top of page
  • ..

সীতার বনে একটা রাত

করবেট টাইগার রিজার্ভের সন্নিহিত একটি বন সীতাবনি। বিশ্বাস অনুযায়ী এখানেই নাকি বনবাসে ছিলেন মা সীতা তাঁর দুই পুত্র লব-কুশকে নিয়ে বাল্মীকির আশ্রমে। সেই অরণ্যে রাত্রিবাসের গল্প বনেপাহাড়ের পাতায় সুমন্ত ভট্টাচার্য্যের কলমে।


সীতাবনি


“ওই যে উপরের ওই পাহাড়গুলো দেখছেন, ওখান ছোট ছোট গ্রাম আছে। কিন্তু গ্রামের লোকরা সন্ধ্যার পর থেকে আর বার হতে পারে না ঘর থেকে। প্রচুর তেন্দুয়া এই জঙ্গলে। তারা হামলা করে মানুষের উপর”, খাদের উপরে রেলিংটার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমি আর পুরনজি। কথাগুলো বলছিলেন আমাকে তিনি ওই দূরের পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে। তেন্দুয়া মানে স্থানীয় ভাষায় চিতাবাঘ বা লেপার্ড। আমরা দাঁড়িয়ে প্রাচীন সীতাবনি বনবাংলোর চত্ত্বরে। করবেট টাইগার রিজার্ভের একটি জোন এই সীতাবনি।

তখন সবে কোভিডের প্রথম ঢেউ একটু স্তিমিত হয়েছে। ঘরে থেকে আর কাজের জায়গায় কোভিড ডিউটি দিতে দিতে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তাই কোভিডের ধাক্কা একটু কমতে বাউন্ডুলে মনটা এবার উচাটন করতে লাগল। ঘরেও সবার জীবন একঘেয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় হঠাৎ একদিন করবেটের ওয়েবসাইটে চোখে পড়ল মালানির বনবাংলোর ঘর খালি। এ তো অবাক বিষয়! করবেটর অভ্যন্তরে যেকোন সময়ে বুকিং শুরু হবার সাথে সাথে সব বুকিং শেষ হয়ে যায়। দেশি-বিদেশি অতিথিদের জন্য বড় লোভনীয় করবেটের অভ্যন্তরে থাকার হাতছানি। কারণ ভারতে এখনও পর্যন্ত এখানেই শুধু বনবাংলো পাওয়া যায় বনের কোর এরিয়ায় পর্যটকদের জন্য। সে এক অদ্বিতীয় অভিজ্ঞতা যে কোন প্রকৃতিপ্রেমিকের জন্য। তাই চটজলদিই বুক করে নিলাম মালানির বনবাংলোর দু’টি ঘর। ছোট্ট এই বনবাংলোয় দুটিই ঘর আছে। তাই আমরা দুটি ঘরই বুক করে নেওয়ায় দুই দিন নিরবচ্ছিন্ন শান্তি বনের ওই গহীনে। আহা! মালানি নদীর ধারে এই বাংলোয় থাকার ইচ্ছা কতদিনের। তার অফুরান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য তো বটেই। আর একদিক থেকেই ওই বনবাংলোর গুরুত্ব রয়েছে ঐতিহাসিকভাবে। কারণ করবেট সাহেবের সাড়া জাগানো MAN EATERS OF KUMAON শুরুই হচ্ছে এই বাক্যগুলি দিয়ে- “ I was shooting with Eddie Knowles in Malani when I first heard of the tiger which later received official recognition as the Champawat man-eater”.

