পশ্চিমবঙ্গে বন বিভাগে কাজের সাথে জড়িয়ে থাকে বন্য হাতির সাথে মোকাবিলার অভিজ্ঞতা। আর কোন বনবিভাগের অফিসারের ক্ষেত্রে সেই কাজ দিয়েই যদি কর্মজীবন শুরু হয় তবে তা স্মরণীয় হয়ে থাকে তাঁর কাছে আজীবন। তেমনই এক অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন পশ্চিমবঙ্গের Chief Conservator of Forests লিপিকা রায়। তাঁর কলমে উঠে এসেছে পশ্চিম মেদিনীপুরে হুলা পার্টির কাজের নানা তথ্য, তার সাথে সাথে মাঠে ঘাটে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বনবিভাগের কর্মীদের কাজের অভিজ্ঞতা।
১৯৯১ সাল। পশ্চিমবঙ্গ বনেসবায় নির্বাচন আর এর পর দু’ বছর ট্রেনিং পর্ব শেষ করে ১৯৯৩এর জুলাইতে চলেছি মেদিনীপুরে ,একবছর রেঞ্জ ট্রেনিংকরতে। মেদিনীপুর ষ্টেশনে পৌঁছে রিকশাতে চড়ে “ফরেস্ট অফিস চলো” বলা অবিধ আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল না, কিন্তু ছাল-চামড়া ওঠা রাস্তা দিয়ে রিকশা যত এগুতে থাকল, আমার মনটাও ধীরে ধীরে বেশ দমে যেতে লাগল।রাস্তাঘাট কেমন যেন ধুলোপড়া, কে জানে বাবা,অফিসটা কেমন হবে; আসার আগে কারা বলছিল মেদিনীপুরে নাকি খুব মামলা মোকদ্দমা হয়...এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কখন যেন চলে এল ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিস, যেখানে আমাকে কাজে যোগ দিতে হবে।
অপেক্ষা করছিলেন মহেন্দ্রনাথ মাঝি, আমার “ ডিভিশনাল ফরেষ্ট অফিসার”, যার কাছে আমি ট্রেনি অফিসার হিসেবে যোগ দেব। দরাজ গলার আওয়াজ আর হাসিমুখের আপ্যায়নে আমার ধড়ে আবার প্রাণ
ফিরে এল।একে একে কর্মচারীরা এসে পরিচয় করে গেলেন; আমার আগে এই রেঞ্জে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলা WBFS Officer সুমিতা ঘটকের ট্রেনিং হয়েছে।কাজেই Coimbatore State Forest College এ আমাকে দেখে সকলের প্রায় ভূত দেখার মত অবস্থা হয়েছিল- এখানে তা নয়। “ম্যাডাম” নামক বিচিত্র জীবটি দেখে এরা কিছুটা অভ্যস্ত।
রেঞ্জের দায়িত্ব নেওয়ার সময়ই শুনলাম বিহারের দলমা পাহাড় থেকে নেমে আসা হাতির দল মাঝেমাঝেই মেদিনীপুর রেঞ্জের জঙ্গলে এসে ঢুকে পড়ে, থেকেও যায় কিছুদিন। ধান খেয়ে, ঘর বাড়ি ভেঙ্গে যথেষ্ট ক্ষতি করেগ্ রামবাসীদের।হাতি তাড়াতে না পারলে গ্রামবাসীদের রোষ আছড়ে পড়ে “ফরেস্টার”দের উপর।
এরকমই একদিন সকাল বেলার দিকে গ্রাম থেকে লোকজন এসে বলে গেল আমাদের রেঞ্জ সীমানার ভেতর ঢুকে পড়েছে হাতির দল। শুরু হয়ে গেল তোড়জোড়...একজন ছুটল জিপগাড়ি ভাড়া করতে,একজন ছুটল
পেট্রল পাম্পে ব্যারেল করে ডিজেল ভরতে আর দু'জন গ্রামে গেল হুলা বাঁধবার লেবার ধরে আনতে। বস্তা, তার এসব কিনে একেবারে ফিরবে। গুদাম থেকে বার হল প্রায় ৯ ফুট লম্বা লোহার রড ,যার মাথাটা একটু
