top of page
  • ..

নাগপুরের বনে বুদ্ধদেব গুহ

মহারাষ্ট্রের নাগপুর এমন এক জায়গা যেখান থেকে পৌঁছে যাওয়া যায় দারুণ সুন্দর সব অরণ্যে। আর নাগপুরে রয়েছে বাঙালী সমাজের দীর্ঘ বসবাসের ইতিহাস। ফলত: এমন এক জায়গায় যে বুদ্ধদেব গুহ ছুটে যেতেন বারবার তাতে আর আশ্চর্য কি! সেখানেই তাঁর সফরসঙ্গীদের একজন অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় বনসেবা আধিকারিক শ্রী নীল মজুমদার। তাঁর স্মৃতি ধরা পড়ল বনেপাহাড়ে'র পাতায়।




বুদ্ধদেব বাবুর সঙ্গে আমার চাক্ষুষ আলাপ নাগপুরেই, যতদূর মনে পড়ছে দুহাজার চার কি পাঁচ সালে। তার আগে ওঁর বেশ কিছু লেখা পড়েছিলাম। কিন্তু চোখে দেখিনি, না দূর থেকেও না। আমি কোলকাতা বা তার আশেপাশের অঞ্চলে বড় হইনি। বাংলা ভাষার প্রথিতযশা যে লেখকদের লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি এবং হই তাঁদের চোখে দেখা আমার কাছে ছিল একটা স্বপ্নের মত অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

আমি তখন সদ্য নাগপুরে বদলী হয়ে এসেছি। এল বি হোটেলে বুদ্ধদেব বাবুর সঙ্গে পান ভোজন সহ একটি সান্ধ্য আড্ডায় যোগ দেবার ডাক পেয়েছিলাম। গিয়ে দেখি, খেলা শুরু হয়ে গেছে। সাহিত্য-সঙ্গীত রসিক পনেরো কুড়ি জন যাকে ঘিরে বসে আছেন তিনি গৌরবর্ণ, সুদর্শন, পৃথুল শরীর সাদা চুলের এক ভদ্রলোক, বয়েসের ভার যার শরীরে পড়লেও মনে বা মেজাজে মোটেই পড়েনি। তিনি তখন বেশ দরাজ গলায় গান ধরেছেন, ‘শ্রীমতীর মন, মানেতে মগন, ওখানেতে শ্যাম যেওনা’।

গানের ফাঁকে আলাপ হল, গল্প হল, সেইসঙ্গে লেখালেখি সম্বন্ধে নানা আলোচনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, উনি অত্যন্ত প্রাণবন্ত, রসিক এবং মজলিসী একজন মানুষ। এইরকম একটি আড্ডা জমজমাট করে রাখার জন্যে উনি একাই একশো। যারা ওঁর সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত, তাঁরা একটার পর একটা গান গাইবার জন্যে আবদার করে চলেছেন, আর উনিও হাসিমুখে সকলের সব আবদার মিটিয়ে দিচ্ছেন, একটার পর একটা গান গেয়ে। প্রধানতঃ টপ্পা অঙ্গের পুরাতনী বাংলা গান। অসাধারণ গাইছিলেন। হারমোনিয়াম নেই, তবলা নেই। তাতে ওঁর কোন অসুবিধা হচ্ছে বলেও মনে হলনা। বোঝার উপায় ছিলনা, ওঁর মূল পরিচয়টা কি, উনি একজন জনপ্রিয় গল্প উপন্যাস লেখক নাকি একজন জনপ্রিয় সুকণ্ঠ গায়ক! আরও অনেক পরে আমি ওঁর আঁকা বেশ কিছু ছবি দেখে আশ্চর্য হয়েছি এবং জেনেছি, উর্বর কলমের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি বুদ্ধদেব গুহ একজন সুকণ্ঠ গায়ক তো বটেই, একজন স্ব-প্রশিক্ষিত চিত্রশিল্পীও। মনে আছে, সেই প্রথম আলাপে আমি ওঁকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেছিলাম এবং এই নিয়ে একটু হাসাহাসিও হয়েছিল। পরে কবে থেকে যেন, নাগপুরের অন্য বাঙ্গালীদের মত ওঁকে ‘দাদা’ বলে ডাকতে শুরু করেছি, আজ আর নিজেরই মনে পড়েনা।

আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছি, বুদ্ধদেব বাবু নাগপুরে প্রথম এসেছিলেন, দু’হাজার দুই সালে। নাগপুরের বাঙ্গালী সমাজ কিংবা তাদের সাংস্কৃতিক অবস্থান সম্বন্ধে বিস্তারিত ভাবে লেখার জায়গা এটা নয়। তবে যারা ওয়াকিবহাল নন, তাঁদের জন্যে এটুকু বলা উচিত মনে করি, যে এখানের ‘সারস্বত সভা লাইব্রেরি’, এক’শো চার বছর পুরানো বাঙ্গালীদের প্রতিষ্ঠিত, মূলত: বাঙলা বইয়ের একটি লাইব্রেরি, যা আজও হৈহৈ করে চলছে। এখানের বাংলা এডুকেশন সোসাইটি সে বছর ‘মাতৃভাষার ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব’ এই বিষয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল এবং অতিথি বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকার জন্যে আমন্ত্রণ জানান হয়েছিল সাম্প্রতিক কালের কয়েকজন বাঙ্গালী সাহিত্যিককে। সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে এখানে এসেছিলেন বুদ্ধদেব বাবু। নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে, তাঁর বক্তৃতা ছিল, ২০০২ সালের, ১২ই জানুয়ারি।

নাগপুর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল যে অরণ্য সমৃদ্ধ একথা কারোর অজানা নয়। হাতের কাছেই পেঞ্চ, নাগজিরা, নবেগাঁও। একটু দূরত্বে মেলঘাট, চন্দ্রপুর, তাডোবা, গঢচিরোলি, আলাপল্লী। সুতরাং অরণ্য প্রেমিক বুদ্ধদেব বাবু যে নাগপুরের আকর্ষণে মোহিত হয়ে যাবেন, এতে আর আশ্চর্যের কি আছে!

যতদিন শরীর স্বাস্থ্য ভালো ছিল, মাঝেমধ্যে চলে আসতেন। আর নাগপুর এলে জঙ্গলে যাওয়া চাইই। মনে আছে, একবার আলাপল্লী গিয়ে রীতিমত অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ফুড পয়জনিং। মহারাষ্ট্রের এই গহীন বনাঞ্চলের সঙ্গে যারা পরিচিত, তাঁরা জানেন, এখানে মাথা খুঁড়ে মরলেও কোন মেডিক্যাল হেল্প পাওয়া যায়না। হেমলকশার ছোট একটি হাসপাতাল, প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে। সবচেয়ে কাছের রেল স্টেশন এক’শো কিলোমিটারের চেয়ে বেশি। বলাবাহুল্য, ওঁর সঙ্গে যারা গিয়েছিলেন, তাঁরা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন।

একবার গেলেন চিকলধারা। সেবার আমিও সঙ্গে ছিলাম। মেলঘাটের চিকলধারা সম্বন্ধে আমার একটু ব্যক্তিগত দুর্বলতা আছে। মহারাষ্ট্রে আমার কর্মজীবন একদা এইখান থেকেই শুরু হয়েছিল। অবশ্য তখন চিকলধারা ছিল সাতপুরার ছড়ানো উপত্যকায় নেহাত ঘুমন্ত একটি ছোট্ট জনপদ, আজকের চিকলধারার মত ট্যুরিস্ট হটস্পট হয়ে ওঠেনি। এখানের ফরেস্ট রেস্ট হাউসে বৃষ্টিভেজা এক জুলাই মাসে আমার প্রথম রাত্রে যে গা ছমছমে অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেকথা ওঁকে শোনাতেই হাসতে হাসতে বলেছিলেন, নীল, তুমি এটা কোথাও লিখেছ তো? নইলে আমি কিন্তু লিখে দেব! অত্যন্ত সহৃদয় মানুষ ছিলেন। আমার সঙ্গে অল্পই আলাপ। কিন্তু সেই অল্প আলাপেই খুব অন্তরঙ্গ ভাবে কথা বলতেন। মানুষকে আপন করে নেবার একটা সহজাত ক্ষমতা ছিল।

