top of page
  • ..

পুরুলিয়া বনাঞ্চলের সঙ্কোচন ও পরিণতি

পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমে জঙ্গলমহলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ পুরুলিয়া জেলা। বিগত কয়েক দশকে নগর সভ্যতার বিস্তার ও কৃষিজমির প্রসারের সাথে সাথে তার অরণ্যভূমি হয়ে পড়েছে সংকটাপন্ন। বিপন্ন বন্যপ্রাণীরাও। ধরা পড়ল দুই গবেষকের চোখে। সেই অভিজ্ঞতাই লিখছেন জয়দীপ চক্রবর্তী ও অভিজিৎ দে



১৯৮০ এর দশক । অধুনা ঝাড়খন্ড লাগোয়া পুরুলিয়া জেলার অতি প্রত্যন্ত অঞ্চল । তিনদিক পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা, একদিক খোলা । সারা দিনে পাঁচ টি বাস যায়, বিকালে ফেরে, একটি জীপ্ লোকজন পেলে বারে বারে যাতায়াত করে । মানুষের জীবিকা কৃষি আর পশু পালন । চাষ যোগ্য করে তোলা জমি জলধারা বা জলাশয়ের আসে পাশে বিস্তৃত । বাকি অঞ্চল রুক্ষ, শুষ্ক, উঁচু নিচু হয়ে দিগন্ত বিস্তৃত । ক্ষেত বাদ দিলে প্রায় সবটাই মাটি কামড়ে থাকা চাপ ধারা ঘাসে ঢাকা, যা বছরের বৃষ্টির তিন চার মাস বাদ দিলে হলদে আর ধূসর হয়েই থাকে । বালু মিশ্রিত কাঁকুড়ে মাটির এই খোলা অঞ্চলে গাছ আছে, তবে এক দুটো কোথাও কোথাও, কখনো বা চার পাঁচটা একসাথে । মূল বসতির বাইরে দূরে দূরে কিছু মানুষের ঘর আছে, পাঁচ সাতটা করে একসাথে, যেন একটা আর একটার ঘাড়ের ওপরে উঠে রয়েছে । সেই গুলির আসে পাশে কিছু ছায়াদার গাছ আছে- বট, মহুয়া, খয়ের, শিশু, কুসুম, জিলাপি, তেঁতুল মুখ্যত।

খাটিয়া তে বাসে থাকা বৃদ্ধদের কথায় বলি, কিছু বছর আগেও এই সব জায়গাতে ওই পাহাড়ের নিচের মতোই ঘন জঙ্গল ছিল, আমার বাপ-দাদারা মিলে এই জমি তৈরি করেছে গাছ পালা কেটে । তাহলে, এহেন অতি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বনভূমির সঙ্কোচন শুরু হয়েছিল অনেক আগেই, এবার সেটা খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে । প্রান্তিক ক্ষেত্র গুলো পেরিয়ে এগোতে থাকলে আবার সেই কম বেশি গাছের জঙ্গল, যা ঘন হয়ে পাহাড়ের পাদদেশ ছুঁয়ে, পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠে গেছে । দুই প্রান্তে দৃষ্টি সীমা পার করে যাওয়া ধূসর পাহাড়ের প্রথম সারি পেরিয়ে গেলে দেখা যায় সেই সব অঞ্চলে বনভূমি সত্যি ঘন, প্রায় সব ধরণের বুনো জন্তুর বাস। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, লেপার্ড , ভাল্লুক, বুনো মোষ, হাতি , নেকড়ে, হায়েনা, শজারু , বুনো শুয়োর , কিছু প্রজাতির শেয়াল ও হরিণ আর হাজারে হাজারে খরগোশ ।