বাঁকানো...তারই নাম হুলা। দুপুর নাগাদ অফিসের সামনে মোরাম বিছানো রাস্তায় মেলার ভিড়। কেউ বস্তাতে জড়িয়ে হুলা বাঁধছে, কেউ বা ব্যারেল থেকে ৫ লিটারের জেরিকেনে ডিজেল ভরছে, কেউ ডিজেলের মধ্যে
মেশাচ্ছে পোড়া মোবিল যাতে মশাল জ্বালানো ছাড়া আর কোনও কাজে ডিজল কেউ ব্যবহার করেত না পারে। আর মশালও বেশিক্ষণ জ্বলে। হইচই, ধমকচমক, বিড়ির ধোঁয়া, ডিজেলের গন্ধ, ফিস্-ফিস সতর্কীকরণ- “ এই বিড়িটা ফ্যালনা ক্যানে, ম্যাডাম আসছে.."। চারিদিক সরগরম। এর মধ্যে বীট অফিসারকে নিয়ে ম্যাপ খুলে বসে বোঝার চেষ্টা করি কোন জঙ্গলে আছে হাতিগুলো, কোন গ্রাম পড়বে পথে, কোন রাস্তা দিয়ে আমরা ঢুকব, তাড়ানোর চেষ্টা করব কোন দিকে, এমনকি আক্রান্ত হলে “ য পলায়তি” নীতি নিয়ে কেটে পড়ব কোন রাস্তা দিয়ে। মনের মধ্যে চাপা উত্তেজনা, চিড়িয়াখানা ছাড়া আমার হাতির সঙ্গে সাক্ষাত হয়নি কখনও। শেষে দুপুরে সদলবলে ধুলো উড়িয়ে বেরিয়ে পড়া গেল। হাতি খোঁজায় দক্ষ গ্রামবাসীরা জঙ্গলের এক ধারে এসে থমকে দাঁড়ালো। বাতাসে খানিক গন্ধ শুঁকে, খানিক খোঁজাখুঁজি করে তারা জানাল পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। গিয়ে দেখি সত্যিই তাই। শুকনো ধুলোর ওপরেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে গোদা পায়ের ছাপ। আমাদের দলবলও গুছিয়ে নেয়া হয়। সাহসী জোয়ান লোকেরা যারা সামনে থাকবে তারা হুলা তুলে নেয় হাতে, হুলা ধরা যে সে লোকের কর্ম নয়।হাতি তেড়এলে তাকেও হুলা নিয়ে তেড়ে যেতে হবে ভয় দেখাতে, হুলা নিভে আসতে থাকলে ওই অন্ধকারেই নিজর তেলওলা খুঁজে নিয়ে হুলা ভিজিয়ে নিতে হবে।কিছু লোকের হাতে থাকা তার দিয়ে বাঁধা চটে পাকানো বল, আগুন জ্বালিয়ে ওটা বনবন করে ঘোরানো হয়। কারো থলেতে আছে চকলেট বোমা, পটকা—কিছুতেই ধানমাঠ থেকে তোলা না গেলে চার্জ করা হবে; শব্দবাজি তখনো নিষিদ্ধ নয়। ১৯৯৩ তে মোবাইল ফোন ছিল না, আর সব গ্রামে বিদ্যুতও আসেনি, কাজেই সন্ধ্যা নেমে আসা মানেই ঘন অন্ধকার, বিশেষ করে জঙ্গলের ভিতর। থলেতে হাউইও রাখা আছে,কেউ একলা হারিয়ে গেলে,হাউই ছুড়বে। গোটা দুই অয়্যারেলস সেট দেওয়া আছে দুই টিম লিডারের কাছে, আর আছে আট ব্যাটারির টর্চ।
সবাই নি:শব্দে পায়ের ছাপ অনুসরণ করে ঢুকে পড়ি জঙ্গলে। যেতেই থাকি, যেতেই থাকি,অন্ধকার আরও ঘন হয়ে আসে, পায়ের ছাপের অধিকারীদের দেখা মেলে না।অয়্যারলস সেট একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি,কয়েকটা মশাল জ্বালানো হয়েছে। মনে ভাবছি ভরদুপুরবেলা এই জঙ্গলে আমাকে ছেড়ে দিলে নির্ঘাত হারিয়ে যাব, ওরা এই অন্ধকারে পায়ের ছাপ মাটিতে দেখে রাস্তা চলেছ কি করে! হঠাৎ থেমে যায় সামনের লোকগুলো।কান খাড়াকরে শুনি।একটা ক্ষীণ মড়মড় আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না? ফিসফিসানি শোনা যায়, “পাওয়া গেছে ,পাওয়া গেছে, ডাল ভাঙছে মদ্দাটা”। পিলে চমকানো ডাক ছাড়ে হাতি...আঁ আঁ।
