বনবিভাগের কাজে জড়িয়ে থাকে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গের বনবিভাগে কাজ করা আমলার কলমে উঠে আসছে তেমন কিছু সরস গল্প একের পর এক বনেপাহাড়ের পাতায়। তেমনই কিছু অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন পশ্চিমবঙ্গের Chief Conservator of Forests লিপিকা রায়।
“তুমি যাও বঙ্গে, কপাল যায় সঙ্গে” প্রবাদ একেবারে সার্থক প্রমাণিত হল আমার নদীয়া জেলায় বিভাগীয় বনাধিকারিক (Divisional Forest Officer)হয়ে আসার কিছুদিনের মধ্যেই। হাতি আমার পিছু ছাড়ে না, যেখানে যাই সেখানে সে হাজির।
নদীয়া জেলার DFO কে নদীয়া আর মুর্শিদাবাদ দুই জেলাই দেখতে হয়। মুর্শিদাবাদ জেলার প্রত্যন্ত এক এলাকা হল বাগদাবরা। এখানে রয়েছে এই জেলার বহু পুরোনো এক শাল জঙ্গল যা একেবারে উত্তর পশ্চিমে সরু হয়ে গিয়ে বিহারের শাল জঙ্গলের সঙ্গে মিশে গেছে। বহরমপুর সদর থেকে বাগদাবরা যাওয়া ছিল এক পর্ব ।
অসম্ভব খারাপ রাস্তা, রাস্তাই প্রায় বলা চলে না এত বড় বড় গর্ত। মাঝে অনেকটা বিহারের পাকুড় এলাকার মধ্যে দিয়ে যাওয়া। কয়লা ভর্তি ট্রাক কালো ধুলো উড়িয়ে ওই গর্তের উপর দিয়ে চলেছে লাফাতে লাফাতে। আমাদের ড্রাইভার এক মুহুর্ত অসতর্ক হলে ট্রাক আমাদের গাড়িকে ধাক্কা মেরে পিষে বেরিয়ে যেতে এক মিনিট ও ভাববে না, কারণ বেশির ভাগ ট্রাকের কাগজ পত্র ঠিক নেই বলে ওরা সরকারি গাড়িকে সন্দেহের চোখে দেখে।
গরমকালে ধূলি ধুসর হয়ে যখন বাগদাবরা পৌঁছনো যাবে তখন বন বিশ্রামাগারে দু দণ্ড জিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। কারণ বিদ্যুতের লাইন যায় নি, তাই পাখার ব্যবস্থা নেই।যাই হোক, বনবিভাগের লোকজন কিছুতেই হাল ছাড়ার পাত্র নয়। তাই ওখানে কুয়ো কাটানো হয়েছিল কোনো কালে, তার ভারি মিষ্টি জল আছে, হাতপাখা আছে, একটা কাঠের চৌকি আর একটা কাঠের চেয়ার আছে। আর আছে কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করা গুটিকতক স্টাফ। এত কিছু বলা এই জন্যে যে আমাদের মত দু'পেয়েদের কাছে এইগুলো সমস্যা, চারপেয়েদের কাছে এগুলো কিছুই না। তাদের চলার জন্য জঙ্গল ঢাকা পথ টি পেলেই হল। পথে কিছু গাছের ছায়া, জল এসব পেলে তারা যেদিকে দু'চোখ যায় রওনা দিয়ে যেখানে ইচ্ছে পৌঁছে যেতে পারে। রাস্তায় দু-একটা দু'পেয়ে সামনাসামনি এসে গেলে একটু তেড়ে যাওয়ার ভাব করলে যারা অজ্ঞান হয়ে যায় আর ছোট্ট একটু ধাক্কা দিলে যারা অক্কা পায়, তারা যে এক্কেবারে যা-তা এই নিয়ে ওদের কোনো সন্দেহই নেই।
কাজেই এক প্রচণ্ড গরমের দিনে দুপুর বেলা খবর এল বাগদাবরার দক্ষিণ পশ্চিম দিকে এক গ্রামে একটা পুকুরে নাকি দুটো হাতি কে স্নান করতে দেখা গেছে। বোঝাই যাচ্ছে যেতে যেতে হঠাৎ রাস্তায় জল দেখে “ চান পেয়ে গেছে”।
আমার বিভাগীয় সদর দপ্তর ছিল কৃষ্ণনগর। আমি “সর্বনাশ” কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে রেঞ্জ অফিসার
