top of page
  • ..

মারোমার, বুদ্ধদেব গুহ আর অমলিন স্মৃতি

পালামৌ টাইগার রিজার্ভের দীর্ঘদিনের ডিরেক্টার ছিলেন S.E.H.Kazmi। নিজের কাজে ও দক্ষতায় একজন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব তিনি ভারতের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণে নিয়োজিত মানুষজনের মধ্যে। পালামৌতে দীর্ঘসময়ে থাকার সময়ে তিনি ঘনিষ্ঠ হন বুদ্ধদেব গুহ'র। যে লেখকের রচনায় বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছে পালামৌ ও তার অরণ্য। এবার বনেপাহাড়ে'র পাতায় লেখকের স্মৃতিচারণায় সকলের প্রিয় কাজমি সাহাব। বনেপাহাড়ে'র জন্য প্রবন্ধটি সংগ্রহে সাহায্য করেছেন কাজমি সাহেবের পুত্র রাজা কাজমি, যিনি নিজেও একজন বন ও বন্যপ্রাণ বিষয়ক গবেষক ও সুলেখক।



প্রয়াত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ'কে নিয়ে স্মৃতিচারণের অনুরোধ এসেছে আমার কাছে। কিন্তু কোথা থেকেই বা আমি শুরু করি তা! সেখান থেকে যখন তাঁকে আমি প্রথমবারের মত দেখি? অথবা সেদিনের কথা থেকে যেদিন বেতলা, মারোমারের কিশোর চৌধুরীর থেকে আমি প্রথম এই বিখ্যাত ও পাঠকদের প্রিয় সাহিত্যিকের কথা শুনি? নাকি সেইসব অসংখ্য বাঙালী পর্যটকদের কথা থেকে যারা বলতেন তারা পালামৌতে এসেছেন বুদ্ধদেব গুহ'র কাহিনী ও প্রবন্ধ পড়ে! তাদের সবাই মারোমারে থাকতে চাইতেন।ব্যক্তিগতভাবে আমি বেশ উৎসুক হয়ে পড়েছিলাম জানতে যে, কে এই ভদ্রলোক যাঁর লেখা পড়ে এত এত শহরবাসী তাদের শহুরে সুযোগসুবিধার মায়া কাটিয়ে মারোমারের মত জায়গায় বনবাংলোয় রাত কাটাতে ছুটে আসছে। আমি এটা বুঝেছিলাম বাঙালী পাঠকদের মধ্যে মারোমার একটা জনপ্রিয় স্হান আর তাদের বড় অংশই অনুপ্রাণিত ছিলেন বুদ্ধদেব গুহ'র লেখা পড়ে। কিন্তু একটা অসুবিধা তো ছিল। মারোমার বনবাংলোয় ছিল মাত্র দুটি ঘর যা তার চাহিদা পূরণ করতে অক্ষম ছিল। আমার ভাল লাগত না সেইসব নিরাশ মুখ দেখতে যখন আমাকে বাধ্য হয়ে রিজার্ভেশান প্রত্যাখ্যান করতে হত।

এবার আসি কুসুমি ট্রী-হাউস তৈরি বিষয়ে কিছু কথায়। একটু ইতিহাস, একটু গল্প। আমার সমস্যা হল পুরো গল্পটাই বলতে চাই, যেটা কোনভাবেই ছোট নয়। তাই বরং আমি সেই ঘটনাক্রমগুলো তুলে ধরি যার ফলে কুসুমি ট্রি হাউস তৈরি হয়েছিল।

