে মেরে প্রচুর খেয়েছে। সাথে কিছু কিছু সময়ে এদের গায়ে থাকা শক্ত আঁশকে নানা রোগের থেকে নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করেছে। যদিও বর্তমান সময়ে এই ধরণের কার্যকলাপ অনেক কমে গেছে, কিন্তু একটা বড় সময় ধরে এগুলো চলে আসার জন্য, যে ক্ষতি হওয়ার ছিল তা হয়ে গেছে অনেকটাই। গ্রামের মানুষ, প্রধানত যারা জঙ্গলের উপরে নির্ভর করে নিজের জীবিকা নির্বাহ করে, তাদের থেকে জানা যায়, এই বনরুই-এর সংখ্যা আগের থেকে অনেকটাই কমেছে। জঙ্গলে তাদের আগে যা ব্যাপ্তি ছিল, তার থেকে প্রায় ৯০% কমে গিয়েছে। এখন কিছু কিছু অঞ্চলে, যেগুলো জঙ্গলের খুব ভিতরে আর খুব কম মানুষের আনাগোনা রয়েছে যে সব জায়গাতে, সেখানেই এদেরকে এখন দেখতে পাওয়া যায়। এরা সাধারণত একা থাকতে পছন্দ করে। মাটির ভিতরে গর্ত করে এরা থাকে আর সেই গর্তের একাধিক বেরনোর মুখ থাকে। যাতে কোন ধরণের প্রতিকুল অবস্থায় তারা পালাতে পারে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে। এরা নিজেদের বিপদ বুঝলে সাধারণত গুটিয়ে নেয় নিজেদেরকে।

কারণ এদের গায়ে যে আঁশ থাকে, তা এত শক্ত, যে কোন প্রাণী সেটা ভেদ করে এদের ক্ষতি করতে পারে না। এই রক্ষণাত্মক পদ্ধতিতে তারা জঙ্গলে থাকা নিজেদের সমস্ত শিকারিদের থেকে বাঁচাতে পারলেও, এই পদ্ধতি মানুষের কাছে খুব সহজ করে দিয়েছে তাদেরকে ধরার।

যে সজারু পুরুলিয়ায় দেখতে পাওয়া যায়, তা হল, ইন্ডিয়ান ক্রেস্টেড পরকুপাইন (Hystrix indica)

যা আগে প্রচুর পরিমাণে দেখতে পাওয়া যেত, এখন দেখতে পাওয়া গেলেও বেশ কিছুটা কমে গেছে। এদের গায়ে কাঁটা থাকে যা এরা তাদের শিকারিদের গায়ে ফুটিয়ে দেয়, যখন কোন প্রাণী আক্রমণ করে এদের। তবে একটা ভুল (কুসংস্কার) ধারণা রয়েছে, যে এরা নিজেদের কাঁটা কোন ভাবেই ছুঁড়তে পারে না, তবে এদের এই কাঁটা ঝরে যায় বেশ সহজেই। ঠিক সেই কারণেই বেশিরভাগ সজারুর গর্তের আশেপাশেই তার কাঁটা দেখতে পাওয়া যায়। এই সজারুকে অযোধ্যা পাহাড়ের সাধারণ আদিবাসী মানুষ সাঁওতালি ভাষাতে বলে ‘ঝিক’; ঝিক বলার পিছনে কারণ হল, এরা মাঝে মাঝে নিজেদের শরীর নাড়াতে থেকে, আর সেই সময়, এদের গায়ে থাকা কাঁটা গুলি একে অপরের সাথে ঘষা খেয়ে ঝিক করে একটা আওয়াজ হয়। তাই জন্য সজারুর সাঁওতালি ভাষাতে নাম হল, ঝিক। এরাও রাতেই প্রধানত বের হয় খাবারের সন্ধানে। একটা সময়, এদেরকে খুব সহজেই সারা ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যেত কিন্তু বর্তমানে, এদের বিস্তৃতিও বেশ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। অযোধ্যা পাহাড়ের সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এদের মাংস খাওয়া হয়ে থাকে।

আগে সেটার প্রচলন অনেক বেশি থাকলেও এখন অনেকটাই কমেছে, যদিও লুকিয়ে চুড়িয়ে মাঝে মাঝে যে খাওয়া হয়ে থাকে তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। এরা নিজেদের বিপদ বুঝলে পালানোর চেষ্টা করে, আর শত্রুকে ভয় দেখানোর জন্য তার দিকে পিছন করে কাঁটার গুলোকে সোজা করে আক্রমণাত্মক একটা ভঙ্গি করে। এই আক্রমণ যে খুব একটা বিফল হয় সেটা কিন্তু নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখতে পাওয়া যায়, তাদের শিকারিরা ভালো রকমের ঘায়েল হয়েছে তাদের এই আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে। এরা লেপার্ড (চিতাবাঘ) বা সিংহকে তাদের এই ভঙ্গি দিয়ে কুপোকাত করেছে, তার অনেক ফটো বা ভিডিও একটু ইন্টারনেট খুঁজলেই পাওয়া যাবে। কিন্তু মানুষের মত শিকারিদেরকে শুধু মাত্র এইটুকু দিয়ে আটকানোর চেষ্টা সফল হওয়া বড়ই মুশকিল।