চিকলধারা পর্যটন বাংলোয় এক সন্ধ্যা। অ্যাডভেঞ্চারের গল্পে মগ্ন আড্ডার মধ্যমণি বুদ্ধদেব গুহ। একেবার ডানদিকে শ্রী নীল মজুমদার।

সেদিন গান হয়নি, সেদিন হয়েছিল আড্ডা, সেদিন হয়েছিল গল্প। জঙ্গলের গল্প, জঙ্গলের নানা এডভেঞ্চারের গল্প। অনেক রাত পর্যন্ত। এইসব আড্ডার সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার ছিল, উনি যে একজন জনপ্রিয় লেখক আর আমরা যে কেউ কিছু নই এটা কিন্তু আড্ডার রকম সকম দেখে মোটেই বোঝা যেত না। উনি আমাদের সঙ্গে আড্ডা মারতেন, মেলামেশা করতেন, সমসাময়িক, সম পর্যায়ের, সম প্রতিষ্ঠার মানুষদের মত।

কথাবার্তায় ওঁর প্রখর স্মৃতিশক্তি দেখে অনেকবার আশ্চর্য হয়েছি। অকিঞ্চিৎকর হলেও খুব ছোট ছোট ব্যাপার লক্ষ্য করতেন এবং এক অদ্ভুত দক্ষতায় সব মনে রাখতেন। আর একটা গুণ (এমনকি, অবগুণও বলা যায়) উনি ছিলেন একজন নিখাদ স্পষ্টবাদী। যা ঠিক বা সত্যি বলে মনে করতেন, সামনের মানুষটা কি ভাববে, কি মনে করবে, এসবের তোয়াক্কা না করে নির্ভেজাল ভাষায় সেটা বলতে একটুও দ্বিধা করতেন না। ওঁর দেওয়া বিভিন্ন সময়ের সাক্ষাৎকার যারা পড়েছেন, তাঁরা আমার সঙ্গে অবশ্যই একমত হবেন।

আমি বেশ কয়েকজন তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের চিনি, যারা জঙ্গলে যান, খানদান, ফুর্তি করেন, স্টাফদের দাক্ষিণ্য সানন্দে গ্রহণ করেন। ফিরে এসে বলেন, ফরেস্টের লোকরা খুব ‘করাপ্ট’! এই মানসিকতা থেকে শত সহস্র মাইল দূরে বুদ্ধদেব বাবুর অবস্থান। একজন উঁচু মনের মানুষ ছিলেন উনি। সত্যিকারের একজন নিরহঙ্কার ভদ্রলোক।

আপাত দৃষ্টিতে আমুদে, আড্ডাপ্রিয়, সদাহাস্যময় এই মানুষটির ভেতরে কিন্তু একটা স্পর্শকাতর কোমল মন ছিল। এক দুপুরের কথা মনে পড়ছে। ওঁকে বিদায় জানাতে নাগপুর এয়ারপোর্টে গিয়েছি। প্রণাম করে দেখি, ওঁর চোখে জল। পিঠে হাত দিয়ে বললেন, আজ মনটা বড় উদাস লাগছে, বুঝলে। কে জানে আবার কবে দেখা হবে।

বিদায়, দাদা!


লেখক পরিচিতি: শ্রী নীল মজুমদার অবসরপ্রাপ্ত আই এফ এস অফিসার।


চিকলধারার ছবি: শ্রী সঞ্জীব গঙ্গোপাধ্যায়ের সৌজন্যে।

অলংকরন: সুমন্ত ভট্টাচার্য্য।

284 views0 comments
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page