top of page

ছোট্ট শ্রীলঙ্কার সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র ও প্রাকৃতিক সম্পদ

  • ...
  • Apr 11, 2024
  • 5 min read

ভারতের দক্ষিণে অবস্থিত শ্রীলঙ্কা প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ এক দ্বীপ। এটি খুব সম্ভবত এশিয়ার জীববৈচিত্রের ঘনত্বের দিক থেকে সমৃদ্ধতম দেশ। এই দেশের নিজস্ব শতশত গাছ তো আছেই, এ ছাড়াও বহু দুর্লভ বিদেশি গাছও এখানে পাওয়া যায়। শ্রীলঙ্কার কলোনিয়াল যুগে ইউরোপীয় শাসকেরা অনেক দেশ-বিদেশের গাছ এখানে রোপণ করেছিলেন। আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আনা হয়েছিল বহু চারাগাছ। সেই সব গাছ এখনও সযত্নে লালিত হচ্ছে এখানে। এইসব গাছ এখন শ্রীলঙ্কার সবুজ জগতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কার নানা বোটানিক্যাল গার্ডেনে বা অরণ্যে এইসব গাছ দেখা যায়। এখানে রইল সেরকমই কিছু দুর্লভ গাছের বর্ণনা। ছবি ও লেখায় তুলে ধরলেন রুদ্রজিৎ পাল







সুইসাইড ট্রি। এর বৈজ্ঞানিক নাম cerebra odollam। এটি একটি ম্যানগ্রোভ জাতীয় বৃক্ষ। দেখতেই পাচ্ছেন যে সবুজ ফলগুলি অনেকটা কাঁচা আমের মত দেখতে। তবে এই গাছের সাদা ফুল (ছবিতে রয়েছে) দেখে একে আম গাছের থেকে আলাদা করা যায়। ম্যানগ্রোভ অরণ্যে লবণাক্ত জলের ধারে এই গাছ হয়। একে সামুদ্রিক আমও বলা হয়। কেরালায় এই গাছ কিছু রয়েছে। সেখানে এই ফল থেকে বিষক্রিয়ার খবর মাঝে মাঝে পাওয়া যায়।





Red Frangipani। বাংলায় গোলোক চাঁপা বা কাঠ গোলাপ। এটি আদতে মধ্য আমেরিকার ফুল, কিন্তু কলোনিয়াল শাসকের কল্যাণে এখন শ্রীলঙ্কায় বহুল পরিমাণে পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গে এই গাছের সাদা বা গোলাপি জাত বেশি দেখা যায়। কিন্তু এরকম সুন্দর লাল জাতের গোলোক চাঁপা শ্রীলঙ্কাতেই বেশি পাওয়া যায়। এই ফুল সুগন্ধ তৈরিতে ব্যবহার হয়।





প্রাইড অফ বার্মা বা বর্মার গর্ব। বকুল গাছের মত বেশ বড় গাছ, সেখান থেকে নীচের দিকে ঝোলা এরকম লাল অপূর্ব সুন্দর ফুল। এর আরেকটা নাম আছেঃ অর্কিড ট্রি! লাল পাপড়িতে হলুদের ছোঁয়া এই ফুলকে আরও মনোহর করে তুলেছে। এই গাছের নীচে দাঁড়ালে মনে হবে যেন লাল ঝর্ণা নেমে আসছে।




এই গাছের নামটা বেশ মজারঃ শ্রিম্প প্ল্যান্ট বা চিংড়ি গাছ। প্রত্যেক ডালের আগার পাতাগুলোর রঙ গোলাপি হয়ে যায় এবং পাতাগুলো পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে যায়। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যে একটা বাগদা চিংড়ি! এই পাতার রঙ পরিবর্তনের ব্যাপারটা অনেকটা বোগেনভিলিয়া গাছের মত। রঙিন পাতাগুলো কিন্তু ফুল নয়। ফুল থাকে এর নীচে! বাগান সাজানোর জন্য এই গাছ আদর্শ। কোমর বা কাঁধ সমান উঁচু হয় এই গাছগুলো।