১৯৯২ বা ৯৩ এর গ্রীষ্ম হবে। আমরা পালামৌ টাইগার রিজার্ভে বাঘ-গণনা'র কাজ করছিলাম। অনেকেই পুরো কার্যক্রমটার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। আমার সহপাঠী যেসব বন্ধুরা আই এ এস ও আই পি এস পদে ছিলেন তারা অবধি বিষয়টা নিয়ে আমাকে খোঁচা দিচ্ছিলেন। আমি তাদের বললাম তাদের যদি কোনপ্রকার সন্দেহ হয় তো আমার সাথে তারা এই 'অপারেশান'-এ যোগ দিয়ে সব চাক্ষুষ করুক। আমি একপ্রকার চ্যালেঞ্জই দিলাম। তারা তো বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন শুনে।পরের দিন ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপার, ডেপুটি ডেভেলপমেন্ট অফিসার, ভূমি সংস্কার আধিকারিক- সবাই যোগ দিলএন এই বাঘ-গণনায়। তাদেরকে বাঘের পাগমার্ক (পায়ের ছাপ) দেখানো হল ও তার প্রকারভেদ বোঝানো হল। যারা পালামৌর ভূ-প্রকৃতি ও আবহাওয়া সম্পর্কে জানেন, তারা বুঝবেন তাদের অবস্হার কথা। সন্ধ্যার মধ্যে তাঁরা একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। আমরা ওখানেই প্রথমে থাকার কথা ভেবেছিলাম, কিন্তু নৈশ আহারের পর তাঁরা ওই গরমেই ডালটনগঞ্জের দিকে রওয়ানা দিলেন। ওঁরা আমাকেও আসতে বললেন , কিন্তু আমি জানালাম পুরো প্রক্রিয়াটা আমাকেই দেখতে হবে বলে আমি মারোমারেই থাকব। ওঁরা বললেন , মারোমার তো খুব গরম হবে। আমি জানালাম, আমি খোলা জায়গাতেই রাতে থাকব।

আমি চৌকিদার উদয় সিং'কে বাইরে খোলা জায়গায় বিছানা করতে বললাম। সে বলল, 'গনেশজি' কিন্তু রাতে আসতে পারেন। আমি বললাম, 'আসতে দাও'। বললাম , কেরোসিন লন্ঠনটা আমার বিছানার কাছে রেখে দাও। প্রচণ্ড পরিশ্রান্ত ছিলাম , তাই তাড়তাড়িই ঘুমিয়ে পড়লাম। রাতে ঝোপঝাড় আর বারান্দার কাছে কিছু গোলমাল শুনলাম। আমি জেগে উঠে দেখলাম বিরাট এক দাঁতাল আমার বিছানার কাছে, কিন্তু আমি ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছি ভাবলাম আর পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। তারপরে আবার মরার মত ঘুমিয়ে পড়লাম। তখন আসলে লন্ঠনটি নিভে গেছিল আর হাতিটা বারান্দার দিকে যাচ্ছিল।

মারোমার বনবাংলো। ছবি: বনেপাহাড়ে।

মারোমারে অনেক রকম পাখি আছে, আর তাদের দিন আমাদের অনেক আগেই শুরু হয়। আমি ঘুম থেকে উঠে অনেকক্ষণ শুয়ে পাখির ডাক শুনলাম, কিন্তু যখন উঠলাম দেখলাম মশারিটা খুলে গায়ে পড়ে আছে। উঠে পড়ে আমি দেখতে পেলাম রাতের অতিথির আগমনের চিহ্নগুলো। তার বর্জ্য পদার্থ, জানালার পর্দার মাটিতে পড়ে থাকা, ঘরের পাপোষের দু'টুকরো হয়ে পড়া। বুঝলাম যে হাতিকে আমি স্বপ্নে দেখছি ভেবেছিলাম, তা আসলে সত্যিই রাতে এসেছিল। চারপাশের দৃশ্য দেখে ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানালাম। এটা সেই দাঁতাল যে মারোমার নালায় প্রায়ই এসে জল খায়। বিরাট পশুটি কিন্তু খুব ভদ্র ছিল আসলে, কারুর ক্ষতি করত না।

আমি ভাবলাম এই গরম তে ২-৩ মাস জুড়ে থাকবে আর ঘরে ঘুমানো আমার পক্ষে অসম্ভব হবে। তাই আমি ভাবলাম সামনের কুসুম গাছটায় একটা সাধারণ মাচান তৈরি করার কথা, যেখানে শুতে গেলে হাতির ভয় থাকবে না কারুর। আমি সেই মত রেঞ্জ অফিসারকে মাচান বানাবার নির্দেশ দিলাম।

