top of page
  • ..

গাড়োয়ালের ডায়েরি (পর্ব ৮): কুয়ারি পাস থেকে বলছি

আবার একবার গাড়োয়াল হিমালয়ের গল্প বনেপাহাড়ের পাতায়। ছবিতে ও কলমে সুমন্ত ভট্টাচার্য্য।  এবার কুয়ারি পাস ট্রেকিং এর আখ্যান।





এবারে নামার শুরু। বুগিয়ালের খোলা ছড়ানো পথের শেষ। শুরু পাহাড়ের গা বরাবর সরু গিরিপথের। একদিকে পাহাড়ের প্রাচীর, বাম হাতে গভীর খাদ। অঙ্কিত বলল তাকাবেন না নীচের দিকে। শুধু সামনের পথ দেখে চলুন। কিন্তু চোখ তবু তো নীচের দিকে চলে যায়। সেদিকেও কি কম সৌন্দর্য! সেই নীচে দেখা যাচ্ছে গুলিং ক্যাম্পসাইট। সেখানে খোলামেলা জমির মাঝে লাল লাল গাছ জানান দিচ্ছে শরতের শেষে হেমন্তের আগমন। ওদিকে নীল আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সব শৃঙ্গেরা। সামনে পাঙ্গারচুল্লা এবার আত্মপ্রকাশ করল। এদিকেরই পাহাড়ে উঁচু একটা চুড়া, মাথায় জমেছে কিছু বরফ। দ্বি-প্রহরের রোদে তা মুকুটের মত চকচক করছে। এই পথে কিছু জায়গায় ধ্বসের চিহ্ন। তাই এ পথে আর আউলি হয়ে ঘোড়া বা খচ্চর আসে না মাল বহন করে। তাদের ঢাকের দিক থেকে উঠতে হয় যে পথেই আপনি ট্রেক শুরু করুন না কেন। বড় কষ্ট ওদের সারাটা জীবন  যাত্রীদের মাল বহন করতে করতে।




 কত সময় এরা খাদে পড়ে যায় বা মাল বইতে না পেরে পথেই শুয়ে পড়ে। মনে আছে গোমুখ থেকে ফেরার পথে চিরবাসার কাছে এমন একটা অভিজ্ঞতার সাক্ষী ছিলাম। ঘোড়াটার সেই অবস্থা দেখে সেখানেই কেঁদে ফেলেছিলাম।  ঘোড়াদের ব্যবহার নিয়ে এখানকার প্রশাসনের নিয়ম নীতি চালু করা উচিত বলে মনে করি।



নেমে এসেছি তালি তে। প্রথমেই  এল তালির সরোবর। ছোট একটা জলাশয়। অসাধারণ বললেও কম বলা হয় এখানকার দৃশ্য। ক্যাম্পিং এর আদর্শ সাইট হতে পারত। কিন্তু এখানকার জল নাকি বন্যজীবে খায়। তাই তা ব্যবহারে উপযোগী নয়।যেখানে জলের স্রোত আছে, ঝরনা আছে ক্যাম্প হয় সেখানেই। একটু এগিয়ে দেওদার বনের মধ্যে। কিন্তু এখান থেকে বুঝতে পারলাম দারুণ সূর্যাস্ত দেখা যাবে।


দ্রোণাগিরি, নন্দাদেবী, বুগিয়াল কোঠি। তালির জলাশয়ের সামনে থেকে।

 জলে ছায়া পড়ছে দুপাশে ডানা মেলা দ্রোণাগিরির। দেখা যাচ্ছে নন্দাদেবী  তো বটেই, এমনকি ত্রিশূল ও নন্দাঘুন্টির কিছু অংশ। অঙ্কিত যদিও তাড়া দিচ্ছিল যে সূর্যাস্তের আগে ক্যাম্পে না পৌঁছালে হবে না। পথে কিছু দেখা যাবে না। কিন্তু আমি বললাম আগামীকাল কেমন আবহাওয়া থাকবে জানি না। কথায় বলে "মুম্বই কা ফ্যাশান অউর গাড়োয়াল কা মৌসম- কভি ভি বদল যাতা হ্যা"। তাই কালকের ভরসায় থাকা যাবে না। আজ দেখতে চাই এই পথের আসল সৌন্দর্য। সূর্যাস্ত হতে তখনও দু'ঘন্টা প্রায়। এদিকে সেই স্থানে রোদ পড়ে গেছে। দ্রুত ঠান্ডা  বাড়ছে। চাপিয়ে নিলাম অতিরিক্ত জ্যাকেট, টুপি। অঙ্কিতের সাথে ওদের কাজ কারবার, ট্রেকিং এর ব্যবসা, হোম-স্টে'র সম্ভাবনা এসব নিয়ে কথা বলছি। একটা হনুমান অনেক ক্ষণ ধরে ডাক ছাড়ছিল। কোন টাইগার রিজার্ভ হলে ভাবতাম বাঘ দেখে 'কল' দিচ্ছে  কিনা! অঙ্কিত হঠাৎ বলল, দ্রোণাগিরির পিছেন ওটা কি বলুন তো! আমার দেখে মনে হল, মেঘের হালকা আস্তরণ যেন একটা...ও বলল, ভাল করে দেখুন। চাঁদ উঠছে। 