বেলা পড়ে এলে প্রথমে ফিরে আসে গরু ছাগলের দল আর রাখালেরা, তাদের পিছনে ফিরে আসে লম্বা লম্বা জ্বালানি কাঠের বোঝা নিয়ে নারী পুরুষ । দিনের শেষ পথিক । তারপর আর ওই সব দিকে কেউ যায় না, পুরোটাই অরণ্যচারীদের বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে ।অন্ধকার নামার পর ওই সব দূরের অঞ্চলে টর্চ এর জোরালো আলো ফেললে যেন শয়ে শয়ে হলদে জ্বলন্ত কাঁচের গুলি মাটি ঘেঁষে নড়া চড়া করছে বোঝা যায়। ওগুলো খরগোশ। হরিণের দল এদিক ওদিক ঘুরে, দৌড়ে বেড়াচ্ছে তাও সহজেই বোঝা যায়। আর কখনো কখনো বেশি রাতে শোনা যায় অন্য রকম গর্জন, রাতে জাগা কিছু পাখির ডাকের সাথে মিলে মিশে আসে । ভোরের আলো ফুটতেই আবার সব কিছু মানুষের নিয়ন্ত্রণে।


২০১০ এর দশক, মাঝখানের বছর গুলোতে অদ্ভুত অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটে গেছে যেন সব দিক থেকেই । ওই সব প্রান্তিক প্রত্যন্ত বসতি অঞ্চল এখন শহর, স্বল্প শ্রেণীবদ্ধ ঘর এখন বড়ো গ্রাম । দিগন্ত জোড়া ঘাসের মাঠ, চারণ ভূমি এখন চাষের জমি তে সম্পূর্ণ রূপান্তরিত হয়ে পাহাড়ের পাদদেশ ছুঁয়েছে । জঙ্গল যা অবশিষ্ট আছে তা পাহাড়ের গা চেপ্টে আটকে আছে যেন ।

পাহাড় পেরিয়ে অন্য প্রান্তে গেলে আরও করুন ছবি ধারা পড়ে । নিবিড় অরণ্য এখানে ফাঁকা ফাঁকা , ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে কোনও রকম টিকে আছে । একাধিক রাজপথ তাদের বিভক্ত করেছে বারে বারে । মানুষের ঘর , বসতি , আরও নানা কিছু তৈরি হয়েছে আর চাষের জমি বেরিয়েছে অনেক । ছোট পাহাড়ি নদী কে বাঁধ দিয়ে আটকে তৈরি করা হয়েছে “Hydel Power Projects”, অবশ্যই অরণ্য ভূমি ধ্বংস করে । এখানেই শেষ নয় , পাহাড়ের পাদদেশ যেখানে জমি অতিশয় অনুর্বর বা তীব্র জলাভাব সেখানেও পড়েছে মানুষের থাবা । গজিয়ে উঠেছে “Eco Tourism” resorts. বড় বড় অঞ্চল কাঁটা তার দিয়ে ঘিরে, দেদার আমোদের আয়োজন।




নিস্তব্ধতা, স্বাভাবিক বন্য জীবনের একটা প্রধান শর্ত । এই সব অঞ্চল এতটাই নিস্তব্ধ ছিল যে গাছের পাতা উপরের ডাল থেকে বৃন্ত চ্যুত হয়ে নিচের ক’টা ডালের স্পর্শ নিয়ে ঠিক কি ভাবে মাটি ছুঁলো, স্পষ্ট বোঝা যেত। আদর্শ পরিবেশ এটাই । এর নিরিখে ওই ধরনের আওয়াজ আর আলো বন্য জীবনের ওপরে কি তীব্র প্রভাব ফেলতে পারে তা অনুমান করা কঠিন নয়। বৃত্ত সম্পূর্ণ হতে আর একটু বাকি আছে । অসাধু কাঠ পাচার চক্র এবং চোরা শিকারি, বন ও বন্য প্রাণী ধ্বংসের সবচেয়ে কার্যকরী দুটি অংশ। প্রথম দিকে বিস্তীর্ণ অরণ্যভূমির প্রান্ত সীমা কে ঠিক রেখে ভিতরে গভীর অংশের গাছ পালা কেটে মুক্ত অঞ্চল তৈরি করা, ধীরে ধীরে সেই পরিধি বৃদ্ধি করা, আর নির্বিচারে পশু পাখি হত্যা করা, মাঝে মাঝে কিছু কিছু গাছ পালা রেখে দেওয়া - এটাই পদ্ধতি। পনেরো থেকে কুড়ি বছর পর কোথায় জঙ্গল কোথায় কি - সব চাষের জমি আর বসত বাড়ি।