এই সুন্দর হলুদ-লাল ফুলের গাছের নাম Candy-Corn plant। এটি বাগানের শোভা বৃদ্ধি করে।




এই বিচিত্রদর্শন ফুলটির নাম lion’s Tail flower। এর আদি নিবাস সাউথ আফ্রিকা। এই গাছ প্রজাপতি আকর্ষণ করতে পারে। তাই বাগানে এই গাছ থাকলে প্রজাপতি বা অন্যান্য কীটের সমাগম বেড়ে যায় এবং ফুলের পরাগমিলনে সহায়তা হয়। এই গাছের রস থেকে অনেকে নেশা করে বলে কিছু কিছু দেশে এই গাছ নিষিদ্ধ।




ডাবল কোকোনাট গাছ। এই পাম জাতীয় গাছ পৃথিবীর খুব কম জায়গায় আছে। সেশেলস দ্বীপে একমাত্র প্রাকৃতিক পরিবেশে এই গাছ পাওয়া যায়। বাকি সব জায়গায় এই গাছ কৃত্রিম ভাবে প্রজনন করা হয়। এর আরেকটি নাম হল সামুদ্রিক নারকেল বা সী কোকোনাট। এই গাছ খুব কম বাড়ে। এর একটি বীজের ওজন ১৫ থেকে ১৭ কেজি! (পৃথিবীর সবথেকে ভারী বৃক্ষবীজ) শ্রীলঙ্কার একজন প্রাচীন রাজা এই গাছ সেশেলস থেকে এনে লাগিয়েছিলেন। এই দ্বীপের নানা বোটানিক্যাল গার্ডেনে এই গাছ সংরক্ষণের প্রয়াস চলছে। এই গাছের একেকটা পাতা ২০ থেকে ২৪ বছর সবুজ থাকে।




এই অপূর্ব সুন্দর ঘরোয়া গাছটির নাম স্ট্যাগহর্ন ফার্ন। দেখতেই পাচ্ছেন যে এটি অর্কিডের মত দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখলেই সবথেকে ভালো থাকে। এই ফার্নের পাতাগুলো সম্বরের শিঙের মত আকারে বেড়ে ওঠে। সাধারণত বাড়ির দরজার ওপরে এই গাছ সাজানো থাকে। এই একটি গাছ আপনার ড্রয়িং রুমের পুরো সৌন্দর্য পাল্টে দিতে পারে। এটি জাভার রেইন ফরেস্টের গাছ, কিন্তু শ্রীলঙ্কায় এখন বহুল প্রচলিত।




লাল হলুদ ফুলে অরণ্যে আগুন লাগিয়ে দেওয়া এই গাছটি হল অশোক বৃক্ষ। এককালে পশ্চিমবঙ্গেও প্রচুর দেখা যেত। এখন দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এই গাছ থেকে নানা ওষুধ আয়ুর্বেদে তৈরি হয়। অশোক গাছ যখন পুরো ফুলে ফুলে ভরে যায়, তখন চারিদিকের প্রকৃতি যেন হোলির রঙে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে।




এই গাছ দেখে চকলেট-প্রেমীদের জিভ থেকে জল ঝরতে শুরু করবে। ঠিক ধরেছেন, এটা কোকো গাছ। কোকো গাছে এরকম কাণ্ড থেকেই ফুল এবং পরে ফল হয়। ফলগুলো বাদামী বা ঘন বেগুনি রঙের। সারা বছর ধরেই কোকো গাছে এরকম ফল হয় এবং সেই ফল এরপর কারখানায় গিয়ে চকলেট তৈরি হয়। চা এবং কফির সাথে সাথে কোকো চাষও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটা মনে রাখা দরকার যে কলোনিয়াল যুগে এই কোকো চাষের সাথে অনেক মানুষের রক্ত এবং কান্না জড়িয়ে আছে।



যার জন্য এককালে অনেক যুদ্ধ হয়েছে, অনেক দেশ বিক্রি হয়ে গেছে বা অনেক অভিযাত্রী সমুদ্র পার করে এসেছেন, এটা হল সেই গোলমরিচ গাছ! শ্রীলঙ্কায় প্রচুর পরিমাণে চাষ হয়। লতানে গাছ হয়, সেখানে এরকম বীজ হয়। এই বীজ শুকালে তৈরি হয় গোলমরিচ, যার গন্ধে রান্নাঘর মাতোয়ারা।






