কেরালার পেরিয়ার টাইগার রিজার্ভ। পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় এই সৌন্দর্যের খনি ছিল একসময় চন্দনদস্যু ও চোরাচালানকারিদের স্বর্গরাজ্য। কিভাবে তাদেরই বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করে বন সংরক্ষকে পরিণত করল কেরালার বনবিভাগ তা দেশের কাছে এক মডেল। লিখছেন কে এ সাজি।
কেরালার পেরিয়ার টাইগার রিজার্ভের প্রাক্তন রেঞ্জ ফরেস্ট অফিসার রাজু কে. ফ্রান্সিসের ১৯৯৪ সালের সেই বিকেলের কথা এখনো মনে পড়ে। ফ্রান্সিসের হাতে ধরা দিল বহুদিনের অধরা অরণ্য দস্যু আরুভি। তাকে ধরা হয়েছে তামিলনাড়ুর থেনি জেলার এক সুপ্রাচীন গুহা থেকে। এই গুহাটা স্থানীয় গ্যাং-এর দল চন্দন পাচারের জন্য ব্যবহার করে থাকে। গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য আদর্শ। আরুভির সাঙ্গপাঙ্গর সংখ্যা তেইশ। এরা সকলেই চোরা শিকারি। চন্দন পাচারকারিরা পুরো বিষয়টা অপারেট করে ভারুসানাড়ু এলাকার কে.জি. পত্তি এবং থেনির গোদালুর দক্ষিণভাগ থেকে। জায়গাটার দূরত্ব পেরিয়ার টাইগার রিজার্ভ থেকে কুড়ি কিলোমিটার মতন।
“সেই সব দিন ছিল। জঙ্গল লাগোয়া থেনি গ্রাম। ফরেস্ট ম্যানেজমেন্টের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে শিকারি এবং চোরা শিকারির দল। তবে এদের উৎপাত শুধু পেরিয়ার টাইগার রিজার্ভ বলেই নয়, কেরালার ইদুক্কি জেলার জঙ্গলময় এলাকাতেও ছিল। আসলে ওদের লক্ষ্য ছিল মারায়ুর- কেরালার একমাত্র সংরক্ষিত চন্দনের অরণ্য। আদিম, বিচ্ছিন্ন এই গভীর জঙ্গলের প্রতিটা জায়গা ছিল ওদের নখদর্পণে। ইদুক্কি জায়গাটা পর্বতময় হবার কারণে অফিশিয়াল যারা এখানে পোস্টেড হতেন, এই দল ধরতে তাঁদের কালঘাম ছুটে যেত”, বললেন ফ্রান্সিস- বর্তমানে কোচির ফরেস্ট ফ্লায়িং স্কোয়াডের ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার ইন-চার্জ।
আরুভি যখন তার এক সঙ্গী সমেত ধরা পড়ল, ফ্রান্সিস জানতে চেয়েছিলেন, কেন জঙ্গল লুঠের মত অপরাধ সে করছে? যদিও ওর ঘাড়ে এই অপরাধ ছাড়াও আরও বেশ কিছু ক্রিমিনাল কেসের খাঁড়া ঝুলছিল। ফ্রান্সিসের প্রশ্নে আরুভির জবাব ছিল একেবারে সাফ কিন্তু চমকে দেবার মতন। “এমনিতে কাজের অভাব, তার ওপর বছরের পর বছর, একের পর এক বংশ ধরে অফিশিয়ালরা আমাদের গায়ে অপরাধীর তকমা সেঁটে দিয়েছে। বাধ্য হয়েছি অপরাধমূলক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে। আমরা এখনই হাতিয়ার নামিয়ে দিতে পারি, যদি তোমরা আমাদের হাতে ভালো কাজ তুলে দাও- মাসের বেতনটা যাতে নিশ্চিত হয়।”
যারা জঙ্গলে থাকেন এবং জঙ্গলের যারা স্থানীয় আদিবাসি, তাদেরকে জড়িয়ে ফেলানোটা সেই সময়ে দাঁড়িয়ে দেশিয় স্তরে এক প্রাথমিক চিন্তাভাবনা ছিল মাত্র। আজ ফরেস্ট ম্যানেজমেন্টের এই উদ্যোগ সর্বজনস্বীকৃত। ফ্রান্সিস এবং তাঁর তৎকালীন বস প্রমোদ জি. কৃষ্ণন, যিনি এখন কেরালা ফরেস্টের কনজার্ভেটর, এমন একটি মডেলের সন্ধানে ছিলেন যাতে আরুভি এবং ওর দলের সদস্যদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যায়। দুর্ভাগ্যবশত সেই সময় দেশের কোথাও এদের মত চোরা শিকারি, কাঠ পাচারকারিদের পুনর্বাসনের জন্য ফরেস্ট ম্যানেজমেন্টের কোন স্কিম ছিল না।
কিভাবে চোরা শিকারির দল জঙ্গলের রক্ষক হয়ে উঠল?
