সম্প্রতি রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে ঘটে গেল একটি মা হাতির নৃশংস মৃত্যু। তাও বনদপ্তরের নিয়োজিত হুলা পার্টির হাতে। এছাড়াও বারবার হাতিদের উপর ঘটে চলেছে সেখানে নানা উৎপীড়নের ঘটনা। এই নিয়ে আবার কলম ধরলেন বনেপাহাড়ের পাতায় হাতি নিয়ে গবেষক ও সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ দিয়া ব্যানার্জী।
বাঁকুড়ায় হাতি-মানুষ সংঘাতের একটি ছবি। আগুন ছুড়ে দেওয়া হয়েছে শিশুসহ মা হাতির দিকে। ২০১৭ সালে বন্যপ্রাণী চিত্রগ্রাহক ও বাঁকুড়ার বাসিন্দা বিপ্লব হাজরার তোলা এই ছবিটি সারা বিশ্বে ছড়িয় পড়ে ও এই সঘাতের কুৎসিত দিকটি সামনে আর একবার তুলে ধরে। এই ছবিটির জন্য বিপ্লব হাজরা বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন। তবে তাঁর আক্ষেপ যে, এত বছর হয়ে গেলেও এই সমস্যা সেই তিমিরেই থেকে গেল।
হুলা পার্টির হাতে নিহত একটি হাতি। আর এক স্থানে একটি সদ্য মা হওয়া হাতিকে তার বাচ্চাসহ ভরা বর্ষার নদী পার কর তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে উন্মত্ত জনতা। দুটি ছবিই ঝাড়গ্রামের।
পিছন দিকে তাকিয়ে দক্ষিণবঙ্গে এই মানুষ-হাতি সম্পর্কের ইতিহাসটা ঝালিয়ে নেওয়া যাক। প্রায় ২০০ মত হাতির যে যাতায়াতের পথগুলি ছিল বাংলা, ঝাড়খন্ড ও ওড়িশার মধ্যে তা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে নানারকম বাধা তৈরি করে ও পরিখা খনন করে। ফলে এদের মূল যে দলটি তা ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়াতেই আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে। ১৯৮৪ সালে জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্টের উদ্যোগে যেভাবে
বনসৃজনের নামে মহাভুল হয়ে গেছে এসব জায়গায়, তার ফলে এখানকার স্বাভাবিক যে অরণ্যভূমি ও তার সাথে সাথে চরে খাওয়ার স্থান ও জলাভূমিগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে। পড়ে রয়েছে স্বল্পই কিছু বিচ্ছিন্ন অরণ্য ও জলের উৎস এই হাতিদের জন্য। কিন্তু টিকে থাকার লড়াইতে হাতিদের মত এত বুদ্ধিমান জানোয়ারদের কি এত সহজে পরাস্ত করা সম্ভব ? তারা খাবার আর জলের উৎস খুঁজে নিয়েছে এইসব এলাকার চাষের জমিতে আর তাতে ওদের দিব্যি চলেও যাচ্ছে। কিন্তু সংকট দেখা দিচ্ছে এখানকার প্রান্তিক মানুষদের। তাদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে হাতিরা বারবার। একে অপরের প্রতি সহিংস আচরন বেড়ে চলেছে।
হাতি নিয়ে লেখকের অন্য রচনা: হাতি ও মানুষ: সংঘাত থেকে সহাবস্থানে
দুর্ভাগ্য এটাই যে বন্যপ্রাণীদের দায়িত্ব যাদের সেই বনবিভাগ এই অশান্তির আগুনে আরও ইন্ধন যোগাচ্ছে তাদের কাজকর্মের মাধ্যমে। এই সমস্ত সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত যেসব সমাধান অন্যান্য কিছু রাজ্যে নেওয়া হচ্ছে তেমনটা তারা না ভেবে হুলা পার্টির উপরে নির্ভর করছে। স্থানীয় লোকদের থেকে এদের নির্বাচন করা হয়। নানা যৌতুক, মোবাইল আর হুলা নামক একটি লোহার দন্ড এদের দেওয়া হয় এই কাজে টানতে। এরা সব জায়গা থেকে হাতিদের তাড়িয়ে বেড়ায়, এমনকি জঙ্গল থেকেও। এদের ব্যহার করা হুলার মশালে হাতিদের মৃত্যু ও আহত হবার ঘটনা ঘটছে। এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের এই মনোভাবের ফলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে দিনদিন। তারা সেই অর্থে তাদের স্ট্র্যাটেজিতে কোন পরিবর্তন আনতে চাইছে না বা এই নিয়ে কোন এন জি ও যারা বন্যপ্রাণ নিয়ে কাজ করে তাদের সাথে আলোচনাতেও যাচ্ছে না। কেউ কেউ ভাবছেন দক্ষিণবঙ্গের এই ২০০ হাতির কোন ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু তা হতে পারে না। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আমরা হাতিদের কৃষিজমি থেকে দূরে রাখতে পারি বেড়া দিয়ে , তাদের বসবাসের জন্য বাস্তুতন্ত্রের উন্নতি করতে পারি।
হাতি নিয়ে লেখালেখি: হাতি-মানুষে সংঘাত: কর্ণাটক জোর দিচ্ছে হাতিদের যাতায়াতের স্বাচ্ছন্দ্যে
এভাবে খাদ্যের জন্য হাতি- মানুষে সংঘাত কমে আসতে পারে। আর যাই হোক স্থানীয় মানুষ এখনও হাতিকে দেবতার স্থান দেয়। এভাবে এগুলো পরিবর্তন আসতে পারে। তবে তাতে সময় দিতে হবে, কারণ মানুষ ও পশুর ব্যবহারে পরিবর্তন আসাটাও সময়সাপেক্ষ।
লেখক পরিচিতি: দিয়া ব্যানার্জী একজন পরিবেশবিদ ও সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ। Uttarayan Wildlife এর প্রতিষ্ঠাতা ও ডিরেক্টার, Nature Mates এর গভর্নিং বডির সদস্য এবং Human & Environment Alliance League - HEAL এর পরামর্শদাতা।
Comments