দশদিনের ছুটিতে আমি বাড়ি ফিরলাম। ফিরে এসে রেঞ্জ অফিসারের কাছে 'মাচান'এর কথা জানতে চাইতে তিনি বেশ আনন্দ সহকারে জানালেন যে, সেটি সম্পূর্ণ এবং কিছু বরিষ্ঠ আধিকারিক এসে দেখেও গেছেন ও তারিফ করে গেছেন। অফিসিয়াল কাজকর্ম ২-৩ দিনে করে মারোমারে যাব ঠিক করলাম। কিন্তু গিয়ে যা দেখলাম তা আমার কল্পনার বাইরে। একটা কুৎসিত ও নড়বড়ে জিনিস হয়েছে সেটা, এমনকি চারটি পায়া অবধি সমান নয় ও সঠিকভাবে দাঁড় করানো নেই। যে কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে তা নিকৃষ্ট মানের আর কাজের মানও তেমন। অবাক হয়ে গেলাম ভেবে যে কে এমন একটা জিনিসকে তারিফ করেছে! আমি রেঞ্জারকে আমার কথা বললাম আর এই জিনিস ভেঙ্গে ফেলতে নির্দেশ দিলাম তাড়াতাড়ি। ওই স্হানে একটা গাছ বাড়ি করার কথা আমি ভাবলাম সরাসরি আমার তত্ত্বাবধানে।

এক সপ্তাহের মধ্যেই সেটি তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেল। আমি চাইছিলাম পর্যটন মরশুমের আগেই এটা তৈরি হয়ে যাক। দুই মাসই সময় ছিল হাতে, তার ওপর বৃষ্টির অসুবিধা করছিল কাজে। যাইহোক, কাঠামোটা দাঁড়িয়ে গেল এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ প্রায় শেষ হতে চলল। এর মধ্যে একদিন যখন মারোমার গেলাম, দেখলাম ঠাহর করার মত এক ভদ্রলোক সেখানে, তাঁর সাথে আরও ২-৩ জন। আমি উৎসুক হলাম কে তাঁরা জানতে। এবং এভাবেই বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক শ্রী বুদ্ধদেব গুহ'র সাথে আমার পরিচয় হল। তাঁকে আমি এই ট্রি-হাউসের বিষয়ে জানালাম পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে। তাঁর পরামর্শও চাইলাম। তিনি বললেন, উদয় সিং তাঁকে এসব বিষয়ে কিছু কিছু বলেছে। তিনি পরামর্শ দিলেন, কাঠের রং টা কলাপাতার রঙে হলে ভাল হয়। তিনি আরও বললেন, যেহেতু গাছ বাড়িটি ট্রি-হাউসের ওপরে তৈরি হচ্ছে তাই সেটির নাম 'কুসুমি' দিলেই ভাল হয়। এভাবেই সেই গাছ বাড়ির নাম হল 'কুসুমি'।

সেই কুসুমি ট্রী হাউস, যা এখন আর নেই। রাজনৈতিক কারণে ভস্মীভূত হয় উগ্রবাদীদের হাতে। ছবিটি প্রাপ্ত ডা: কৌশিক লাহিড়ীর সৌজন্যে।