ডিপার্টমেন্ট অফিশিয়ালস এবং অরণ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বহু বৈঠক হল। অবশেষে দুই অফিশিয়াল এবং তাঁদের অধীনে থাকা ‘চিতা স্কোয়াড’ তৈরি করে ফেলল একটি পুনর্বাসন প্রকল্প। আর সেই প্রকল্পই বাধ্য করল আরুভি এবং তার গোটা গ্যাং-কে আত্মসমর্পণ করতে। আর এখান থেকেই শুরু হল ভিদিয়াল ভানাপাথুকাপ্পু সঙ্গমের এই অনুপ্রেরণার গল্প- দেশের সর্বপ্রথম ইকো-ডেভেলপমেন্ট কমিটি, যা তৈরিই করা হয়েছে তাদের নিয়ে যারা একসময় চোরা শিকার এবং চন্দন পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ঘটনাচক্রে, তামিল শব্দ ভিদিয়ালের অর্থ ‘নতুন ভোর’।
“এই ঘটনাটা সত্যিই আমাদের জীবনে নতুন ভোরের মতনই। তার আগে পর্যন্ত আমরা আটকে থাকতাম অবৈধ কাজকর্ম এবং দিনের পর দিন জেলের মধ্যে। সতেরো বছর কেটে গেল ভিদিয়াল তৈরি হয়েছে, আমার জীবনে নতুন একটা দিক খুলে দিয়েছে, নতুন মাত্রা খুঁজে পেয়েছি। আমরা এখন সম্মানের সঙ্গে কাজ করি। আমাদের আর অপরাধিদের চোখে দেখা হয় না।” বলল, এম. নাল্লামায়ান, নিজেকে সংশোধন করে নেওয়া এক চোরা শিকারি।
“কয়েক বছরের মধ্যেই এই গ্রুপ থেকে আরুভিকে তাড়ানো হয়। আরুভি কাঠ পাচারচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। তবে ভিদিয়াল দুর্দান্ত এক সাফল্য পেল। ঐ মডেল নিশ্চিত করল পরিবারগুলোর স্থায়ী রোজগারের দিকটা। পরিবর্তে তাদের জঙ্গল সংরক্ষণ এবং ইকো ট্যুরিজম অ্যাক্টিভিটির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হল। তারপর এই মডেলটি বহু টাইগার রিজার্ভ এবং স্যানচুয়ারিতে ব্যবহার করা হয়। দলের সদস্য সংখ্যা নেমে এসেছিল তেইশ থেকে সতেরোতে। তবু দলের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছিল, পেরিয়ার টাইগার রিজার্ভ এবং নিকটবর্তী কোন জঙ্গল যেমন মারায়ুরুতে আর চোরা শিকার বা কাঠ পাচার হয় না। দলের এই নাটকীয় কৃতিত্ব অর্জনই মারায়ুরের মত চন্দন গাছের ঘন অরণ্যকে পাচার নির্মূল করতে সক্ষম হয়। এমনটাই মঙ্গাবে-ইন্ডিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ এক আলোচনায় জানালেন ফ্রান্সিস।
এখন কেরালার ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট একটি শর্ট ফিল্ম প্রোডিউস করছে, নাম- ‘ভিদিয়াল’। মডেল পরীক্ষার বিষয়টাই সিনেমায় তুলে ধরা হবে। ফ্রান্সিস নিজে রয়েছেন পরিচালনার দায়িত্বে। আরুভি এবং তার দলের সদস্যদের ভূমিকায় অভিনয় করছে নিজেদের সংশোধন করে নেওয়া কিছু চোরা শিকারি এবং ট্রাইবাল ওয়াচার্স। প্রমোদ জি. কৃষ্ণনের বক্তব্য, এই প্রকল্পে দ্বিতীয়বার জড়িত রাখার কোন সুযোগ নেই, যদি সে কোন ধরণের অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। সুতরাং আরুভি এখনো পর্যন্ত এই প্রকল্পের বাইরেই রয়েছে। যদিও সে বারবার ফিরে আসার চেষ্টা এখনো করে চলেছে।