বললেন,“ম্যাডাম সর্বনাশ শুধু নয়, সাড়ে সর্বনাশ যাকে বলে। তার মানে বিহারের forest track দিয়ে বাগদাবরা হয়ে ওই দুটো ঢুকেছে ।ওই গ্রাম গুলোতে খুব ঘন জনবসতি, গাছপালা খুব কম, আমরা পৌঁছতে পৌঁছতে তো হাতি পুকুর থেকে উঠে লোক মারতে মারতে বেরিয়ে যাবে”।
এখানে বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বীরভূমের মত রোজকার হাতির আনাগোনা নেই, এদিককার লোক হাতির সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে কিভাবে টিকে থাকতে হয় জানে না। এদিকে সবচেয়ে কাছের “হুলাপার্টি” আসতে পারবে বীরভূম থেকে, আসতে ছয় ঘণ্টা কমপক্ষে। বিহারের ডিএফও কে জানাতে হবে। উপরমহলে জানিয়ে অনুমতি নেওয়ার ও ব্যাপার আছে। জেলাশাসক কে জানাতে হবে, তিনি ব্যবস্থা করবেন “law and order” ঠিক রাখার।
ভাবনাচিন্তা ছেড়ে এবার কাজে লেগে পড়ার পালা।২০০৭ সাল। মোবাইল ফোন এসেছে ঠিকই । কিন্তু তাতে ছবি বা GPS location দূর অস্ত। ফোনাফুনি করে ঠিক হল বিহারের দিকে বিহার বনবিভাগের লোকজন থাকবে আর এদিকে আমরা। বীরভূম থেকে হুলা পার্টি রাত্রে ট্রাকে রওয়ানা হবে, আর আমরা শেষরাতে গাড়িতে।
রাস্তার কথা তো বলেছি আগেই। আমরা আমাদের ধারণা মত অকুস্থলের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছি এরকম মনে হচ্ছে, বেশ রোদও উঠে গেছে। হঠাৎ নজরে এল সামনে যেন একটা মেলা বসেছে। এরকম মেলা গ্রামের দিকে আমরা হামেশাই দেখতাম। ভোররাতে কাজ সেরে ফেরার সময় গ্রামে মেলা বা যাত্রা হচ্ছে দেখে আমরা ঢুকে যাত্রা দেখে চা টা খেয়ে ফিরেছি, এরকম অনেক বার হয়েছে। এখানে মাইক চলছে না, কাজেই যাত্রা নয়।
“ম্যাডাম, নিশ্চই মেলা বসেছে, চা খেয়ে যাবেন? পৌঁছে তো আর কোনোদিকে তাকানোর টাইম পাবেন না” । আমার চাতক বৃত্তির কথা কারো অজানা নয়, কিন্তু গরম কালে কিসের মেলা, সকাল ন'টা নাগাদ?”
“ও দাদা , কিসের মেলা, কবে থেকে চলছে দাদা?” আমার জিজ্ঞাসু ড্রাইভার যাকে প্রশ্ন করল তার মাথায় ছাতা , অন্য হাতে পুঁচকে ছেলের হাত ধরা , তার হাতে ২টো বেলুন। সামনে তাকিয়ে ব্যাপারটা কেমন সন্দেহ জনক লাগলো। ঝালমুড়ি, বেলুন, আইসক্রিম, রঙ্গিন শাড়ি, কালো ছাতা, চ্যাঁ ভ্যাঁ র মধ্যে শুনতে পেলাম, “ওই যে দাদা হাতি নেমেছে না? তাই আমরা দেখতে এসেছি”।
"অ্যাঁ…"ছাড়া আমার গলা দিয়ে আর একটাও আওয়াজ বেরল না।
সামনে তাকিয়ে দেখলাম যে প্রচণ্ড চেঁচামেচিটা হচ্ছে, সেটা হুলা পার্টির সঙ্গে গ্রামের লোকের। আমায় দেখতে পেয়ে তিন চার জন হুলা পার্টির লোক কোনো রকমে ভিড় ঠেলে এসে প্রায় কান্নাকাটি জুড়ে দিল, “ম্যাডাম, এরকম আজব জায়গায় কোনোদিন আসিনি, আমরা হাতি তাড়াবো, আমাদের যেতে দিচ্ছে না, বলে আমরা হাতি দেখব”।
সাঙ্ঘাতিক অবস্থা । ফোনে যোগাযোগ করে বোঝা গেল মেলার ভিড়ের এক মাথায় পুলিশ আর বাগদাবরা বীটের কয়েকটি স্টাফ, এক মাথায় আমরা, মাঝে হুলা পার্টি, পাশে পুকুরে হাতি।কয়েকজন ফুলের মালা ও নিয়ে এসেছে হাতি কে পরাবে বলে। কয়েকজন বেচারা পুলিশ আর ফরেস্ট গার্ড পুকুরটা ঘিরে রেখেছে বলে কিছু লোকের সাথে তাদের বচসা হচ্ছে, কারণ তারা পুকুরে নেমে হাতির গায়ে হাত বোলাতে চায়।