দ্রোণাগিরির মাথায় চন্দ্রোদয়

দেখলাম সে অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য। দ্রোণাগিরির মাথায় যেন মুকুট পরিয়ে দিয়ে চন্দ্রমার আবির্ভাব। দুদিন পরে পূর্ণিমা। তাই গোলাকার সে আজ। আস্তে আস্তে রঙ বদলালো আকাশ। তার ছোঁয়া লাগল সব চূড়াগুলির বুকে। সেই নির্জন প্রান্তরে দাঁড়িয়ে দেখলাম অপূর্ব সেই সূর্যাস্তের রূপ। 




সামনে নন্দাঘুন্টি, পিছনে ত্রিশূল। দিনের শেষ আলোয়।

 এরপর তো ঝুপ করে নেমে এল আঁধার। পাথরের উঁচু নীচু পথ দিয়ে লাঠি ঠুকে ঠুকে বনের মধ্যে প্রবেশ। চললাম ক্যাম্পের দিকে। 

 

দেওদার বনের মধ্যে ছোট একটা তাঁবুতে  আমার রাত্রিবাস। পাশে একটা কিচেন টেন্ট আগের দিন থেকেই রয়েছে। গতকাল নাকি কলকাতা পুলিশের কর্মী অফিসারদের একটা দল এখানে ছিল। আজ তারা খুলারা তে গেছে। সেখান থেকে কাল কুঁয়ারি পাস উঠবে। আমি খুলারা না গিয়ে কাল সোজা এখান থেকেই কুঁয়ারি পাসের দিকে যাব।

 রাতে বড় যত্ন করে খাওয়ালো অঙ্কিত। স্যুপ, রুটি, ভাত, ডাল,  সব্জি। ওই ঠান্ডায়, শ্রান্ত শরীরে তাই অমৃত। রাতে ঝরনার আওয়াজ শুনতে শুনতে আর তাঁবুর উপরে শিশির পড়ার টুপটুপ আওয়াজ শুনে ঘুম লেগে এল চোখে। যদিও প্রবল ঠান্ডায় মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেছিল। তরপরে শুধু এপাশ ওপাশ।


তালি'র অরণ্যে রাত্রিবাস

পরদিন সকালে চা আর হালকা প্রাত:রাশ  করে রওয়ানা দিলাম কুঁয়ারি পাসের পথে। বন একটু ছাড়াতেই একে একে আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল গাড়োয়ালের চূড়াগুলো। পথের এদিক ওদিক বরফ পড়ে।




 আজকের পথ বেশ বন্ধুর। চড়াই ভাঙ্গছি, আবার নামছি, আবার উঠছি। রোদ ঝলমলে দিন হলে কি হবে, দিচ্ছে ঠান্ডা হাওয়া। চলার পথে এবার দেখা দিল চৌখাম্বা। দেখতে দেখতে সেই জায়গা এসে গেল যেখানে পথ উঠে এসেছে খুলারা ক্যাম্পসাইট থেকে। আর এখান থেকে মাথার উপরে দেখা যাচ্ছে কুঁয়ারি পাস। এই স্থানেই দেখা হল অঙ্কিতের বাবা সোহন সিংজির সাথে, যিনি কলকাতা পুলিশের ওই দলটিকে গাইড করছেন। ওরাও চলেছেন আমার আগে পিছে। কিছুটা পথ এখানে সমতল। তারপরে সাবধানে পার হতে হল বরফ হয়ে যাওয়া একটি ঝরনা।  আবার পথ উঠে গেছে পাসের দিকে।


ওই দেখা যায় পাঙ্গারচুল্লা




 অবশেষে ধীর পায়ে এসে পৌঁছালাম সেই কুঁয়ারি পাসের মাথায়। অনেকদিনের অভীষ্ট পূরণ। পাসের শীর্ষে পাথরের উপর পাথর সাজিয়ে রাখা।  সেখানেই নিয়ম অনুযায়ী কিছু লজেন্স দিলাম আমি আর অঙ্কিত। পাসেবা গিরিপথে এসে এভাবেই ভগবানের উদ্দেশ্যে যা সম্ভব তা অর্ঘ্য হিসাবে দিতে হয়। এটাই হিমালয়ের রীতি।

 এবার পাসের উপরে  কিছু ফটোশ্যুটের সময়। ২০০ ডিগ্রী প্রায় দিগন্তরেখায় বিস্তৃত হিমালয়ের সব চূড়া।  ডানদিকে বুগিয়াল কুঠি, দ্রোণাগিরি হয়ে হাতি ঘোড়ি, নীলগিরি, কামেট, চৌখাম্বারা তাদের রূপের ডালি সাজিয়ে বসেছে নীল আকাশে। এই হিমালয়ের দৃশ্য যুগে যুগে আকর্ষণ করে টেনে এনেছে আমাদের মত ক্ষুদ্র মানুষদের। এমন স্থানে এসে দাঁড়ালে সত্যিই মনে হয় কত নশ্বর আমরা, আমাদের সাজানো ঘর বাড়ি, ঐশ্বর্য।


