top of page
  • ..

বিপন্ন অরণ্য, বিপন্ন মালাবার কাঠবিড়ালি

ভারতীয় জায়ান্ট স্কুইরেল বা মালাবার কাঠবিড়ালি পৃথিবীর চারটি বড় কাঠবিড়ালি প্রজাতির অন্যতম, যাদের বাস একমাত্র ভারতের বিভিন্ন অরণ্যে। অরণ্য ধ্বংস হবার সাথে কেমন ভাবে বিপন্ন হচ্ছে তারা। কী তাদের বাঁচানোর উপায়? বিশেষজ্ঞদের কী মত? লিখছেন স্নেহা মাহালে



ওদের ডাক না শুনতে পারার কথা নয়।তীক্ষ্ণ, উচ্চকিত কিচিমিচি শব্দ বনের গভীরে প্রতিধ্বনিত হয় যেখানে ওরা থাকে। শব্দটা অনুসরণ করলে দেখা পেলেও পেয়ে যেতে পারেন Indian giant squirrel এর পাতাঝরা বা চিরহরিৎ বা মিশ্র অরণ্যের উঁচু ডালে। এদের থাকার জায়গায় এদের যথেষ্ট সংখ্যায় পাওয়ার জন্য বুঝতে পারি কেন IUCN Red List এর Least Concern তালিকায় রয়েছে।

কিন্তু কাঠবিড়ালিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এই প্রজাতিটির জন্য সবকিছু ভাল যাচ্ছে না। বনজঙ্গলের ব্যাপক ক্ষয় আর অবাধ শিকারের ফলে জীবটির অস্তিত্ব সংকটের মুখে অনেক জায়গাতেই। " এই কাঠবিড়ালিরা বিভিন্ন বনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাই এদের সংখ্যা নিয়ে সঠিক জানা নেই।তবে বিভিন্ন গবেষণায় বোঝা গেছে দক্ষিণ ভারতে এদের ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ২.৩৭ থেকে ১২.২৬ বিভিন্ন অভয়ারণ্যে", জানালেন জুলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ডিরেক্টার ধৃতি ব্যানার্জী।

পৃথিবীর চার রকমের বড় কাঠবিড়ালির মধ্যে তিনটিই পাওয়া যায় ভারতে- Indian giant squirrel (Ratufa indica), the black giant squirrel (Ratufa bicolor) and the grizzled giant squirrel (Ratufa macroura)। এর মধ্যে Indian giant squirrel বা মালাবার জায়ান্ট স্কুইরেলই ভারতে বেশি সংখ্যায় পাওয়া যায়। এদের দেখা যায় পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বিস্তৃত অংশে, পূর্বঘাটের কিছু অংশে এবং সাতপুরার অরণ্যে। এরা হল মহারাষ্ট্রের রাজ্য প্রাণী, যাদের মারাঠি ভাষায় বলে সেক্রু।

এদের শরীরের দৈর্ঘ্য ২৫৪ থেকে ৪৫৭ মিলিমিটার। মালাবার জায়ান্ট স্কুইরেলের ল্যাজের দৈর্ঘ্য ওদের শরীরে সমান প্রায়। ওজনে ১.৫ থেকে ২ কেজি। কিন্তু আয়তনের জন্যই শুধু এরা বিশিষ্ট নয়। এদের শরীরে বিভিন্ন রঙের খেলা দেখা যায় যার মধ্যে কালো, খয়েরি আর গাঢ় লালই সব চেয়ে উজ্জ্বল। জায়গা অনুযায়ী এদের শরীরে রং আলাদা আলাদা ধরনের হয়, এমনকি একই এলাকাতেও ফারাক থাকতে পারে বিভিন্ন কাঠবিড়ালির মত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ভারতের দক্ষিণতম প্রান্তে যাদের পাওয়া যায় তারা সবথেকে কালো হয়, যাদের পিছনে অনেক কালো লোম থাকে। এই একই প্রকার মহারাষ্ট্রে দেখা যাবে না। কিন্তু মহারাষ্ট্রেও দুটি কাঠবিড়ালির চামড়ার রঙে ফারাক দেখা যাবে।


