top of page
  • ..

হাতি ও মানুষ: সংঘাত থেকে সহাবস্হানে

হাতি বিশাল এক জন্তু। ভারতের প্রায় সর্বত্র আমাদের সংস্কার অনুযায়ী দেবতা জ্ঞানে পুজো পেলেও , বর্তমান সময়ে জনসংখ্যার বিস্ফোরণের দেশে বারবার সংঘাতের খবর পাওয়া যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কেমন সেই সমস্যার মাত্র, সমাধানই বা আসতে পারে কোন পথে? বনেপাহাড়ের পাতায় আলোচনার পাতায় হাতি নিয়ে গবেষক ও সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ দিয়া ব্যানার্জী



ছবি: Ksuryawanshi / Wikimedia Commons


আমি এমন একজন কর্পোরেট জগত থেকে আসা ব্যক্তি, বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত প্রথাগত শিক্ষা আমার ছিলনা। আমার পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র, জীবজন্তু , তাদের সাথে সহাবস্হান -এগুলি নিয়ে কাজ করার যে তীব্র 'প্যাশান' গত১৫ বছরের বেশি সময়ধরে তৈরি হয়েছে তারফলে আমি ভারতজুড়ে অনেক শ্রেষ্ঠ জীববৈজ্ঞানিক, সংরক্ষণবিদ, বৈজ্ঞানিকের সাথে কাজ করেছি। এই জগতে আমার শিক্ষা মাঠে-ঘাটে ও তারবাইরে সেরা ব্যক্তিদের হাত ধরে হয়েছে।

এই প্রবন্ধটি আমার 'ফিল্ড-নোট' এবং স্হানীয় লোকজনের ও জীববৈজ্ঞানিকদের থেকে শেখা এবং গবেষণাপত্র থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতার ফসল যেখানে খোলাখুলি আমার মতামত ব্যক্ত করেছি, কিভাবে আমি হাতি ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক দেখেছি ও অনুভব করেছি। এখানে একটা কথা বলার 'পারস্পরিক সম্পর্ক' শব্দবন্ধটি 'দ্বন্দ্ব' শব্দটি ব্যবহার করার থেকে শ্রেয়, কারণ পরের শব্দটি মাঠে ঘাটে কাজ করার ক্ষেত্রে একটা প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ, কারণ মানুষ ও জন্তুদের মধ্যে অনেক সহযোগিতার ঘটনাওতো আমরা দেখেছি।ভারত তো এক আশ্চর্য দেশ যেখানে এত বিপুল জনসংখ্যা সত্ত্বেও বাঘ, হাতি, লেপার্ড, সিংহ, গন্ডার, গাউর সহ আরও কত স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাস যেখানে রয়েছে অনেকগুলি টাইগার রিজার্ভ, জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্যের সুরক্ষিত বনাঞ্চল।


আশ্চর্য ও অলৌকিক


অনেক অনেক উপজাতি সম্প্রদায়, আধা শহর ও গ্রামে থাকা মানুষজন যারা বনাঞ্চলের আশেপাশে রয়েছেন যুগ যুগ ধরে, বন্যপ্রাণীর সাথে সহাবস্থানের নজির রেখেছেন চিরকাল। যদিও আমরা জানি যে, আদিবাসীরা শিকার করেন, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা খাদ্যের জন্য এবং অল্প, সহনীয় মাত্রায় (যদিও ধর্মীয় সংস্কার বশত: বিশাল সংখ্যায় শিকারের ঘটনারও নজির রয়েছে)।

মানুষেরা একই সাথে সমস্ত প্রকার জীবজন্তুকে ভয় ও শ্রদ্ধা করে আমাদের ধর্মে।আমাদের ধর্মগ্রন্থে তাদের বিশেষ উল্লেখ রয়েছে বেদ সহ বিভিন্ন শাস্ত্র অধ্যয়ন করলে তা বোঝা যায়। ‘Sacred Animals of India’ বইতে আমরা দেখছি বলা হয়েছে-' মানুষ ও জীবজন্তু সৃষ্টির শুরু থেকেই এক সাথে আছে, কখনও মিলিত সহাবস্থানে, কখনও শত্রুতার পরিবেশে, যেহেতু তাদের জীবনধারনের উপকরণগুলি প্রকৃতিতে সীমিত। মাংসাশী জীবদের শক্তি, বেগ ও পরাক্রম ভয়ের কারণ ছিল ও তাকে জয় করতে হত।মানুষের মস্তিষ্ক সেইসব উপায় বার করেছে যার দ্বারা জীবজগৎকে জয় করা যায় এবং এটাই সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিস্তার ঘটায়। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের প্রতি ভয় ও শ্রদ্ধায় সে ভগবানের পরিণত হয়, তাকে পুজো করে।" [Krishna, Nanditha (2014-04-30T22:58:59.000). Sacred Animals of India.]

