top of page

বারাশিঙ্গা-একটি ফিরে আসার কাহিনী

  • ..
  • Jan 3
  • 9 min read

Updated: Jan 4

মধ্য প্রদেশের কানহা টাইগার রিজার্ভ। বাঘ দেখার জন্য যেখানে আমরা বারবার ছুটে যাই। কিন্তু কানহা বাঘের পাশাপাশি বিখ্যাত আরো একটি প্রাণীর জন্য যার শেষ বাসস্থান এই অরণ্য। সেই প্রানী হল বারাশিঙ্গা (hard ground barasingha/ Cervus duvauceli branderi)। সেই প্রাণীর সংখ্যাও এখানে একসময়ে এসে দাঁড়িয়েছিল বিলুপ্তির মুখে। কিন্তু কিছু স্বপ্ন দেখা মানুষের অদম্য জেদ আর উৎসাহ তাদের আবার ফিরিয়ে আনে হারিয়ে যাবার হাত থেকে। সেই আখ্যান উঠে এল অভিষেক চক্রবর্তীর এই বিস্তৃত রচনায়।




"রুক্ যাও ...'! গাইড যাদব ভাইয়ের নির্দেশ পেতেই ব্রেক কষে তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল জিপসি। স্থান কানহা জাতীয় উদ্যানের কানহা জোন।জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ, ধীরে ধীরে রাতের আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে জঙ্গল। তার আগে প্রায় আধ ঘন্টা চিতল হরিণের অ্যালার্ম কল শুনে অপেক্ষার পর দেখা মেলেনি ডোরাকাটার। কিঞ্চিৎ নিরাশ হয়েই বসেছিলাম, হালকা তন্দ্রাও এসে গিয়েছিল। ঠিক তখনই গাইড সাহেবের ঐ নির্দেশ। তন্দ্রা ভেঙে লাফিয়ে উঠে প্রশ্ন করলাম, "টাইগার কিধার হ্যায়?" মৃদু হেসে গাইড ভাই বললেন -"টাইগার তো দুসরে জঙ্গল মে ভি মিলেগা সাব, উও দেখিয়ে.... কানহা কি শান্- বারাশিঙ্গা। " আঙুলের নির্দেশ অনুসরণ করে দেখলাম, সদ্য জেগে ওঠা সূর্যের সোনালী আলোয় ভেসে যাওয়াএক বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, আর তার মধ্যে নিশ্চিন্তে চরে বেড়াচ্ছে একঝাঁক বারাশিঙ্গা, মধ্যপ্রদেশের রাজ্যপশু।যাদব ভাইয়ের ভাষায় -"কানহা কি শান্"- Pride of Kanha ।


কানহা জাতীয় উদ্যান ভ্রমণকালে বারাশিঙ্গার দর্শন পান নি এমন পর্যটক বিরল। কানহা অরণ্যের সকল জোনেই সাফারি করা কালীন কমবেশি এই প্রজাতির হরিণের দেখা পাওয়া যায়। গাইড ড্রাইভার দের কাছে শুনবেন পৃথিবীতে এই হার্ড গ্রাউন্ড বারাশিঙ্গার একমাত্র বসতি মধ্য প্রদেশের কানহার জঙ্গল। এদের সংখ্যা বর্তমানে হাজারেরও বেশি,এটি মধ্য প্রদেশের রাজ্য পশুর মর্যাদা পেয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু পাঠকদের মধ্যে অনেকেই জেনে অবাক হবেন, এক সময় এই প্রজাতির হরিণের সংখ্যা কমতে কমতে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৬৬ তে। কিভাবে বিলুপ্তির দোরগোড়া থেকে ফিরে এসেছিল বারাশিঙ্গা, কি ভাবে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিল কানহা তথা মধ্য প্রদেশের গর্ব সেই নিয়েই আজকের গল্প।