আকাশেই জীবন



মালাবার জায়ান্ট স্কুইরেল তৈরিই হয়েছে গাছে গাছে কাটাবার জন্য। এদের থাবা বেশ বড় আর শক্তিশালী যাতে গাছের ডাল আর বাকল ধরতে পারে শক্ত করে।অ্যাক্রোবেটের মত এরা অনেক সময় পিছনের পা দিয়ে ঝুলে থেকেই খাবার খায়। স্বভাবত: লাজুক ও সতর্ক এই প্রাণীরা খুব কমই গাছের শীর্ষদেশ থেকে নেমে আসে। তাই এরা তেমন বাসস্হানই পছন্দ করে যেখানে ঘন গাছে ঘেরা বন রয়েছে বড় এলাকা জুড়ে যা তাদের শিকার হবার থেকে বাঁচাবে আবার যথেষ্ট খাদ্য যোগাবে। এত উঁচুতে থাকলেও এই কাঠবিড়ালিরা কখনও শিকারি পাখি, কখনও বা লেপার্ডের হাতে শিকার হয়ে যায়।

এদের সামনের যে দুটি দাঁত থাকে তা জীবনভর বাড়তে থাকে। এদের প্রাথমিক খাদ্য ফল, ফুল, বীজ, পাতা, গাছের ছাল, কখনও বা পোকামাকড় বা পাখির ডিম। " মালাবার জায়ান্ট স্কুইরেলের ইঁদুরদের মত একটা ধর্ম আছে। ক্রমাগত ঠোকর কেটে যাওয়া। এরা ঠোকর কাটে গাছের ছাল বাকলে বা বাদামের শক্ত খোলকে। এটা একটা প্রকৃতিপ্রদত্ত স্বভাব যার দ্বারা দাঁতের অতিরিক্ত বৃদ্ধি রোধ করে", বলছিলেন নিবেদিতা পান্ডে।যিনি বন্দী অবস্হায় জন্ম নেওয়া মালাবার জায়ান্ট স্কুইরেলের দাঁতের যত্নের উপরে একটি বইয়ের সহ-লেখক।


গাছের ওপরে বাসা। ছবি: Phadke09/Wikimedia Commons.

বাস্তুতন্ত্রে ভূমিকা


ফলের বীজ ছড়িয়ে বনের বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় এই কাঠবিড়ালিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এভাবেই বন বাড়ে, বেঁচে থাকে। আশ্রয় পায় বন্যপ্রাণীরা, সংঘাত কমে মানুষের সাথে। একটা বড় বিষয় এরাও একটা সূচক প্রাণী (indicator species), যাদের উপস্হিতি বনের স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারনা দেয়। Wildlife Conservation Trust এর প্রেসিডেন্ট অনীশ আন্ধেরিয়া দীর্ঘদিন এদের নিয়ে কাজ করেছেন মহারাষ্ট্রে। তিনি বললেন, " এদের টিকে থাকার জন্য চাই লম্বা বৃক্ষ আর ঘন গাছের আস্তরণ।যদিও Status of Forest Report 2021 অনুযায়ী অরণ্য আচ্ছাদন বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু সেসব অরণ্যের গুণগত মানে হ্রাস হয়েছে। যেমন বলা যায় ঘন বনগুলি হালকা হয়েছে। একটি এমন নষ্ট হতে বসা বনের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া আছে এই সব জীবের উপরে।

এই কাঠবিড়ালিরা একাই থাকে, কিন্তু প্রজনন কালে এদের জোড়ায় দেখা যায়। এরা একই সাথে একাধিক ডালপালা বানায় পাতা আর ডালপালা দিয়ে। সাধারণত; নদী বা ঝরনার কাছাকাছি শাখা-প্রশাখা যুক্ত গাছপালার ডালে এরা বাসা বাঁধে। স্ত্রী কাঠবিড়ালি অনেক ছোট বাচ্চার জন্ম দেয়, যাদের মধ্যে সাধারণত: একটিই পরিণত বয়সে পৌঁছায়।


