top of page

স্বপ্নের গ্রাম সুরকুমি: পালামৌর অন্দরে

  • ..
  • May 7, 2023
  • 4 min read

পালামৌয়ের অরণ্য ঢাকা এখনও আদিমতায়। তার অন্দরে-কন্দরে না-দেখা রয়েছে কত সৌন্দর্যের আকর। তারই সন্ধানে কলম ধরলেন সৈকত চট্টোপাধ্যায়



আপনারা অনেকেই হয়ত পালামু টাইগার রিজার্ভ এর অন্তর্গত মারোমার গেছেন। নিস্তব্ধ, নীরব, নিবিড় মায়াবন্ধনে বাঁধা মারোমার। এই মারোমার থেকে মিনিট কুড়ির পথ গেলে দেখা পাবেন স্বপ্নের গ্রাম সুরকুমির। গ্রামে না পৌঁছেছে বিদ্যুৎ না আছে পাকা রাস্তা। লাল আর গেরুয়া সুরকি বিছানো আঁকা বাঁকা পথে দুলুনি খেতে খেতে যেই আপনার গাড়ি সুরকুমির সীমানায় ঢুকবে, আপনি পদে পদে গাড়ি থামাতে বাধ্য হবেন। না না খারাপ রাস্তার জন্যে না, গাড়ি থামাতে হবে ফটো তোলার জন্যে, অপূর্ব সুন্দর ‘আনটাচড’ জঙ্গলকে ক্যামেরা বা চোখের লেন্সে বন্দী না করে থাকতে পারবেন না। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যই না, যদি আপনি ইন্টারেস্টেড হন গ্রামীণ দৈনন্দিন জীবন যাত্রা কে কাছ থেকে দেখার বা লেন্স বন্দী করার তাও করতে পারেন স্বচ্ছন্দে, কেউ বাধা দেবে না, জিজ্ঞেস ও করবে না , কারণ এই গ্রামের লোকেরা সবাই শুটিং সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আমার উদ্যোগে এখানে একটি বাংলা ও একটি হিন্দি/বাংলা সিনেমার শুটিং হয়েছে, আগস্ট এ শুরু হবে আর একটি বাংলা সিনেমার কাজ। তাতে গ্রামের বহু মানুষের কম সময় এরজন্য হলেও কাজ জুটেছে, জেনে অবাক হবেন এই গ্রামের অনেকেই ক্যামেরার সামনে অভিনয় ও করেছেন, তাই এরা বাইরে থেকে কেউ আসলে বাধা দেয় না আর খারাপও ভাবেন না। গ্রামে আছে দুটি আদিবাসী লোক নৃত্যের দল, আজকাল তারাও বাইরের কল শো পাচ্ছেন, রোজগার পাচ্ছেন। আমি এই গ্রামটি খুঁজে পাই মারোমারে আমার গাইড অর্জুনের দৌলতে। প্রতিবছর আমার নাটক গোষ্ঠীর ছেলে মেয়েদের নিয়ে পালামু টাইগার রিজার্ভ এর সুদূর গ্রামগুলি তে ক্যাম্প করে বস্ত্র বিতরন করে থাকি, ২০১৮- এ এই রকম এক ক্যাম্প করতে গিয়ে অর্জুন বলে এই গ্রামটির কথা, এখান কার নিরীহ, সুবিধা বিহীন, সরল গ্রাম্য অধিবাসী দের কথা। সেই শুরু। তারপর থেকে বহু বস্ত্র বিতরণ ক্যাম্পের মাধ্যমে অনেক কাছাকাছি এসেছি এদের।