লতানে গাছ। মোটা মোটা সবুজ সবুজ পাতা। এটাও আমাদের রসনার অপরিহার্য উপাদান। এটা হল ভ্যানিলা গাছ। এই গাছের ফল থেকে তৈরি হয় ভ্যানিলা এসেন্স, যেটা কেক বা আইসক্রিমে না দিলে চলে না। এই গাছ চাষে কিন্তু অনেক যত্ন করতে হয়। তবে শেষ অবধি যা কৃষিপণ্য উৎপাদন হয়, তাতে পরিশ্রম সার্থক।



শ্রীলঙ্কায় কিছু কিছু হারবাল গার্ডেনে এরকম হলুদ বেগুন দেখা যায়। ওখানকার লোক বলে যে এটা রান্না হয় না, এর ব্যবহার হয় আবার সেই ভেষজ ওষুধ তৈরিতে। শোনা যায় যে এর স্বাদ বেশ তেঁতো। ফলে খাবার হিসাবে খুব একটা জনপ্রিয় নয় এটা। আরেক রকম বেগুন দেখা যায় শ্রীলঙ্কায়, যেখানে বেগুনি এবং সাদা মিশ্র রঙ হয়। এর ছবি নীচে রইল। এটা অবশ্য খাওয়ার জন্যই!!






ছবিতে গাছের নীচের মানুষের আকার আর পাশে গাছের কাণ্ডের আকার দেখেই বুঝতে পারছেন যে এই গাছগুলো কতটা লম্বা-চওড়া। সাধারণ ক্যামেরায় এদের একসাথে পুরো ছবি তোলা সম্ভব নয়। এগুলি হল কাউরি পাইন। আদি নিবাস অস্ট্রেলিয়া। পূর্ণ বয়স্ক গাছের বেড় এতটাই মোটা হয় যে চার-পাঁচজন মানুষ পাশাপাশি হাতে হাত লাগিয়ে ঘিরে ধরলে তবেই এই গাছের গোড়া বেষ্টন করা সম্ভব। এই গাছের কাঠের দারুণ চাহিদা। একটি গাছের নীচে দাঁড়ালে মনে হবে যেন কোনও মধ্যযুগীয় ক্যাথিড্রালের থামের নীচে দাঁড়িয়ে আছেন।



এটি ম্যানগ্রোভ অরণ্যের গাছ। শ্রীলঙ্কার তটভূমি বরাবর যে লবণজলের অরণ্য রয়েছে, সেখানে এরকম গাছ পাওয়া যায়। এদের শিকড় সম্পর্কে বিশদে বোঝার জন্য পরের ছবি দেখুন।



ম্যানগ্রোভ অরণ্যের একটি খাঁড়ির ভেতরে। এভাবেই জলের কাছে এই গাছগুলির শিকড় ঝাঁক বেঁধে ভেসে থাকে। তার মধ্যেই সাপ, গোসাপ এবং বিভিন্ন পতঙ্গের বাসা। এই শিকড়গুলি তটের মাটির ক্ষয় আটকে রাখে।



শ্রীলঙ্কার পান গাছ। এই গাছের পাতা আর গোলমরিচের পাতার মধ্যে মিল রয়েছে।



এই ফুলটা দেখুন, মনে হবে যেন আগুন জ্বলছে। আগুনের শিখার মত নীচটা হলুদ, ওপরটা লাল। একে বলা হয় ফ্লেম লিলি। এই ফুল বাগানের সৌন্দর্য একশো গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।




দেখতে সাধারণ ঘাস বা আগাছার মত। কেউ একবার দেখে দুবার আর ফিরেও তাকাবে না। ছোট ছোট বেগুনি ফুল হয়। কিন্তু এই গাছের জন্য এককালে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রচুর মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছিল। এটা হল সেই কুখ্যাত নীল গাছ, যেটা চাষ করার জন্য বাংলা এবং ভারতের অন্যান্য জায়গায় ইংরেজ শাসকেরা প্রচণ্ড অত্যাচার করত। এই নীলের চাষ করার জন্য প্রচুর চাষজমি একটা সময় ধ্বংস করা হয়েছিল। এখন এই গাছ আর কেউ ব্যবহার করে না। কৃত্রিম রাসায়নিক নীল রঙ এসে গেছে। এই গাছ এখন পড়ে থাকে অনাদরে!