“এই প্রকল্পটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, সংশোধন কয়েদ ছাড়াও সম্ভব। এই সতেরো জন এবং তাদের পরিবার স্থানীয় জঙ্গল লুঠেরাদের ধরাতে সাহায্য করেছিল। আর জঙ্গলের আনাচে-কানাচে তাদের পা পড়ে। সুতরাং চিরুনি তল্লাশি চালাতে অসুবিধা হয়নি। অপরাধের বড় মাথাগুলোকে আমাদের হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া এমনি সময়ে কাঠ পাচার এবং চোরা শিকার নির্মূল করতে এরাই ছিল সবার আগে” বললেন ফ্রান্সিস। ওরা এখন সেই জঙ্গল পাহাড়া দেয়, আগে যে জঙ্গল তাদের কুকর্মের কেন্দ্রস্থল ছিল।
নাল্লামায়ান বলছে, সে তার নিজের জীবনে কত যে বন্য পশু হত্যা করেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। তার মধ্যে যেমন রয়েছে বাঘ, বিভিন্ন প্রজাতির লেঙ্গুর, গৌর এবং হরিণ। চন্দন গাছের কাঠ এবং রোজউড গাছের কাঠ পাচার করাতে তারা সিদ্ধহস্ত ছিল। ঐ সতেরো জনের দল যখন আত্মসমর্পণ করে, সেই সময় ওদের ঘাড়ে চোরা শিকার এবং কাঠ পাচারের তিনটে থেকে বারোটা মতন কেস তখনো ঝুলে রয়েছে।
ফ্রান্সিসের বক্তব্য অনুযায়ী, বন দফতরের এই ধরণের উদ্যোগ নিয়ে ঐ দলের মধ্যে একটা সংশয় ছিলই। সংশয় এখানেই যে, সত্যিই কি তারা নিজেদের জন্য ঠিকঠাক আয়ের পথ খুঁজে পাবে? এমনকি তাদের ঘাড় থেকে সকল অভিযোগ যে নেমে যাবে, সেটাও তারা বিশ্বাস করতে চায়নি প্রাথমিক পর্যায়ে। কিন্তু দিনের পর দিন বোঝানোর পর অবশেষে ঐ দলের সদস্যরা বন্দুক এবং তাদের অন্যান্য সামগ্রী সমর্পণ করে দিতে বাধ্য হয়।
“আমরা প্রথমদিকে ভেবেছিলাম, কর্মকর্তারা হয়ত মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের আটক করার মতলব ভাঁজছে। কিন্তু কথাবার্তা কিছুটা এগোনোর পর, তাদের উদ্দ্যেশ্য আমরা নিজেরাও অনুভব করতে পারলাম। এমনকি তারা তামিলনাড়ুর কিছু সিনিয়র ফরেস্ট অফিশিয়ালসদের মতামতকে উপেক্ষা করেছিল কারণ তারা আমাদের গারদে ঢোকানোর পক্ষে ছিল” কথাটা স্মৃতি থেকে টেনে বলল ঐ দলের আরেক সদস্য মহামায়ান।
“তামিলনাড়ু থেকে যে প্রতিক্রিয়া আমি পেয়েছিলাম, তা একেবারেই আশা দেখায় না। কর্মকর্তারা আমাদের বলতেন, ঐ লোকগুলো যে জাতের তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চুরি করে আসছে। তাদের বক্তব্য, এরা কখনোই নিজেদের পাল্টাতে পারবে না। কিন্তু দলের প্রতি আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিল” স্মৃতি উসকে বললেন ফ্রান্সিস।
চোরা শিকারি থেকে টুরিস্ট গাইড হয়ে ওঠার গল্প
দলের সদস্যদের শুরুতেই তিন মাসের লম্বা একটা ট্রেনিং প্রোগ্রাম দেওয়া হয়। তারা বুঝতে শেখে সংরক্ষণের গুরুত্ব কতটা। এদিকে তাদেরই খুব ঘনিষ্ঠ ভিদিয়াল দল তার নিজের শক্তিশালি ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দিয়েছে ইদুক্কি এবং থেনি জেলায়। চোরা শিকারি এবং পাচারকারিদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহে ঐ নেটওয়ার্ক কাজ করত। এই কয়েক বছরের মধ্যেই নেটওয়ার্ক পিটিআরে ২৩০টি চোরা শিকার এবং পাচার ধরতে সাহায্য করেছিল।