আর দেরি নয়, কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই মিলে ঘিরে ধরি দলটাকে। মশালের আলো, হইচই আর মটমট আওয়াজে মনে হচ্ছে রঘু ডাকাতের দল চলেছে গ্রামে ডাকাতি করতে। জঙ্গল পেরিয়ে খোলা জায়গায় পড়তেই আবছা চাঁদের আলো
আঁধারিতে দেখতে পাই দলটাকে। বিশাল পাহাড়ের মত দেহ, কয়েকটার সাদা দাঁতে চাঁদের আলো পিছলে যাচ্ছে।
ছোট ছোট বাচ্চাও আছে সঙ্গে। জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ যেন গজিয়ে উঠেছে ছোট্ট একটা পাহাড়ের শ্রেণী, হালকা নড়াচড়ায় বোঝা যাচ্ছে এ পাহাড় স্তব্ধ আর অচঞ্চল নয়। প্রথম বুনোহাতি দেখার উত্তেজনায় একই সঙ্গে আনন্দ, ভয়, সঙ্গে জঙ্গলের ভ্যাপসা গরমে দরবিগলিত অবস্থা...সব মিলে আমি বাক্যহারা।
কোনমতেই গ্রামে ঢুকতে দেওয়া যাবেনা দলটাকে। আমরা গ্রামের দিকে মশাল দিয়ে আগলে নিয়ে চলেছি। হাঁটতে হাঁটতে আর পায়ে সাড় থাকে না,পা একবার কাদায় পড়ে তো একবার আলে হোঁচট খাই, এইভাবে অন্ধকারে অনেক রাস্তা চলতে থাকি, আবার পড়ল জঙ্গল। জঙ্গলে ঢোকার পর হঠাৎ আর হাতি খুঁজে পাওয়া যায় না,নিকষ অন্ধকার। চাঁদও বিরক্ত হয়ে মেঘের আড়ালে। রাত্রি যখন তিনটে তখন সেদিনের মত অভিযান পরিত্যক্ত ঘোষণা করলাম।সব গুটিয়ে মুড়ি চিবাতে থাকি, গাড়িতে উঠে পড়লাম সবাই। কোয়ার্টারে ফিরে জুতো খুলেই বিছানায়।
সকাল ৮টায় কাজের দিদি সন্ধ্যার হাঁকডাকে ঘুম ভাঙল । "অ ম্যাডাম দিদি, (এটা সন্ধ্যার নামকরণ) ঘুমাও ক্যানে...ওদিকে যে লোক মেলা বসিয়ে দিয়েছে।" তাড়াতাড়ি ছুটি অফিসঘরে। লোকজন বিভিন্ন জায়গা থেকে আসতে শুরু করেছে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিয়ে। শুরু হয়ে গেল আর একটা কর্মব্যস্ত দিন।দুপুর নাগাদ দুগগা বলে বেরিয়ে পড়ি যুদ্ধযাত্রায়। কিছু রাস্তা গিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম হইচই,কান্নাকাটির আওয়াজে। স্টাফরা বলে, "ধানক্ষেতে নেমে পড়েছে ম্যাডাম, আজ আমাদের কপালে দুঃখআছে।" কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখি দাঁত খিঁচিয়ে ছুটে আসছে অনেক লোক, আমাদের উপর মধুর সম্ভাষণ বর্ষণ করতে করতে, "এই যে এসেছেন? তাড়ান এগুলোকে! কালকে থেকে তো ঘুরেইবেড়াচ্ছেন? আর কবে তাড়াবেন? আমাদের সব ধান খেয়ে শেষ করলে?” (যেন আমাদের পোষা হাতি) টিম লীডার ম্যাডামের করুণ মুখ দেখে স্টাফদের দয়া হয়, পাশ থেকে ফিসফিস, বয়স্ক ফরেস্ট গার্ড বলেন , “ ম্যাডাম ,মনে কিছু করেন নাই, মনের দুঃখে বলছ্যা”।