Red Cat Tail Flower। এটি একটি বাগান সাজানোর পক্ষে আদর্শ গাছ। এর আরেক নাম ফিলিপাইন মেডুসা।




এই গাছটি দেখুন। কাণ্ড বা ডাল থেকে হলুদ রঙের লম্বা লম্বা ফল ঝুলে থাকে। এই ফল হাতে ধরলে মোমের মত পিচ্ছিল। এর জন্য এই গাছের নাম ক্যান্ডল ট্রি বা মোমবাতি গাছ। মধ্য আমেরিকার কিছু দেশে এই গাছের ফল খাদ্য হিসাবেও ব্যবহার হয়।


এছাড়াও শ্রীলঙ্কার তটভূমি নানা সামুদ্রিক প্রাণীর আশ্রয়স্থল। এই দেশের সৈকতে এরকম সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণের নানা প্রকল্প রয়েছে। সেইসব স্থানে ঘোরার অভিজ্ঞতা থেকেও কিছু ছবি রইল এখানে। ইউরোপে বহুমূল্যে টিকিট কেটে এইসব প্রাণী দেখতে হয়। শ্রীলঙ্কায় কিন্তু খুব সহজেই এই বিরল জীবজগতের মুখোমুখি হওয়া যায়।




নাইল মনিটর লিজার্ড। এক রকমের গোসাপ। এর নিবাস শ্রীলঙ্কার সিনামন দ্বীপের ম্যানগ্রোভ বনে। ম্যানগ্রোভের শিকড়ের যে জাল জলের ওপর থাকে, সেখানেই এদের বাস। এরা মানুষকে খুব একটা ভয় পায় না এবং নৌকা সফরের সময় এদের খুব কাছে গিয়ে ছবি তোলা যায়।



লেপার্ড মোরে ঈল। লম্বাটে মাছ, গায়ে কালো হলুদ ডোরাকাটা। কাছ থেকে দেখলে বেশ ভয়ই করবে, মনে হবে যেন ভিনগ্রহের জীব।




এই শেষ মাছটি হল পাফার ফিশ বা পটকা মাছ। এই মাছ অনেক রকমের হয়। এই মাছ কিন্তু খুব বিষাক্ত এবং বাংলাদেশে অনেকেই এই মাছ না জেনে খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। একমাত্র জাপানের কিছু রাঁধুনি এই মাছের বিষাক্ত অংশ বাদ দিয়ে রান্না করতে জানেন।








আমার এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য ছিল শ্রীলঙ্কার জীবজগতের অদ্ভুত বৈচিত্র্যের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে এই সুন্দর জগত আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে হাঁটছে। চাক্ষুষ এইসব প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে পরিচিত হলে তবেই এদের রক্ষার জন্য মানুষের দায়িত্ববোধ জাগা সম্ভব। সব শেষে ছেড়ে যাচ্ছি শ্রীলঙ্কার মনোরম প্রকৃতির এক অনবদ্য দৃশ্য।





ছবি: লেখক


অশোক বৃক্ষের ছবি: wilimedia commons

কোকো গাছের ছবি: flickr

গোলমরিচ গাছের ছবি: সুমন্ত ভট্টাচার্য্য


লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। সময়ে সময়ে হাতে কলমও তুলে নেন।

Comments


86060474-00b1-415d-8c11-9c4471c9c5e7.png
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG

Editor: Dr. Sumanta Bhattacharya
Co-editor: Dr. Oishimaya Sen Nag

  • Facebook

follow our facebook page to stay updated

© 2021 by Boney Pahare. All rights reserved.

bottom of page