একসময়ে ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে গণ্ডারের উপস্হিতি থাকলেও তা কমতে কমতে শুধু উত্তর-পূর্ব ভারতেই এসে ঠেকে। ৪০ বছর আগে দুধোয়া টাইগার রিজার্ভে গণ্ডারের পুনর্বাসন দিয়ে যে প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল তা আজ সেখানে গণ্ডারের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। কিভাবে এল এই পরিবর্তন? কোন কোন বিষয়ের উপর তা নির্ভর করে? আলোচনায় আজিম মির্জা।
চারদশক আগে উত্তর প্রদেশ রাজ্যে ভারতীয় গণ্ডার বা greater single-horned rhinoceros (Rhinoceros unicornis) এর কোন খোঁজ ছিল না। এদের মূলত: দেখা মিলত উত্তরপূর্ব ভারতের অসম রাজ্যের কাজিরাঙ্গা ন্যাশনাল পার্কেই।কিন্তু সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের দুধোয়া ন্যাশনাল পার্কে এদের সংখ্যাবৃদ্ধি চোখে পড়ার মত।চার দশক আগে গ্রহণ করা গণ্ডার পুনর্বাসনের আন্ত:রাজ্য প্রকল্পের গতিপ্রকৃতি সঠিক দিকেই এগিয়েছে বোঝা যাচ্ছে।
International Union for Conservation of Nature (IUCN) এর সংকটাপন্ন প্রাণীর তালিকার যে 'রেড লিস্ট' রয়েছে তার মধ্যে ‘vulnerable’ বা অসুরক্ষিত বলে চিহ্নিত ভারতীয় গণ্ডার।দুধোয়া টাইগার রিজার্ভের তরাইয়ের তৃণভূমিতে এমন ৪০টি গণ্ডারকে এখন খুঁজে পাওয়া যায়। ৩৮ বছর আগে অসম থেকে যে ৫টি গণ্ডারকে ছাড়া হয়েছিল তাদের সংখ্যা বেড়ে এখন ৪০টি'তে দাঁড়িয়েছে এবং ভবিষ্যতে তা বাড়বে বলেই স্হানীয় বনবিভাগের আশা।
যদিও দুধোয়া টাইগার রিজার্ভ ১২৮৪ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত, কিন্তু গণ্ডারদের ২৭ ও ১৪ বর্গ কিলোমিটারের দুটি আলাদা বনবিভাগে পাওয়া যায়। এই দুই বন বিভাগেই ২০২২ সালে এদের জনগণনা করা হল। এর জন্য অসম থেকে এসেছিলেন World Wildlife Fund for Nature (WWF), India এর Rhino Conservation Project এর প্রধান ও বিশিষ্ট গণ্ডার বিশেষজ্ঞ অমিত শর্মা। গোটা কাজের জন্য দুধোয়ায় ৭ টি দল তৈরি করা হয়েছিল WWF এর অধীনে। এই সুমারির জন্য ড্রোন, সেন্সর ও হাতিদের ব্যবহার করা হয়েছিল।
পাঁচটি দল সমীক্ষা চালায় দক্ষিণ সোনারিপুর ফরেস্ট রেঞ্জে আর দুটি দল বেলরায়ান রেঞ্জে। প্রথম এলাকার কিছু অংশ সমীক্ষা থেকে বাদ গেছে, কারণ এতে বেশ কিছুটা অগম্য লম্বা ঘাসের বাদাবন ছিল।সর্বমোট ৪১ বর্গ কিলোমিটারের ৭৫% এলাকায় সমীক্ষা হয়।
গোটা সমীক্ষায় দুধোয়ায় ৪০টি গণ্ডার পাওয়া যায়। এর মধ্যে ২৮টি পূর্ণবয়স্ক, যার মধ্যে ৭টি পুরুষ আর ১৬টি স্ত্রী। পাঁচটি গণ্ডারের লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায়নি। আটটি শিশু গণ্ডারের বয়স ১ থেকে ৩ এর মধ্যে আর ৪টির বয়স ৪ থেকে ১২ বছরের মধ্যে।
দুধোয়া টাইগার রিজার্ভের ডেপুটি ডিরেক্টার কৈলাস প্রকাশ একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান যে, যেহেতু গোটা এলাকার ৭৫% অঞ্চলে সমীক্ষাটি করা হয়েছিল তাই এমন সম্ভাবনা আছেই যে গণ্ডারের প্রকৃত সংখ্যা হয়ত আরো বেশি।২০১৭ সালে এই সংখ্যা টাইগার রিজার্ভে চিল ৩৪।
দুধোয়া টাইগার রিজার্ভের ফিল্ড ডিরেক্টার সঞ্জয় পাঠক যদিও আনন্দিত এই প্রকল্পের সাফল্যে, তবু তিনি কিছু বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের পক্ষপাতী, বিশেষত শিশু গণ্ডারদের সুরক্ষার বিষয়ে। প্রথম তিন বছর এরা বেশ অসুরক্ষিত থাকে বাঘেদের আক্রমণের কারণে। মায়ের কাছাকাছি থাকে তখন ওরা যতদিন না শিং গজাচ্ছে। একটি গণ্ডার গর্ভবতী থাকে ১৬ থেকে ১৮ মাস সময়ের জন্য। কটি বাচ্চা দেবার তিন বছর পরে তারা পুনরায় বাচ্চা দিতে পারে। এই সময়টা তারা শিশুদের স্তন্যপান করায় ও বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচায়।যদিও একটি মেয়ে গণ্ডার ৬ বছর বয়সে যৌনতার দিক থেকে পূর্ণ হয়ে ওঠে, তবে তারা ১২ বছর বয়সের পরেই বাচ্চার জন্ম দিতে পারে।