বেশির ভাগ মানুষই গরীব। যুবকরা গুজরাট, কোলকাতা, কানপুর, চেন্নাই, দিল্লি, কাজের জন্য এমনকি কাশ্মীর অবধি আনাগোনা করে। এবার ইচ্ছে আছে বস্ত্র বিতরনের পাশাপাশি একটি হেলথ ক্যাম্পও করার। দেখা যাক কতটা করা যেতে পারে। এ তো গেল গ্রামটির সাথে আমার অ্যাটাচমেন্ট এর কথা , আসুন আবার গ্রামে ফিরে যাই। গ্রামটি আদবাসি বহুল, চেরো রাজ সম্প্রদায়ের অনেকে আছেন, আছেন আদিম জনজাতি পারহাইয়া, বাদ বাকি কিছু ঘর যাদব, সাহু ইত্যাদি। নতুন প্রজন্মের প্রায় সকলেই শিক্ষিত, শিক্ষায় মিশনারি দের প্রভাব থাকলেও, এই গ্রামের লোকেরা বহু কষ্ট সয়েও এখনও ধর্ম পরিবর্তন করেন নি। আসে পাশের গ্রামে বেশি সংখক মিশনারী হলেও এরা এখনও মনে প্রাণে ধরে রেখেছেন নিজেদের পুরাতন সংস্কার, ঐতিহ্য। না, কোনো হিন্দু ধ্বজা বাহী রাজনৈতিক বা ধার্মিক সংগঠনের প্রতি অতি আগ্রহে না শুধু মাত্র নিজেদের তাগিদেই নিজেদের পুরাতন কে বাঁচিয়ে রাখা।তাই এদের আদিমতাটা কাছে টানে। গ্রামটি চারি দিক দিয়ে পাহাড় ঘেরা, মাঝখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘর বাড়ি, খেতখামার, প্রাথমিক স্কুল, অঙ্গানবাড়ী কেন্দ্র। মাঝখান দিয়ে বয়ে যায় পাহাড়ি ছোট নদী। এরই মাঝে গ্রামবাসীদের দৈনন্দিন জীবনের নানা কাজ।

গ্রামটির সৌন্দর্য্য উপভোগ করার সব থেকে ভালো সময় ভরা বর্ষা, হাড় হিম শীত আর স্বচ্ছ শরত।আমার নিজস্ব পছন্দ ভরা বর্ষা, তবে রিস্ক আছে, যে কোনো সময় পা পিছলে পড়ার, সাপের কামড় খাওয়ার আর হাতির তাড়া খাবার। এই তিনটে যদি সামলে নিতে পারেন তাহলে কাদায় আটকে যাওয়া গাড়ি ধাক্কা দেবার জন্যও তৈরি থাকবেন। এবার এই চারটের জন্যে যদি তৈরি থাকেন তাহলে কথা দিচ্ছি মনের মণিকোঠায় যা নিয়ে ফিরবেন, তা ভুলতে পারবেন না বহু বহুদিন। এই সামান্য ঝুঁকির বিনিময়ে নিয়ে ফিরবেন বুক ভরা তাজা প্রাণ প্রাচুর্য, চোখ ভরা সতেজ সুন্দরতা আর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার তাগিদ। রোদ ঝলমলে প্রাণ চঞ্চল সকাল কি করে মুহূর্তের মধ্যে কালো মেঘে মুখ ঢেকে অভিমান করে অঝোর ধরায় কেঁদে ভেসে যাবে সেটা ঠিক করে বোঝার আগেই আপনিও ভেসে যাবেন। হয়তো মনে পড়ে যাবে, ভিক্টোরিয়া, একাডেমী বা নন্দন চত্বরেএমনি করেই কোনো একদিন আপনার প্রেমিকাও অভিমানের কালো মেঘে ঢেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল আপনাকে। না, ভুল করেও মান ভঞ্জন করতে যাবেন না , কাঁদতে দেবেন, ভাসতে দেবেন, ভাসাতে দেবেন, আর চুপ করে উপভোগ করবেন বৃষ্টিকে, পাহাড়ের গায়ে আটকে থাকা ঘন মেঘকে, মন উলোট পালোট করা দমকা হাওয়ার ঝাপটা কে। আর পারলে আর একটা ঝুঁকি নেবেন, পকেটে প্যারাসিটামল রেখে তাল মেলাবেন বৃষ্টির সাথে। অঝোর ধারায় ঝরে পড়া পবিত্র জল শুধু শুদ্ধই না এক নির্মল আনন্দধারায় ভরিয়ে দেবে আপনাকে। বর্ষা তে ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে যখন শীতের নরম রোদ গায়ে মেখে অলস ভাবে শুয়ে থাকবে জঙ্গল তখন ও আসতে পারেন।সে সময় শুধু হাতির ভয়, আমি এই সময় বহুবার হাতি পেয়েছি। সামনে হাতি থাকলে ভয় পেয়ে চিৎকার করবেন না , গাড়ির হর্ন ভুলেও বাজাবেন না , এদিক ওদিক দৌড়ঝাঁপ করবেন না , চেষ্টা করবেন যতটা পারবেন দূরত্ব বজায় রাখার, নড়াচড়া না করে স্থির থাকার। হাতি নিজের মত চলে যাবে।শীতকালটা ছবি তোলার জন্যে বেশ ভালো। কুয়াশার চাদর গায়ে অলস গ্রাম বলুন, সোনালী রোদ পেয়ে ঘুম ভাঙ্গার খেলা বলুন সবই খুব সুন্দর ধরা পড়বে। তবে মার্চ শেষ থেকে জুন অবধি না আসলেই ভালো, একটু কাঠখোট্টা হয়ে যায় তখন জীবন অর জঙ্গল দুটোই।