আমি তো ব্যক্তিগতভাবে আমাদের প্রথাগত সংস্কার ও বিশ্বাসকে অনেকটাই গুরুত্ব দেব এই মানুষও জীবজন্তুর সহাবস্হানের পিছনে। বাঘ ও লেপার্ডের মত জানোয়ার আত্মগোপনে দক্ষ বলে তাদের সাথে মুখোমুখি সংঘাতের ঘটনা অনেকটাই কম, সুন্দরবনের মত স্হান যদিও ব্যতিক্রম। কিন্তু হাতির কথা বলতে বসলে তা বলা যায় না যেহেতু বড়সড় স্হান দখল করে থাকা এই প্রাণীটি দিনে কয়েক কিলোমিটার পাড়ি দেয় আশ্রয় ও খাদ্যের খোঁজে যা মানুষেরও আওতার মধ্যে পড়ে অনেক সময়।হাতি এমন একটা জন্তু যাকে শুধু শ্রদ্ধার চোখেই দেখা হয় না, তাকে ভগবান হিসাবে পুজো করা হয় কখনও গণেশ কখনও মহাকাল রূপে। আমরা সেই জন্তুর কথা বলছি যে যথেষ্ট বুদ্ধি ধরেও নিজেদের যোগাযোগের শক্তিশালী উপায় রয়েছে তাদের মধ্যে, রয়েছে পর্যবেক্ষণ শক্তিও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা যার দ্বারা তাদের খাবার সংগ্রহের পথে কোন বাধাকে তারা দূর করতে সক্ষম।

আমি স্থানীয় মানুষও অন্যদের থেকেও এই বিস্তৃত ধারনাটা সম্পর্কে শুনতে পাই যে, জঙ্গলে খাবারের অভাবে হাতিরা ফসলের ক্ষেত ও মানুষের বাড়িতে হানা দেয়। এটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সত্য নয় এই কারণে যে তারা কিন্তু ফসল পাকবার সময়েই হামলাটা করে ক্ষেতে এবং তাহলে বলতে হয় বছরের বাকি সময় কি তারা না খেয়ে থাকে? হাতি নিয়ে ভারত জুড়ে কাজ করা বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী তারা হলে সুযোগসন্ধানী, যারা ধান বা অন্য ফসলের মধ্যে কম কষ্টেই অনেকটা পুষ্টিগুন সম্পন্ন খাদ্যের খোঁজ পায়।

ফসলের ক্ষেতে হানা দেওয়া, কখনও বাড়ি ঘরদোর ভাঙ্গা আটা বা চাল বা স্হানীয়ভাবে তৈরি মদজাতীয় পানীয়র আকর্ষণে- এসব হাতি অধ্যুষিত এলাকায় খুব সাধারণ ঘটনা। এই ধরনের ঝামেলার জন্য তাদের ফসলের ক্ষেত থেকে তাড়ানো থেকে আগুন, কাঁটা তার বা গর্ত দিয়ে তাদের আটকানো তো হয়ই, এমনকি বিদ্যুৎ পরিবাহী অবধি ব্যবহৃত হয়। এই ধরনের ঘটনা থেকে হাতি বা মানুষ কারুরই লাভ হয় না যেহেতু যথেষ্ট পরিমাণে জলের অভাব আছে আমাদের আর পতিত জমির পরিমাণও খুব বেশি।এবং এই ঘটনাগুলো চক্রাকারে ঘটতে থাকে। এগুলোর প্রশমনে যেসব ব্যবস্হা নেওয়া হয় তা সবই প্রায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াজাত।

হাতির কীর্তি। ভেলাপারাই, তামিল নাড়ু। ছবি: Wikimedia Commons

তবুও আমরা তাদের ভালবাসি, প্রার্থনা করি তাদের কাছে এবং অনেক মানুষই এই অত্যাচারগুলো ভগবানের দান বলে মেনে নেন। এতটাই গভীরে প্রোথিত আমাদের এই সংস্কৃতি।

উপরের এই সব ঘটনায় মানুষের মৃত্যু বা ফসলের ক্ষতির পরিমাণ কতটা? তথ্য বলছে খুব বেশি না। তার মানে এইসব ঘটনায় সবটাই ক্ষতিকারক এমনটা নয়।

অনেকেশুনেছে সেই সব কাহিনীযেখানে এইসব বিশাল আকৃতির প্রাণীরা বা ভদ্রলোকেরা (যেমন একবার এক হাইকোর্ট তাদের এই নামে অভিহিত করেছিল) কোন রকম ক্ষতি না করে কোন বাড়ি থেকে খাবার বা মদ তুলে নিয়ে গেছে বা কোন শিশুকে মাদুরে যথাস্থানে রেখে এসেছে।কখনও বা গ্রামের লোকের সাথে বিড়াল- ইঁদুরের মত খেলা খেলার ঘটনা কাউকে না ছুঁয়ে। গ্রামের বৃদ্ধদের থেকে শুনতে পাবেন কেমন তারা তাদের মরশুমের প্রথম ফসল বা পানীয়টা আগেকার দিনে গ্রামের বাইরে মহাকালের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে রাখত এবং হাতির পাল গ্রামে ঢুকত না। তাঁরা এটাও জানাবেন যে, আজকের লোকেরা এই রকম সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে আর তার ফলেই হাতি দেবতা রেগে গিয়ে এমন অনাসৃষ্টি সব কাণ্ড ঘটাচ্ছেন।এমন ঘটনাও জানা আছে যেখানে ফসল নষ্টের ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করা হয়নি দেবতার কোপের ভয়ে।