কেন এমন ঘটলো?স্বাবলম্বী না বিত্তশালী? এই দুই এর মধ্যে পড়ে এমন হয়ে থাকবে।বনের মানুষ তো সত্যি বিত্তশালী - স্বাবলম্বী ছিল, আজও আছে । আদিবাসীদের বিত্তশালী হবার শর্ত 1) গবাদি পশুর সংখ্যা 2) বাস্তু ভিটা মানে মাটির বাড়ি আর গোয়াল 3) সারা বছরের খাবার জোগাড় হয় এমন চাষ যোগ্য জমি। গবাদি পশুর সংখ্যা প্রাকৃতিক উপায়েই বৃদ্ধি পায়, বাড়ি ইত্যাদি বংশ পরম্পরায় আছে এবং বেড়েছে, বাকি থাকল ক্ষেত আর ফসল। সেটা বৃষ্টির নিয়ম ধরে চলে, মূলত ধান, ভুট্টা, জোয়ার, ডাল, বাদাম, আর নানা রকম সবজি । জঙ্গলের ফল মূল সারা বছর আছে, যখন যেটা ফলে। চাষের জমির পরিমাণ কেও বৃদ্ধি করতে হয়েছে তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও চাহিদা বৃদ্ধি ততটা মারাত্মক ছিল না যে এই ভাবে বনাঞ্চল ধ্বংস করতে হবে । অনাবাদী জমি উদ্ধার করেই সেটা পূরণ করা যেত ।


বন্য প্রাণীর কথা আর কি বলব । জঙ্গল নেই তাই জানোয়ার-ও নেই। চার মাসের নিরন্তর চেষ্টায় একটি স্ট্রাইপড হাইনার ছবি তুলতে পেরেছি । যেটা আজ এত দুর্লভ, সেটা মাত্র কুড়ি বছর আগেও ঘরে ঢুকে মানুষের বাচ্চা নিয়ে পালিয়ে যেত । হাতির দল আসে যায়, ক্ষোভ বিক্ষোভ দেখায়, মাঝে মাঝে বেশি রেগে গেলে ভাংচুর করে, আবার সব ঠাণ্ডা হয়ে যায় । পাহাড়ের ওপরে থাকা বানরের দল জঙ্গলে খাবার না পেয়ে ক্ষেত খামার আক্রমণ করে, কয়েক ঘণ্টায় সব শেষ করে ফিরে যায় । এছাড়া শেয়াল, ময়ূর আর কিছু পাখি আছে । বহু মাসের চেষ্টায় ভাল্লুকের স্ক্যাট (মল) দেখতে পেয়েছি এক বার মাত্র । এদের সংখ্যাও এত ছিল যে দিন পড়ে এলে কেউ একা বেরত না । নির্বংশ হয়ে গেছে সব ….অরণ্যের মতোই ।

আমরা প্রগতি বিরোধী নোই । এটাও বলছি না যে অরণ্য সম্পূর্ণ  ধ্বংস হয়ে যাবে । মরে যাওয়া নদী যেমন ছোট ছোট জলাশয়ে বিভক্ত হয়ে টিঁকে থাকে তেমন করে থাকবে, না থাকার মতো করে। আর বন্য প্রাণী ? সেও থাকবে । কেন চিড়িয়াখানায় জানোয়ার থাকে না ? এগুলো খাঁচা-হীন চিড়িয়াখানা হয়ে যাবে ।