থাকারজায়গা

ডাল্টনগঞ্জপ্রায় ৮০ কিলোমিটার

বেতলাপ্রায় ৬০ কিলোমিটার

সবথেকে ভালো মারোমার বন বাংলো আর ট্রি হাউস মিনিট কুড়ির পথ, তাছাড়া ৪০ থেকে ৪৫মিনিট গেলে পাবেন বাড়েসার বন বাংলো,


গ্রামে হুট করে ঢুকবেন না, সাথে স্থানীয় লোক, বা স্থানীয় লোকের সাথে যোগাযোগ করে যাওয়াটাই ভালো, কারণ স্থানীয় লোকেরা ভালো হলেও, মাঝে সাজে এরা কোনো অনুষ্ঠান বিশেষে বা গ্রামে কোনো বিয়ে বাড়ি থাকলে খুব মদ খায়। সেইসময় আপনাকে এরা ভালোবেসে অ্যাপায়ন করলে সেই ভালোবাসার দৌরাত্ম্য টা আপনার সহ্য নাও হতে পারে.


আর একটা কথা জানিয়ে দি, সম্প্রতি এখানে গল্প করতে করতে জানতে পারলাম গ্রামের সীমানায় একটি সুন্দর পাহাড়ি ঝর্না আছে, সাত কিলোমিটার হেঁটে যেতে হবে। শুনেই যেতে ইচ্ছে করেছিল, কিন্তু ঠিক করেছি এখানে ভরা বর্ষায় যাব, কারণ প্রথম দেখা আর শুভদৃষ্টিটা ভরা বর্ষার যুবতী ঝর্না র সাথে করাই শ্রেয়কর, প্রেম টিকবে বহুদিন। আমি আগে যাই, তারপর তার সন্ধান দেবো আপনাদেরও।


ছবি: লেখক


লেখক পরিচিতি: লেখক ঝাড়খন্ড স্থিত এক সাংবাদিক, বন্যপ্রাণ ফটোগ্রাফার ও সংস্কৃতিকর্মী।






Comments


474525369_1074216644505260_833710345513391369_n.jpg
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG

Editor: Dr. Sumanta Bhattacharya
Co-editor: Dr. Oishimaya Sen Nag

  • Facebook

follow our facebook page to stay updated

© 2021 by Boney Pahare. All rights reserved.

bottom of page