তিনি অনেক কিছুই লিখেছেন পালামৌর বন, মারোমারের সৌন্দর্য আর কুসুমি বাড়িটির বিষয়ে। এরপরে তো আর ফিরে তাকানোর দরকার হয় নি। পর্যটকের ঢল নামে মারোমারে আসার জন্য, বিশেষত: কুসুমি গাছবাড়িতে থাকার জন্য। তিনি দু'বার কি তিন বার এসে কুসুমিতে ছিলেন। তিনি মারোমারে এলেই আমি দেখা করতে যেতাম সেখানে। বন ও বন্যপ্রাণী নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা এতই ছিল বিভিন্ন অরণ্যের যে আমি চুপ করে শুনতাম তাঁর কথা। আমি তাঁর কথায় অভিভূত হয়ে পড়তাম এবং জীবনের অভিজ্ঞতা, বিশেষত: বন্যপ্রাণী নিয়ে তাঁর কথাবার্তা শ্রদ্ধা সহকারে শুনতাম। তিনি আমায় সবসময় কলকাতায় যেতে আমন্ত্রণ জানাতেন, যদিও আমার পক্ষে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এরপরে আমি ডালটনগঞ্জ থেকে হাজারিবাগে বদলি হয়ে যাই। হাজারিবাগ ন্যাশনাল পার্কে তাঁকে আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, যদিও তাঁর আসা হয়ে ওঠেনি। পরিচিতজনদে'র মাধ্যমে আমি তাঁর খোঁজখবর রাখতাম, তবে দেখা করা হয়ে ওঠেনি।

শেষ বার তাঁর সাথে কথা হল তাঁর প্রয়াণের কয়েক সপ্তাহ আগে টেলিফোন। তিনি বললেন, তাঁর সবই পরিষ্কার মনে আছে, কিন্তু তাঁর আর বেশি সময় নেই। আমি নীরবে কেঁদে উঠলাম। মহাপ্রাণ একজন তিনি। তাঁকে আমি অনুরোধ জানালাম আমার পুত্র রাজাকে আশীর্বাদ করতে। ওই অবস্হাতেও তিনি রাজার সাথে কথা বললেন, তাকে আশীর্বাদ দিলেন এবং উৎসাহ দিলেন।

মারোমারে কুসুমি গাছ বাড়ির সামনে শ্রী বুদ্ধদেব গুহ। ছবি শ্রী অনির্বান গাঙ্গুলির সৌজন্যে।

তাঁর প্রয়াণের সাথে সাথে আমি একজন পিতৃসম মানুষকে হারালাম, যিনি আমার কাজকর্মের তারিফ করতেন ও সবসময় উৎসাহ দিতেন আরও ভাল কাজ করার। আমি বর্তমানে আর কাউকে জানিনা যিনি এতকিছু বিশদে লিখেছেন পালামৌ সম্বন্ধে ও সেখানকার বন্যপ্রাণী নিয়ে, বিশেষত: মারোমার নিয়ে। তাঁর রচনা সবসময় মানুষকে উৎসাহিত করবে বন্যপ্রাণী বাঁচাতে ও সংরক্ষণ করতে।



লেখক পরিচিতি: লেখক ১৯৮৫ ব্যাচের অবসরপ্রাপ্ত আই এফ এস অফিসার। কর্মজীবনে পালামৌ টাইগার রিজার্ভসহ ঝাড়খন্ডের বিভিন্ন স্হানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ছিলেন। পালামৌ ও তাঁর নাম একই সাথে উচ্চারিত হয়। একাই তিনি ঝাড়খন্ডের অনেক প্রত্যন্ত সন্ত্রাস উপদ্রুত এলাকায় বন ও বন্যপ্রাণ বাঁচাতে লড়ে গেছেন। ১৯৯১-৯৮ তিনি ডি এফ ও, ডালটনগঞ্জ সাউথ ছিলেন। এরপর হাজারিবাগো রাঁচিতে দায়িত্বভার পালন করে অবসরের আগে ২০১১ থেকে ১৪ তিনি পালামৌ টাইগার রিজার্ভের ফিল্ড ডিরেক্টার ছিলেন। অবসরগ্রহন কালে ২০১৬ সালে তিনি অতিরিক্ত মুখ্য বনপাল পদে নিয়োজিত ছিলেন। বর্তমানে ঝাড়খন্ডের State Level Environment Impact Assessment Authority-র চেয়ারম্যান পদে আসীন। ২০১৬ সালে তাঁকে Sanctuary Nature Foundation Lifetime Service Award দিয়ে সম্মানিত করা হয়।





অনুবাদ ও অলংকরণ: সুমন্ত ভট্টাচার্য্য।

Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page