এবারে আমরা একটু দেখে নি, মানুষ কি ভাবে এই দুটি প্রাণীর শিকার করে থাকে। বনরুই-এর

ক্ষেত্রে গর্তের একদিকে, শিকারিরা, শুকনো পাতা, কাঠ ইত্যাদি জ্বালিয়ে ধোঁয়া তৈরি করে আর অন্য

দিকের গর্তে তারা অপেক্ষা করে বনরুই বেরনোর জন্য, আগুন আর ধোঁয়ার জন্য, যখনই বেরিয়ে আসে বনরুই, তখনই তাকে ধরে নেওয়া হয়। আবার অনেক সময়, শাবল আর কোদালের ব্যবহার করে মাটির গর্তকে বড় করে নিয়ে অসহায় বনরুইকে ধরা হয়। অন্য দিকে সজারু যদি মাটির গর্তে থাকে, সেই গর্তকে খুঁড়ে, বড় করে নিয়ে সজারুকে পাথর দিয়ে থেঁতলে দিয়ে সাধারণত মারা হয়ে থাকে। আর যদি, সজারুরা পাথরের খাঁজের মধ্যেকার গর্তে থাকে, তাহলে, সেই স্থানে এমনভাবে ফাঁদ পাতা হয়, যাতে সজারু গর্ত থেকে বের হলেই তার শরীরের কাঁটা গুলো লেগে, ফাঁদের দড়ি কেটে যায়, ফলে উপর থেকে তার শরীরে পাথর পড়ে আর সে পাথর চাপা পড়ে মারা যায়।

এক কথায় বলতে গেলে মানুষের শিকার করার পদ্ধতির কাছে বনরুই-এর রক্ষণাত্মক অথবা

সজারুর আক্রমণাত্মক দুই পদ্ধতিই অকেজো। ফলে এই দুই প্রাণীর চোরাশিকার হয়েছে ব্যাপকভাবে আর দুই প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংখ্যা লক্ষণীয় ভাবে কমতে দেখা গেছে এই অযোধ্যা পাহাড়ে।

গত বছরের প্রথম দিকে এই বনরুই-এর সংরক্ষণের জন্য বনদপ্তরকে একটি প্ল্যান তৈরি করে

দেওয়ার কাজ করার সময়, সরিষা ওয়াইল্ড লাইফ অ্যান্ড ইকোলজি সোসাইটির সদস্যরা জঙ্গলের ভিতরে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করেন। তারা দেখেন, একই সাথে সজারু আর বনরুই একসাথে পাথরের খাঁজে একই গর্তে বসবাস করছে। তাদের এই পর্যবেক্ষণকে তারা গবেষণা-পত্র হিসাবে তুলে ধরেছেন, ‘জার্নাল অফ থ্রেটেন ট্যাক্সা’ -তে, যা এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়েছে।

এই সদস্য দলের এবং প্রকাশিত হওয়া গবেষণা পত্রের প্রথম এবং প্রধান লেখিকা, দেবস্মিতা

সিকদার-এর সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের দলের ধারণা এই ধরণের সহাবস্থান এই দুই প্রাণীর ভিতরে হওয়ার পিছনে প্রধান কারণ হল, একটা সময়ে যথেচ্ছভাবে তাদের শিকার হয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে হয়ত এখনও সকলের অজান্তে কিছু কিছু শিকার হয়ে চলেছে, তাই এই দুই প্রাণী বুঝেছে, যদি এদের প্রজাতিকে এই অঞ্চলে টিকিয়ে রাখতে হয়, তাহলে সহাবস্থান করতে হবে। এই ধরণের সহাবস্থানে একদিকে যেমন সজারুর সুবিধা হচ্ছে, কারণ বনরুই-এর শরীরে শক্ত আঁশ থাকায়, যদি সজাররু জন্য যদি কোন ফাঁদ থাকে, তাতে বনরুই-এর কোন ক্ষতি হবে না, তার শক্ত আঁশ তাকে রক্ষা করবে উপর থেকে পড়া পাথর থেকে। আর এতে ফাঁদে সজারুর পরার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে।

অপর দিকে পাথরের ভিতরে থাকার জন্য সহজে শিকারিরা (মানুষ), প্যাঙ্গোলনিকে গর্ত খুঁড়ে বার করতে পারবে না বা কোন ধরণের আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া করেও তার শিকার করতে পারবে না। কারণ পাথরের খাঁজের গর্ত দেখে তাতে বনরুই আছে কি না তা বলা খুব কঠিন, সাথে অনেক ক্ষেত্রে এই খাঁজগুলি পাথরের ভিতরে আসলে কেমন বিন্যাসে আছে, সেটা বোঝাও প্রায় অসম্ভব। আর পাথরের খাঁজে স্থান পেয়ে যাওয়ায় মাটিতে গর্ত খুঁড়তে তাকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হচ্ছে না। ফলে সা খাদ্য সন্ধানে, প্রজনন ও বাচ্চা প্রতিপালনে বেশি সময় পাচ্ছে। এই ধরণের সহাবস্থান, আমাদের জীবন বিজ্ঞানের বইয়ে পড়া অভিযোজনের একটা চাক্ষুষ প্রমাণ।




লেখক বন্যপ্রাণী গবেষক।



Comments


472988974_1066719631921628_7123774556652206934_n.jpg
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG

Editor: Dr. Sumanta Bhattacharya
Co-editor: Dr. Oishimaya Sen Nag

  • Facebook

follow our facebook page to stay updated

© 2021 by Boney Pahare. All rights reserved.

bottom of page