সে না হয় হল বুকিং। আমরা সবাই আবার প্রকৃতির কাছে গিয়ে দাঁড়াবো। কিন্তু শুধুই কি মালানি! যথারীতি ধিকালা জোনে এই দু:সময়েও কোন ঘর খালি নেই। তাহলে আর কিভাবে করবেটকে উপভোগ করা যায়? মাথায় এসে গেল সীতাবনির সেই পুরানো বনবাংলোর কথা। করবেটের পাশেই এই দিকটায় পর্যটকদের পায়ের ধুলো কমই পড়ে। আর সীতাবনির বনবাংলো সেখানে দাঁড়িয়ে আছে অনেক ঐতিহ্য আর অনেকখানি সৌন্দর্যের ডালি বুকে নিয়ে। কিন্তু সেই বনবাংলো তো পর্যটকদের বুকিং দেয় না। তাহলে ফোন ঘোরাও ওখানকার পরিচিত বনবিভাগর লোকজনকে। জোগাড় কর বিশেষ অনুমতি চিঠিচাপাটি করে।

তখন মার্চের ভরা বসন্তের দিন। দিল্লি বিমানবন্দর থেকে প্রায় আটঘন্টার সড়ক পথে যাত্রা করে আমরা এসে পৌঁছলাম রামনগরের একটি রিসর্টে। সেখানে সন্ধ্যার অন্ধকারে তখন পালে পালে হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাঘ, লেপার্ডেরও আনাগোনা কোশি নদীর ধারে এই জায়গাটায়। আলো আঁধারে ঢাকা জঙ্গল রিসর্টের আশেপাশে শুধু নি:স্তব্ধতা আর রাতচরা পাখির ডাক।


করবেটের রিসর্টে সকালবেলা

ভোরে কিছুটা বৃষ্টি হয়েছিল। শুয়ে শুয়ে মন একটা আশংকা খেলা করছিল যে আবহাওয়া এমন থাকলে কেমন হবে এই সফর! কিন্তু সকাল হতেই রোদের আলো ছড়িয়ে পড়ল শালবনের পাতার ফাঁক দিয়ে। চা খেয়ে এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম এসে গেলেন পুরনজি তার জিপসি নিয়ে। আমার করবেট ভ্রমণের পুরানো সাথী। বাজারে যেতে হবে রেশন নিতে। বনবাংলোয় নিয়ে যাবার জন্য। আমি আর পুরনজি চলে গেলাম রামনগর বাজারে। ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা। তারপরে রিসর্টে ফিরে সবাই মিলে সীতাবনির পথে।

কোশি নদীর ব্যারেজ পার হয়ে এই পথ গেছে একদিকে বন আর একদিকে নদীকে পাশে রেখে। অনেকসময়েই বাঘের আনাগোনা থাকে এখানে। ছোট ছোট গ্রাম এক আধটা। দেখতে দেখতে এসে গেল বনে ঢোকার চেকপোস্ট। পারমিট দেখিয়ে ঢুকতে কিছুটা সময় লাগল। তারপরে শালবনের মধ্যে দিয়ে পথ । নদী, ঝরনা পার হয়ে।


চলেছি বনের মধ্যে দিয়ে

দেখতে দেখতে একটা জায়গায় এলাম যেখানে লোকজনের ভিড়। কিভাবে সম্ভব! সংরক্ষিত বনের মধ্যে? আসলে এখানে রয়েছে সীতামায়ের মন্দির। প্রাচীন কাল থেকে তার পুজো হয়ে আসছে এখানে। বিশ্বাস অযোধ্যা থেকে নির্বাসনর পর এখানেই বাল্মিকীর আশ্রমে তিনি দিন অতিবাহিত করেন তার দুই পুত্র লব ও কুশকে নিয়ে। স্থানীয় মানুষ যুগ যুগ ধরে এখানে আসে তীর্থ হিসাবে। তাদের জন্য তাই এই স্থানে ঢোকার অনুমতি রয়েছে।