গাড়ি থেকে মাইক নামল, চেঁচিয়ে আমাদের গলা ব্যথা হয়ে গেল, পুলিশ অফিসারের গাড়ি থেকে লাঠি নামল, “মৃদু লাঠিচার্জের” আদেশ হল, কিন্তু সূচ গলার জায়গা দিতে কেউ রাজি নয়। পুলিশ, হুলা পার্টি সবার সাথে সবার ভারি ভাবও হয়ে গেল, কিন্তু কাজ এগলো না। কলকাতার হেড অফিস থেকে ঘড়িঘড়ি ফোনের জবাবে আমার “হ্যাঁ, মানে স্যার, চেষ্টা চলছে, সবাই খুব সহযোগিতা করছে…” ছাড়া কিছু বলা যাচ্ছে না।
“এটা সহযোগিতা ম্যাডাম?” বয়স্ক রেঞ্জ অফিসার ধুলোয়, খিদেয় জর্জরিত।
“ আরে সহযোগিতা ছাড়া আবার কি? যাই হোক এখন ও পুকুরে নেমে তো পড়ে নি কেউ?” কথা টা শেষ হওয়ার আগেই সমস্বরে “গেল, গেল” রব। পুকুরের পাড় থেকে স্লিপ করে পা পিছলে দুজন সোজা পুকুরে হাতির চরণে সমর্পিত।
“মরে নি, মরে নি”….দ্বিতীয় আওয়াজটা শুনে ফাঁকফোঁকর দিয়ে দেখি, দুজন নয়, চারজন কাদামাখা প্রাণী দেখা যাচ্ছে, বাকি দুজন, দুই ফরেস্ট গার্ড, যারা নিজের জীবনের কথা এক সেকেন্ড ও না ভেবে ঐ দুই অর্বাচীন কে জল থেকে তুলতে হাতির পায়ের তলায় ঝাঁপ মেরেছে।
এবার আর “মৃদু” নয়, “জোরালো লাঠিচার্জের” আদেশ হল, আমরা সদলবলে যখন পুকুরের কাছে পৌঁছলাম, তখন প্রায় বিকেল।সামনে দেখা গেল জনতার বেশীর ভাগের হাতে ইটের টুকরো, যারা হটাৎ আসা অতিথিদের ইট মেরে মেরে জ্বালাতন করেছে এতক্ষণ। আর হাতি দুটো মনে হয় “দুটো হাত পা থাকলেই কি মানুষ হয়” এই ভেবে ওদের পাত্তাই দেয় নি, না হলে কি হতে পারত ভাবলে প্রাণ উড়ে যায়।
লাঠির বাড়ি পিঠে পড়া, আমাদের অক্লান্ত ভাবে মাইকে চেঁচানো আর সন্ধ্যে নেমে আসা সব মিলে এবার ভিড় ফাঁকা হতে শুরু হল। আমরা চটপট 'position' নিলাম। হাতিদুটোও খায়নি সারা দিনে, আমাদের অবস্থা তথৈবচ।আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে এল, ঝিকমিক জোনাকি জ্বলা শুরু হল।হুলাপার্টি হুলা জ্বালানোর তোড়জোড় শুরু করল। হঠাৎ ফিসফাস “ সরে আসেন ম্যাডাম, এই এদিক বাগে আগুন জ্বালা, এদিকে আসতেছে যে রে”। আমার হাতটি ধরে এক টান দিয়ে হুলা পার্টির এক ছেলের, “ স্যার দেখেন, পুকুর থেকে উঠতেছে, পিছনবাগে আসেন” ।
তা’ “পিছনবাগে” গিয়ে হুলার আলোয় দেখলাম, হেলেদুলে দুটি তে পুকুর থেকে উঠল, তারপর মাথাটি ঘুরিয়ে যে ডাকটা ছাড়ল, তা আমার “বৃংহণ” বানান ভুলে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। এর পর খানিকক্ষণ ফোঁসফোঁস
আওয়াজ।
“ আমদিগরে গাল দ্যায় স্যার” (আমাদের গালাগালি করছে)।
“তা গাল দেবে না তো কি করবে? কি জ্বালানো জ্বালিয়েছে এখানে লোকে ওদের, সেটা ভাবো”?
আমার গজগজানির মধ্যেই দুই গজরাজ ই সোজা জঙ্গলের রাস্তা ধরল। ভাবখানা এমন যে- “ফুঃ, তোরা আমায় তাড়াবি, তারপর যাব নাকি? স্নান হয়ে গেছে, তাই চললাম রে হতচ্ছাড়ার দল”।
লেখক পরিচিতি: লেখক পশ্চিমবঙ্গের বনবিভাগের Chief Conservator of Forests পদে কর্মরত।
Comments