এই সবের পরিণতি ভয়াবহ , আমাদের কল্পনার অনেক বাইরের । ২০১০ এর দশকের শেষ থেকেই অনিয়মিত কিন্তু অতি প্রবল বৃষ্টিপাত, মাত্রাতিরিক্ত উষ্ণতা বৃদ্ধি, রুক্ষ শুষ্ক অঞ্চলে আপেক্ষিক আর্দ্রতার অতি বৃদ্ধি, একটানা মেঘলা অল্প দিনের শীতকাল এক ভয়াবহ পরিণতির ইঙ্গিত করছে । আদিবাসী সমাজ সেটা বুঝতেও পেরেছে । কয়েকটি অতি জরুরি ফসল, আর এক দানাও ফলাতে পারছে না তারা । অনেক দেরি হয়ে গেছে। এবার ফল ভুগতেই হবে । কিন্তু প্রগতি-মুখী আধুনিক সমাজ বা সেই সমাজ-চালিত সরকার কি বুঝতে পেরেছে? পরিবেশ ও উন্নয়ন যে পরস্পর-বিরোধী নয়, বরং পরিবেশের উপর মানুষ এর ভালো থাকা যে অনেকাংশে নির্ভর করে, তা বোঝা কি এতোই কঠিন!

যা হোক, আশার আলো খুব কম হলেও, এখনো হয়তো কিছু করা যেতে পারে, তবে আমাদের হাতে সময় সত্যি খুব কমে এসেছে। কয়েকটি পদক্ষেপ আমাদের দৃষ্টি ও বুদ্ধি তে কার্যকরী হবে বলে মনে হয়েছে ।

কঠোর অনুশাসন, কঠোর শাস্তি অতি প্রয়োজনীয়, তবে এতেই সব কিছু হয়ে যাবে না । দূরদর্শী ও সুদূরপ্রসারী সঠিক পরিকল্পনার-ও অতিশয় প্রয়োজন রয়েছে । বনাঞ্চলের ভিতরে বা অতি কাছে গড়ে ওঠা বসতির স্থানান্তরণ খুবই জরুরি । শিল্পোন্নয়ন বনভূমি ধ্বংস করে সৃষ্টি না করা । এর সাথে শহরের মানুষের পর্যটনের নামে যথেচ্ছাচার বন্ধ করা । প্রয়োজনে কিছু বছরের জন্যে গমনাগমনের ওপরে নিষেধাজ্ঞা বা নিয়ন্ত্রণ জারি করা । ওই সময়ের মধ্যে প্রকৃতি নিজেই নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারবে । সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থা দের দিয়ে দ্রুত বনাঞ্চলের বিস্তার ঘটানো। জঙ্গল তৈরি করতে পারলেই বনের জন্তু -ও ফিরে আসবে স্বাভাবিক নিয়মেই । বেআইনি দখল করা অরণ্য ভূমি ফিরিয়ে নেওয়া অথবা সরকার-এর তরফ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে দখলি জমি উদ্ধার করে, জঙ্গল ফেরানো । দীর্ঘ স্থায়ী পরিবর্তনের জন্যে আদিবাসী শিশুদের মধ্যে নিয়মিত ভাবে বন-সৃজন এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ (community conservation) বিষয়ে চেতনা তৈরি করা, হাতে কলমে কাজ করানো, অরণ্য এবং জন্তু জানোয়ারের ওপরে গবেষণা মূলক কাজে সরাসরি জঙ্গলের মানুষ ও শিশুদের অংশগ্রহণ করানো উপযুক্ত পদক্ষেপ হতে পারে । আর সর্বোপরি, আদিবাসীদের হাতে অরণ্য ভূমির রক্ষণাবেক্ষণ ছেড়ে দেওয়া । তাদের কথায় “বন আমাদের দিয়ে দে, আমরা বাঁচিয়ে নেবো” । এটাই এখন একমাত্র আশার আলো বলতে পারি।


লেখক পরিচিতি:


জয়দীপ চক্রবর্তী একজন প্রশিক্ষিত পর্বতারোহী যিনি ছোটনাগপুর মালভূমির জীববৈচিত্র ও এর সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করছেন। অভিজিৎ দে বর্তমানে Ashoka Trust for Research in Ecology and the Environment (ATREE) তে আদিবাসী-মহুয়া সম্পর্ক নিয়ে পুরুলিয়া অঞ্চলে গবেষণা করছেন।

Comments


Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page