চার দশকের গণ্ডার সংরক্ষণ
১৯৭৯ সালের অগস্টে IUCN Species Survival Commission এর Asian Rhino Specialist Group ভারতীয় গণ্ডার সংরক্ষণের উপর বিশেষ জোর দিতে বলে। গণ্ডারের পুরানো বাসস্হানগুলোয় তাদের আবার পুনর্বাসনের উপরে জোর দেওয়া হয়, যেমন দুধোয়ায়।ভারতের National Board for Wildlife এই পরামর্শগুলি মেনে একটি সাব-কমিটি তৈরি করে যাতে উত্তরপ্রদেশে আবার গণ্ডারের বাসস্থান তৈরি করা যায়। তারা দুধোয়াকে এর জন্য আদর্শ স্হান বলে চিহ্নিত করেন।
দুধোয়ায় গণ্ডার ফিরিয়ে আনতে তৈরি কমিটির সদস্য ছিলেন এস.পি.সিনহা। তিনি বলেন," কোন প্রাণীকুলকে কোন স্হানে নতুন করে নিয়ে যেতে হলে এমন কোন স্হান বাছতে হয় যেখানে তাদের অতীতে বিচরণের ইতিহাস আছে।কত বছর আগে তারা বাস করত এখানে তাও দেখতে হয়। এটা দেখা যায় রেকর্ড থেকে যে ইউ পি রাজ্যের পিলভিটে শেষ গণ্ডারটি শিকার করার ঘটনাটি ঘটে ১৮৭৮ সালে।" সিনহা জানান, গণ্ডারের বিচরণের জন্য বাদাবন, ঘাসবন আর অরণ্যের প্রয়োজন। এরা কাদায় থাকতে পছন্দ করে। তারা বনে লুকিয়ে থাকে আর ঘাসজমিতে খাবার খোঁজে। দুধোয়ায় এই সবই আছে। এখানকার পরিবেশ পরিস্হিতি কাজিরাঙ্গার মতই।
ফিল্ড ডিরেক্টার সঞ্জয় পাঠক জানালেন যে, গণ্ডার বিচরণের ক্ষেত্র বাড়াতে তারা নতুন কার্যক্রম নিচ্ছেন। এই অরণ্যে এখন অসম ও নেপাল থেকে আনা গণ্ডার রয়েছে।কথা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ থেকেও আনার। একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছে যারা এই বিষয়ে বিশদ পরিকল্পনা জমা দিতে পারে রাজ্য সরকারকে, যারা এই খাতে ১.৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।
দুধোয়া টাইগার রিজার্ভের ওয়েবসাইটে পাওয়া নথি থেকে দেখা যাচ্ছে, একসময়ে একশৃঙ্গ গণ্ডার ভারতের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে পাওয়া যেত তার মধ্যে গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা অঞ্চল রয়েছে। 'বাবরনামা'র মত পুস্তকে বলা হয়েছে ভারত-মায়ানমার সীমান্ত অঞ্চল যেখানে সেইখান অবধি এদের বিস্তার ছিল।
পৃথিবীতে পাঁচরকমের গণ্ডার পাওয়া যায়। একশৃঙ্গদের দেখা যায় ভারত, নেপাল, ভুটানেই। ওদের এই শৃঙ্গের জন্যই এদের বেআইনিভাবে শিকার করা হয়ে এসেছে, ফলে এদের সংখ্যা তলানিতে ঠেকেছে।WWF এর তথ্য অনুযায়ী তাদের সংখ্যা বিশ্বজুড়ে ২০০য় নেমে এসেছিল একসময়ে, যা তাদের বিলুপ্তির মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। কিন্তু ভারত ও নেপালের আন্ত:সীমান্ত যৌথ প্রচেষ্টায় অবস্থা আজ অনেকটাই আশাপ্রদ।
International Rhino Foundation এর ২০২২ সালের গ্লোবাল রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত ও নেপালে গণ্ডারের মোট সংখ্যা ৪,০১৪ এ এসে দাঁড়িয়েছে। ২০১৮ এর রিপোর্ট থেকে ৪২৬টি বেশি।
পাঠক জানালেন, ভারতে ৭টি জায়গা আছে গণ্ডারের জন্য উপযোগী। যার মধ্য ৪টি অসমে, দুটি পশ্চিমবঙ্গে আর একটি উত্তরপ্রদেশে।ভারতের এতগুলি টাইগার রিজার্ভের মধ্যে মাত্র ৪টিতে বাঘ ও গণ্ডার রয়েছে। তারা হয় কাজিরাঙ্গা, মানস, ওরাং ও দুধোয়া।
দুধোয়ার সব ছবি: উপমন্যু রায়।
মূল প্রবন্ধটি Mongabayপত্রিকায় প্রকাশিত। ইংলিশ প্রবন্ধটির অনুমতিক্রমে অনুবাদ করা হল বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য। মূল প্রবন্ধটির লিঙ্ক: https://india.mongabay.com/2022/12/uttar-pradesh-reports-an-increase-in-rhino-population-since-the-reintroduction/
תגובות