মহাকালের পুজো। ডুয়ার্স। ছবি: লেখক।

মানুষের মৃত্যুর ঘটনা তখনই ঘটে যদি তারা হঠাৎ করে জানোয়ারদের যাতায়াতের পথে এসে পড়ে আর জানোয়াররাও শঙ্কিত থাকে আক্রমণের ভয়ে। সবসময়ই হাতি বা যে কোন জন্তুর প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় ভয়ে পালিয়ে যাওয়া, কিন্তু কখনও কোণঠাসা হয়ে গেলে তারা আক্রমণে বাধ্য হয়ে যায় মানুষের মত। আমি এখনও এমন কোন জানোয়ার দেখিনি যে কোন কারণ ছাড়াই ক্ষতি করতে চায়। তারা শৈশব থেকেই মানুষের সংস্রব এড়িয়ে চলতে শেখে, তাই যুগ যুগ ধরে চলে আসা সব কথা যে বাঘে মানুষ খায় বা কুকুর মানুষ দেখলে কামড়ায় কোন কারণ ছাড়াই - এগুলো আমাদের বলা বন্ধ করা দরকার।

তাৎক্ষনিকভাবে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া যায় হাতিদের ফসলের ক্ষেত থেকে তাড়াতে তা সাময়িক ফল দিতে পারে। জমি ব্যবহারের উপায় সম্বন্ধে আমাদের ভাবনা চিন্তা করতে হবে যাতে তা এই দ্বন্দ্ব নিরসনে সাহায্য করতে পারে এবং মানুষ ও হাতি উভয়ের উপকার হবে যাতে।আমরা জানি আজকাল ধানের চাষ তেমন লাভদায়ক নয়, বরং তা শুধু হাতি নয়, বুনো শুয়োর এবং অন্যান্য ক্ষতিসাধন করা জীব যেমন ইঁদুরের সমস্যাও ডেকে আনে।তাই জমির ব্যবহার পাল্টানো, জমিতে একাধিক ফসল চাষের ওপর জোর দেওয়া বিশেষত: যেসব ফসল হাতিকে আকর্ষণ করে না, পতিত জমিকে পুনরুদ্ধার, জমি ও জলাশয়ের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করে হাতি চলাচলের করিডরকে বাঁচিয়ে রাখার মত কাজগুলো করতে হবে। এছাড়া ফসলের বীমা ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা তো আছেই।

আমাদের যুক্তি দিয়ে ভাবতে হবে যে, ভারতের মত এত বিশাল জনসংখ্যার দেশে যদি বাঘ বা হাতির মত জন্তু টিকে থাকে অল্পবিস্তর ক্ষতি সহ্য করে- তাহলে বুঝতে হবে যে এখানে মানুষ ও বন্যপ্রাণীতে স্বাভাবিক সহাবস্থানের রীতি রয়েছে এবংমানুষ ও জন্তুর মধ্যে মানিয়ে নেবার ক্ষমতা আছে। আমরা তথাকথিত চিন্তাশীল প্রজাতি এবার সজাগ হয়ে এই ভারসাম্যের বিষয়টি বুঝতে সচেষ্ট হব আশা করি।সমস্ত অতীতের ভুল ধারনাগুলো সরাতে হবে, শিখতে হবে এবং মানুষজনের থেকে শুনতে হবে তাদের সহাবস্থানের ঘটনা সম্পর্কে।বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত পদ্ধতিগুলি অনুসরণ করতে হবে প্রতিক্রিয়ার বশবর্তী না হয়ে।পুরানো প্রথাগত পদ্ধতি ও চিন্তাগুলিকে আবার পুন:স্হাপিত করতেহবে, তাদের পালন করতেহবে।

কর্মস্হলে লেখিকা

আমি Vidya Athreya, Aritra Kshettry এ তার দল, Dharmendra Khandal ও Imran Siddique র কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করব যারা আমায় অনেক শিখিয়েছেন এবং একজন অনুভূতিসম্পন্ন সংরক্ষণবিদ হিসাবে গড়ে তুলেছেন।

ধন্যবাদ হাতি, বাঘ, গন্ডার, লেপার্ডও অন্য জীবেদের তাদের সেরা কাজটা করার জন্য- আমাদের মত জটিল জীবেদের সাথে সহাবস্হানে টিকে থাকা।



লেখক পরিচিতি: দিয়া ব্যানার্জী একজন পরিবেশবিদ ও সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ। Uttarayan Wildlife এর প্রতিষ্ঠাতা ও ডিরেক্টার, Nature Mates এর গভর্নিং বডির সদস্য এবং Human & Environment Alliance League - HEAL এর পরামর্শদাতা।


Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page