ওই দেখা যায় বনবাংলো

সেখান থেকে মোড় ঘুরেই অল্প একটু চড়াই পথে এগালো আমাদের জিপসি। একটা টিলার উপরে চোখের সামনে এসে পড়ল সীতাবনির বনবাংলো। যার কথা অনেকদিন ধরে পড়েছি, ছবি দেখেছ। পাথরে বানানো পুরানো বাংলো। ১৯৪০ সালে নির্মিত। টানা বরান্দায় সাজানো পুরানো দিনের আসবাব। বড় একটি ড্রইং কাম ডাইনিং রুম পার হয়ে দুইদিকে দুটি বেডরুম আর একদিকে রান্নাঘর। আমাদের রেশন নিয়ে গেলেন কেয়ার টেকার গোপালজি। পুরানো বাংলো হলেও ছিমছাম। মূলত সরকারি অফিসার বা বনের কাজে আসা কর্মীরাই এখানে আসেন থাকতে। বারান্দার সামনে বেশি জায়গা নেই। নীচে খাদ। সেখানে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী। খাদের ধার রেলিং দিয়ে সুরক্ষিত। অল্প দূরেই বাংলো চত্ত্বরে একটা ওয়াচ টাওয়ার। লোহার সিঁড়ি উঠে গেছে অনেক উপরে। দূরের পাহাড়ে বসন্তের রং ধরেছে গাছ-গাছালিতে।


বাংলোর সামনে

জানা গেল রান্নাঘরের গ্যাস সিলিন্ডার ফুরিয়ে গেছে ক’দিন আগে। লোকজন তেমন আসে না বলে গোপালজির তত তাগাদা ছিল না নতুন আনার। তাই জমিয়ে রাখা কাঠেই ভরসা। বাংলোর পিছনে খোলা চত্ত্বর উনুন। সেখানেই রান্না বসিয়ে দিলেন। ভাত, ডাল, সবজি, ভাজা। বনের মধ্যে কোনরকম মাছ-মাংস আনা বারন যাতে বন্যপ্রাণীরা প্রলুব্ধ না হয়।

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর বাকিরা যখন বিশ্রামে তখন আমি একটা ঘুরে এলাম সীতা মায়ের মন্দির থেকে। সেখানে রয়েছে সন্ন্যাসীদের একটি প্রাচীন আশ্রম। পুরানো পাথরে নির্মিত সীতাদেবীর মন্দির। সেখানে সীতামায়ের সাথে লব-কুশের মূর্তি। আবার রাম-সীতার মূর্তিও রয়েছে। নীচে বয়ে চলেছে নদী। তার আগেই গাছ-পালা ঘেরা একটি স্থানে পাথরে বাঁধানো একটি জলাশয় রয়েছে পুণ্যার্থীদের জন্য। সমগ্র স্থানটি আর্কিওলজিকাল সার্ভের রক্ষণাবেক্ষণে।


প্রাচীন সেই মন্দিরে



পুত্রসহ সীতার মূর্তি

মন্দির থেকে ঘুরে এসে দেখি আমার মেয়ে বাংলো চত্ত্বরে দৌড়াদৌড়ি করছে। অনেকদিন পর প্রকৃতির মাঝে এসে সবাই উৎফুল্ল। পুরানজি জিপসি তৈরি করেছেন। আমরা বার হলাম সাফারিতে। যদিও একটু দেরি হয়ে গেল বার হতে। তখনই ছায়ার ঘন হয়ে এসেছে। আমরা বনপথ দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছলাম কোশী নদীর বুকে। বিশাল নদীখাতে এখানে ওখানে জল বয়ে গেছে। শীতের শেষ, বসন্তে বেশিটাই পাথরে ভর্তি। বাঘের দেখা পাবার আশা করিও না এত অপ্রস্তুত সাফারিতে। করবেটে যা দেখা যায় নানারকম হরিণ, কিছু পাখি দেখে ফিরে এলাম বনবাংলোয়।