যাদের নিয়ে এত কাণ্ড তাদের ভ্রুক্ষেপ মাত্র নেই, তারা মাথা দুলিয়ে, কান নাড়িয়ে সোনালী ধান দিয় পেট ভরাচ্ছে। উত্তেজিত জনতাকে বোঝানোর চেষ্টা হয়, কিন্তু তারা শুনতে নারাজ, ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দেয়। একদল বলে "দে, মোবাইল ভ্যানটা জ্বালাই দে, একদল লাফিয়ে উঠে পড়ে গাড়ির মাথায়; মাঝবয়সী এক স্টাফের কলার ধরে একজন টান দিতে, আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। আমার বিখ্যাত বাজখাঁই হাঁকটা ছাড়ি। "মগের মুলুক পেয়েছেন নাকি? নামুন গাড়ির ছাদ থেকে, একজনের গায়ে হাত পড়লে, আজ হাতি তাড়ানো বন্ধ। যতক্ষণ গন্ডগোল করছেন, ততক্ষণ আপনারা আমাদের সঙ্গে কাজ করলে হাতিগুলোকে ধানমাঠ থেকে জঙ্গলে উঠিয়ে দেয়া যেত।" বচসা খানিকটা কমে। একজনের গলা পাই, "মেয়্যাছেল্যা অফিসারটো তো ঠিক কথাই বলল"। নামকরণে আমি চমৎকৃত হওয়ার অবকাশ পাওয়ার আগেই জনতা “হো হো …হ্যাটহ্যাট…চল চল বাবা গণেশ” …করতে করতে নেমে পড়ে মাঠে। সঙ্গে আমরাও। আবার শুরু। আধখাওয়া ধান ফেলে হাতির যাওয়ার ইচ্ছে মোটেই নেই। চার্জ করে আসছে, আমরাও লিলিপুটের দল হম্বিতম্বি করছি পটকা ছুড়ে। বাচ্চা হাতি হাঁটতে না পারলে বাচ্চা ছেড়ে দল যাবে না, গ্রামবাসীও গ্রাম বাঁচাবেই, সারা বছরের ধান… "সব যদি তোমরা নাও তো আমাদের বাচ্চাগুলার পেটে কি দুবো, ও বাবা গণেশ?” বাবা গনেশ এবং কোম্পানী কর্ণপাত না করে নেমে পড়ল পাশের পুকুরে। ভাবটা এমন যে "দাঁড়াও…তাড়া কিসের?"
রাত প্রায় শেষ। আজও হোলো না আমাদের উদ্দেশ্য সাধন।। “হতচ্ছাড়ার দল যত, চলুন স্যার”, আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে কোনও স্যারকে দেখতে না পেয়ে বুঝলাম আমিই সেই স্যার, যাকে আজকের মত আবার এখানেই সমাপ্তি ঘোষণা করতে হবে।
এই ভাবে চলল একটানা ছ’দিন। দিনে গ্রামে গিয়ে ক্ষয়ক্ষতির হিসেব আর রাতে হাতির পিছনে…ঘুম নেই আমাদের কারো। হাঁটু অবধি ধুলো ,কাদা। স্নানও ঠিকভাবে করার কারোর সময় নেই।রাতে হয় হাতি তাড়াই, আর হাতি খুঁজে না পেলে মশা তাড়াই। আমার বীট অফিসার ক্ষীণ কন্ঠে দুঃখ করেন, "বুঝলেন ম্যাডাম, ওই যে বলে না হাতি কাদায় পড়লে ব্যাঙেও লাথি মারে…"। আমি হাসি চেপে সান্ত্বনা দিই…( কারা যে কাদায় পড়েছে তাই ভাবি)। মুখে বলি "আর কি করবেন, কেউ খেতেও পারছেনা, দেখছেন না? টাইম নেই…ওই মশার কামড় আর ব্যাঙ-এর লাথিই খান।" চাঁদের আলোয় বেচারার করুণ মুখ খানা দেখে কষ্ট লাগে।
সব খারাপের শেষ আছে। ছ’নম্বর দিন দেখা গেল আমাদের উৎপাতে হাতি যথেষ্ট বিরক্ত, “ধুত্তোর, নিকুচি করেছে তোদের ধানের”…এই ভাব করে চলল গড়গড়িয়ে গরুর পালের মত, পিছনে পাচনের বদলে হুলা হাতে আমরা।
মাঝরাত নাগাদ সেদিন হেডকোয়ার্টার থেকে অয়্যারলেস মেসেজের উত্তরে উত্তর দিতে পারি, “মেদিনীপুর রেঞ্জ বাউন্ডারি পেরচ্ছে, লালগড় জঙ্গলে ঢুকছে, লালগড় রেঞ্জ অফিসারকে অ্যালার্ট করুন, Over”।
লেখক পরিচিতি: লেখক পশ্চিমবঙ্গের বনবিভাগের Chief Conservator of Forests পদে কর্মরত।
অনন্য অভিজ্ঞতার অসাধারণ প্রকাশ। লেখনী র সাবলীলতায় মুগ্ধ হলাম।
ek niswase porlam ...apurbo lekha 😍
Chamatkar lekha. Informative as well as full of humours.