সংকট


গাছে বসবাসকারী প্রাণী হিসাবে এই ভারতীয় বড় কাঠবিড়ালির চাই অনেকটা এলাকা জুড়ে ফলের গাছ,পোকামাকড়, গাছের ছাল বাকল খাবার জন্য আর প্রজননের জন্য। বনভূমির ধ্বংস, বনভূমির ভাগ হয়ে যাওয়া, বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তাঘাট বা বৈদ্যুতিকের তারের লাইন নিয়ে যাওয়া, পুরানো লম্বা গাছ কেটে ফেলার ফলে এদের সংখ্যা কমতে বাধ্য।গাছের ছাতার মত আস্তরণ কমে যাওয়ায় এরা নীচে নেমে এলে গাড়ি চাপা পড়ে মারা যাবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

জুওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর ধৃতি ব্যানার্জী জানালেন, " এরা পুরোপুরি বনের উপর বেঁচে থাকে, সাধারণ কাঠবিড়ালির মত তার বাইরে আধা অরণ্যের এলাকায় বাঁচতে পারে না। তাই বনভূমির ক্ষয় এরা মানিয়ে নিতে পারে না। ফলে এদের সংখ্যা কমছে।চোরাশিকার, বিশেষত: পূর্বঘাট এলাকায় বিপন্ন করে তুলছে এই প্রজাতিদের।"


বর্ন ফ্রি


আরও একটা উদ্বেগের বিষয় হল এই কাঠবিড়ালিরা বন্দী অবস্হায় বংশবৃদ্ধিতে প্রায় অক্ষম। এটা করতে হলে তাদের প্রাকৃতিক বাসস্হানের বিকল্প বানাতে হবে সেখানে আর নির্জনতা প্রিয় এই প্রাণীদের সব রকম উপদ্রব থেকে রক্ষা করতে হবে।

"ভারতীয় বড় কাঠবিড়ালিরা বড় চঞ্চল প্রাণী। বন্য পরিবেশের থেকে কৃত্রিম প্রজননের এলাকা অনেক ছোট হয়, ফলে গাছ থেকে গাছে লাফানোর অভ্যাসটি এক্ষেত্রে পালন করা সম্ভব হয় না। সম্পূর্ণ যে এদের খাদ্যতালিকা, তাও এখানে পূরণ করা সম্ভব হয় না। নরম খাবার দেওয়া হলে ওদের যে প্রাকৃতিক স্বভাব শক্ত খোলায় ঠোকরানোর, সেটাও করতে পারে না। শুধুমাত্র ফলের উপর নির্ভর করে থাকায় তাতে যে অতিরিক্ত শর্করা থাকে তা ওদের দাঁতের ক্ষতি করে মানুষের মতই", জানালেন নিবেদিতা পাণ্ডে।


তাই ভারতীয় বড় কাঠবিড়ালিদের জন্য দরকার সামগ্রিক পরিকল্পনা যেখানে ভাবা হবে বনভূমির সংরক্ষণের কথা, এইসব প্রাণীদের পছন্দের গাছ চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করা হবে, বাসস্হান ধ্বংস রোধ করা হবে আর মানুষের অনুপ্রবেশ ঠেকানো হবে সেখানে। ড:আন্ধেরিয়ার মতে," কখনও কখনও সংরক্ষণের প্রচেষ্টাগুলো মার খায় যখন সব চেষ্টাটা বিশেষ প্রাণীটির উপরেই দেওয়া হয় সামগ্রিক পরিবেশের বদলে। ওদের পুরো বাসস্হানের দিকেই নজর দিতে হবে যাতে ঠিকমত খেতে পারে ওরা আর যাতায়াত করতে পারে। এগুলো করতে পারলে তবেই প্রাণীটি টিকবে।"


ছবি: বনেপাহাড়ে

Wikimedia Commons


মূল প্রবন্ধটি Mongabayপত্রিকায় প্রকাশিত। ইংলিশ প্রবন্ধটির অনুমতিক্রমে অনুবাদ করা হল বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য। মূল প্রবন্ধটির লিঙ্ক: https://india.mongabay.com/2022/11/how-preserving-forests-could-save-the-indian-giant-squirrel/

Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page