Black necked stork

মায়ের সাথে হরিণ শাবক

যারা মনে করেন বনে যাওয়া শুধু ধুমধাড়াক্কা সাফারি করতে আর জন্তু দেখতে –তারা আমি মনে করি অনেক কিছু হারান। বনে এসে নিশ্চুপ হয়ে বসে শুনতে হয় কেমন করে সন্ধ্যা নেমে আসে তার বুকে। সীতাবনিতে আসা সেই কারণেই। পাখির কাকলিও আস্তে আস্তে থেমে এল অন্ধকার গাঢ় হতে। আমি আর পুরনজি রেলিং এর ধারে দাঁড়িয়ে গল্প করছি নানারকম । আর চোখ রাখছি নীচের নদীতে। সেখানে কখনও বাঘ বা লেপার্ড জল খেতে আসে। নীচে দূরে সীতার আশ্রমে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। লোকজনের যাতায়াত আর নেই। তাও কখনও ভেসে আসছে টুংটাং ঘন্টাধ্বণি।


বেলা পড়ে এল

অন্ধকার নেমে যেতেই ঠান্ডাও পড়ল বনের ভিতরে। বাংলোর পিছনে চত্ত্বরে চুল্লিতে রান্না বসিয়েছেন গোপালজি। সেখানেই আগুনের পাশে জড়ো হয়েছি আমরা। গোপালজির কাছে গল্প শুনছি বনের নানারকম। ছোট থেকেই তিনি এই বনের বাসিন্দা। জীবজন্তুদের নিয়ে কতরকম অভিজ্ঞতা তার! সঙ্গ দিচ্ছিলেন পুরনজিও। আর এইসব শুনতে শুনতে গরম গরম খাওয়া রাতের অন্ধকারে বসে- আহা সেই অভিজ্ঞতা!


উত্তাপ

পরদিন আলো ফোটার আগেই আমরা বার হলাম সাফারিতে। সীতাবনি অরণ্য তো বাঘ দেখার জন্য তেমন বিখ্যাত নয়। পর্যটকের পায়ের ধুলো তাই কম পড়ে। কিন্তু আধা আলো আঁধারিতে দূর দিয়ে কে যেন রাস্তা পার হয়ে গেল। বড় বাঘেরই অবয়ব। কিন্তু ছবি তোলার থেকে অনেক দূরে।

সাফারি থেকে ফিরে এসে দেখলাম আমার মেয়ে আর মা ঘুম থেকে উঠে বাংলো চত্ত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সকালের হালকা ঠান্ডা হাওয়া আর মিষ্টি রোদ চারপাশে। আমরা ওয়াচ টাওয়ারে উঠে দেখছি চারপাশ। রোদ্দুরে ঝলমল করছে বসন্তের করবেট অরণ্য। আজ একটু পরেই বিদায় নেব এই তপোবন থেকে।


বসন্তের রঙ

বিদায়ের আগে সবাই মিলে আবার চললাম সীতার মন্দির দর্শনে। আবার সেখানে আশেপাশের গ্রাম থোকে আসা তীর্থযাত্রীদের ভিড়। ঝরনার জলের নল বানানো রয়েছে এখানে। সেই জল পবিত্র স্থানীয়দের বিশ্বাস অনুযায়ী। গঙ্গাজলের মতই সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন তারা। স্নান করছেন।


মন্দির সংলগ্ন আশ্রম

জলধারা

তারপরে পুজো দিচ্ছেন। চারিদিকে বাঁদররা ঘুরে বেড়াচ্ছে তীর্থযাত্রীদের থেকে খাবার পাবার আশায়। ভারতের এই অরণ্যের অভ্যন্তরে এই স্থানে যেন ধরা রয়েছে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস। মানুষের বিশ্বাস। মহাকাব্যের গল্প। প্রকৃতির সাথে মিশে তা ধরা দিচ্ছে আমাদের কাছে সেই সকালে।




ছবি: লেখক।


লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় চিকিৎসক। প্রকৃতি ও অরণ্যপ্রেমী। 'বনেপাহাড়ে' ওয়েবজিনের সম্পাদনার দায়িত্বে।





Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page