পিটিআরের ভেতর তারা কাজ করে টুরিস্ট গাইড হিসেবে। আবার এলিফ্যান্ট সাফারির ব্যবস্থাও তাদের নিজেদের রয়েছে। এছাড়া রাত্রিবেলা ঘুরে ঘুরে পাহাড়া দিত আর স্পেশ্যাল অ্যান্টি-পোচার অ্যাক্টিভিটির সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে রাখত।
প্রতি মাসে ২৬ দিন কাজের জন্য গ্রস স্যালারি পেত ২২ হাজার টাকা। পিটিআরে যে পেরিয়ার টাইগার ফাউন্ডেশন ইকো-ট্যুরিজম অপারেট করে, তারাই দলের সদস্যদের হাতে তুলে দিয়েছে রেনকোট, স্লিপিং ব্যাগ, ইউনিফর্ম এবং ছাতা। পেরিয়ারের থেক্কাদি হ্রদে ব্যাম্বু-র্যাফটিং খুব ভালো হয়।
অতএব, এখন মাইনের দুশ্চিন্তা নেই। মাসের টাকার স্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়ায় এরা ছেলেমেয়েদের ভালো পড়াশোনার খরচ দিতে পারছে। এদের মধ্যে এমন কয়েকজন রয়েছে যাদের ছেলেমেয়েরা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করছে । শিক্ষার আলোই এদের চোরা শিকারের মত অন্ধকার দুনিয়া থেকে সৎ পথে আনতে সাহায্য করছে, জানালেন ফ্রান্সিস।
তবে ফ্রান্সিসের মনে একটি চিরস্থায়ী ঘটনার স্মৃতি ঝলসে উঠল। বললেন, ওরা একবার খুব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছিল। খতরনাক অরণ্য দস্যু পালাপেত্তি মুরুগানকে হাতেনাতে ধরেছিল। মুরুগান রামেশ্বরম থেকে তীর্থ করে ফিরছিল, সঙ্গে ছিল একে ৪৭।
এই পেরিয়ার মডেল পরে বহু টাইগার রিজার্ভ এবং অভয়ারণ্যে ব্যবহার করা হয়েছিল। কেরালায় পারাম্বিকুলম টাইগার রিজার্ভ এবং তার ঠিক পাশেই রয়েছে তামিলনাড়ুর আনামালাই টাইগার রিজার্ভ। এখানকার স্থানীয় আদিবাসীরা সোশ্যাল টাইগার প্রোটেকশন ফোর্সের অংশ হয়ে গিয়েছে। একসময়ের চোরাশিকারি এবং কাঠ পাচারকারিরা আজ একজোট হয়ে জঙ্গল এবং বন্য জীবজন্তুদের রক্ষা করে চলেছে। শুধু পারাম্বিকুলামে সাতটা ইকো ডেভেলপমেন্ট কমিটি রয়েছে, এবং তারা ইকো ট্যুরিজম নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। একইসঙ্গে তারা খেয়াল রাখছে আদিবাসীদের জীবন-জীবিকার উপরে।
আসামের মানস ন্যাশনাল পার্কে এই মডেল অনুসরণ করা হয়। বোড়োল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলনকারীরা বন্য পশু, মূলত গণ্ডারের কাছে বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল। কমিটি বদলে যাওয়া চোরাশিকারিদের একজোট করে। তারাই এখন অভয়ারণ্যকে মনপ্রাণ দিয়ে রক্ষা করছে। বিশ্বের অন্যান্য জঙ্গলেও যাতে পেরিয়ার মডেল অনুসরণ করা যায়, বিশেষজ্ঞরা বারবার সেই কথা প্রকাশ্যে বলে এসেছেন।
মূল প্রবন্ধটি Mongabayপত্রিকায় প্রকাশিত। ইংলিশ প্রবন্ধটির অনুমতিক্রমে অনুবাদ করা হল বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য। মূল প্রবন্ধটির লিঙ্ক: https://india.mongabay.com/2020/03/periyar-tiger-reserve-a-trendsetter-in-converting-poachers-to-protectors/
ভাষান্তর: ঋতিঙ্কর বসু
Comments