কুঁয়ারি পাস

কুঁয়ারি পাসের শীর্ষে লেখক

 এরপরে নেমে যাবার পালা এই পাহাড়চূড়াকে বিদায় জানিয়ে। একদিকে দেখা যাচ্ছ যে পথে উঠে এসেছি সেই পথ। আর বাম দিকে পথ চলে গেছে লর্ড কার্জন ট্রেলের দিকে, যে পথে দীর্ঘ কয়েকদিনের ট্রেক করে  পৌঁছাতে হয় কুঁয়ারি পাসে।

 নামার পথে সামনে দেওয়ালের মত দাঁড়িয়ে দ্রোণাগিরি। নানা অ্যাঙ্গেল থেকে সে ধরা দিচ্ছে চোখে। সেই দৃশ্য দেখলে ভুলে যাই পথশ্রম।

 দূর থেকে দেখা যাচ্ছে নীচে খুলারার ক্যাম্প। নানা রঙের তাঁবুতে সজ্জিত ছোট সেই ঘাসের জমি। চারিদিকে পাহাড়, পাথর আর বনে ঘেরা একটুকরো ভূ-স্বর্গ। আর সামনে  মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ঝকঝকে দ্রোণাগিরি।



 

বিকেলে শুয়ে শুয়েই  আমার ছোট তাঁবু থেকে দেখছি দ্রোণাগিরির আশেপাশে মেঘের আনাগোনা, পাখিদের উড়ে যাওয়া। একটু ওদিকেই বড় কিচেন টেন্ট।  ওখানেই আজ আমার আর অন্য একটি বড় দলের রান্নাবান্না প্রস্তুত হচ্ছে।


আমার টেন্ট থেকে

বেশ কয়েকজন কর্মী।  পাচক, মালবাহক, ঘোড়াওয়ালা-সব মিলে। ওদরে সাথেও গিয়ে গল্প করছি, চায়ে চুমুক দিচ্ছি। আস্তে আস্তে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল। আর তখনই মেঘ আর সূর্যাস্ত আর চাঁদ মিলে দ্রোণাগিরিকে ঘিরে মায়াবী  দৃশ্য তৈরি করল। মহাজাগতিক সেই সৌন্দর্য। আশেপাশের সবাই, এমনকি আমাদের স্থানীয় গাইড, পোর্টাররাও অভিভূত রঙের সেই খেলা দেখে। মনে হল বিশাল এক প্রেক্ষাগৃহে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি সেই যাদুবাস্তব মুহূর্ত। আর তারপরে চন্দ্রোদয়ের পর চরাচর ভাসিয়ে দিল জ্যোৎস্না।


সেই মাহেন্দ্রক্ষণে

সেদিন রাতটা আর একা তাবুতে কাটাইনি। কিচেন টেন্টে সবার সাথে গল্প করতে করতে,  তাপ নিতে নিতেই ঘুমোতে গেলাম। বাইরে তখন রাতচরা পাখির আওয়াজ।

 

চলার শেষে

 রোদ ঝলমলে সকালে নেমে চলেছি। পাইনবনের মধ্যে দিয় , ছোট ছোট ঝরনা পার হয়ে। সামনে  সেই দ্রোণাগিরির বিস্তার। আজকের রাস্তার উৎরাই বেশ খাড়া।  দেখতে দেখতে এসে গেল গুলিং ক্যাম্পসাইট। যারা এইদিকে তুগাসি গ্রাম থেকে ট্রেক শুরু কর তারা এখানে ক্যাম্প করে অনেক সময়। এই পথে শুরু করলে শুধুই চড়াই প্রথমে। পিছন দিকে থাকবে দ্রোণাগিরি। গুলিং ক্যাম্পসাইটে তখন কেউ ছিল না। অনেক রকম গাছে, ছোপ হেমন্তের আগমনে লাল রং ধরেছে। গত পরশুই উপর  থেকে এই জায়গা চোখে পড়ছিল। গুলিং ও খুব সুন্দর স্থান।


গুলিং

 আস্তে আস্তে চোখে পড়ছে দূরে দূরে কিছু ছোট গ্রাম। নীচের গ্রামটা তুগাসি। তার দু’টি ভাগ। আপার ও লোয়ার তুগাসি। ট্রেকের শেষ পথটা গেল আপার তুগাসির মধ্যে দিয়ে। এসে পৌঁছালাম লোয়ার তুগাসি। দেখা যাচ্ছে গাড়ির রাস্তা। কুয়ারি পাস ট্রেক সমাপন এখানেই।

 এই ট্রেক শেষে তুগাসি গ্রামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানেই বীরেন্দ্র সেঙ্গারের বাড়িতে দু’টি দিন কাটিয়ে দিই। বড়ই আনন্দের সেই স্মৃতি তুগাসিতে থাকার। সেই গল্প পরে কখনও হবে।


তুগাসি গ্রাম


 লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় চিকিৎসক। প্রকৃতি ও অরণ্যপ্রেমী। 'বনেপাহাড়ে' ওয়েবজিনের সম্পাদনার দায়িত্বে।


Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page