অপরূপ কানহা ন্যাশানাল পার্ক
অপরূপ কানহা ন্যাশানাল পার্ক

এই গল্পের শুরু আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে, ১৯৬৩/৬৪ সাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ভারতে আসেন,নাম জর্জ শেলার। তাঁর গবেষণার মূল বিষয়বস্তু ছিল ভারতের বাঘের খাদ্যাভ্যাস। গবেষণার ফিল্ড ওয়ার্কের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন কানহা জাতীয় উদ্যানকে। বন দপ্তরের অনুমতিক্রমে গহন অরণ্যের ভিতরেই তিনি একটি কাঠের স্টাডি হাউজ নির্মাণ করে বসবাস করতে থাকেন। তাঁর স্টাডি হাউজটি থেকে কানহার বিস্তীর্ণ তৃণভূমি দেখা যেত। প্রায় ১৪ মাস শেলার সাহেব কানহাতে ছিলেন এবং দেশে ফিরে তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্যাবলী নিয়ে ১৯৬৭ সালে " The Deer and the Tiger" নামক একটি বই প্রকাশিত হয় যা আজও বণ্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞদের কাছে একটি অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়।এই বইটিতে শেলার সাহেব উল্লেখ করেন যে বারাশিঙ্গার এই প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে দাঁড়িয়ে । তার পিছনে কতগুলি কারণ তিনি চিহ্নিত করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, অস্বাভাবিক কম জন্মহার এবং অতিমাত্রায় বাঘের দ্বারা শিকার। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন যে বারাশিঙ্গার মোট জনসংখ্যার মধ্যে শিশু হরিণের উপস্থিতি মাত্র সাত শতাংশ। তিনি আরও লক্ষ্য করেন যে কানহা তৃণভূমিতে বিচরণকারী বারাশিঙ্গার দলে মোট ২৮ টি আসন্নপ্রসবা হরিণী ছিল কিন্তু প্রসবকালের পর তার মধ্যে মাত্র চারটি হরিণীকে শিশু সমেত বিচরণ করতে দেখা যায়, যা থেকে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে বারাশিঙ্গার মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার অস্বাভাবিক মাত্রায় বেশি।তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন যে হয়ত এই প্রজাতির মধ্যে ব্রুসেলোসিস নামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি যে কারণে হরিণীদের মধ্যে মৃত সন্তান প্রসবের হার বেশি।এ ছাড়াও তাঁর কানহা প্রবাসের সময়কালে শেলার সাহেব প্রায় ৩৯ টি বারাশিঙ্গার বাঘ দ্বারা শিকারের কথা উল্লেখ করেছেন। এই সকল পরিসংখ্যান দ্বারা জর্জ শেলার আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে অদূর ভবিষ্যতেই হরিণের এই প্রজাতিটি পৃথিবীর বুক থেকে অবলুপ্ত হয়ে যাবে এবং কানহা তথা সারা পৃথিবীতে এদের সর্বমোট সংখ্যা ৮০/৮৫ এর বেশি নয়।


আরও একটি বিচিত্র বিষয় শেলার তাঁর বইতে উল্লেখ করেন যে বছরের আট নয় মাস সকল বারাশিঙ্গা কানহা তৃণভূমিতেই থাকলেও বর্ষার শেষে হরিণীদের প্রসবকালীন কয়েকটি মাস তারা কানহা তৃণভূমিতে ছেড়ে সদলবলে কোথাও উধাও হয়ে যায়, আবার কানহা তৃণভূমিতে তাদের শিশু সমেত ফিরে আসতে দেখা যায় জানুয়ারি মাস নাগাদ। যদিও এ রহস্যের সমাধান শেলার সাহেব করে যেতে পারেন নি, তার আগেই তাঁর ভারতবাসের মেয়াদ শেষ হয়।


মা, সন্তান ও পিতা।  একটি বারাশিঙ্গা পরিবার।
মা, সন্তান ও পিতা। একটা বারাশিঙ্গা পরিবার।

ঘটনাচক্রে যে বছর শেলার সাহেবের এই সাড়া জাগানো বইটি প্রকাশিত হয় সেই সময়েই মান্দলা জেলার জেলাশাসক হয়ে আসেন ডঃ রঞ্জিত সিংহ। সৌরাষ্ট্রের এক রাজপরিবারের সন্তান রঞ্জিত সিংহ মধ্যপ্রদেশ ক্যাডারের আই এ এস অফিসার হলেও মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন একজন প্রকৃতিপ্রেমী এবং বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ। ছোটবেলায় একবার কানহার অরণ্য ভ্রমণকালে এই অরণ্যের সৌন্দর্যে তিনি মোহিত হয়েছিলেন তাই মান্দলার জেলাশাসকের পোস্টিং তাঁর কাছে ছিল স্বপ্নের মত। এসময়েই কানহা জাতীয় উদ্যানের ফিল্ড ডিরেক্টর হয়ে আসেন ডঃ হিম্মত সিংহ পানোয়ার। পদার্থবিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র হলেও বন্যপ্রাণ ও অরণ্য সংরক্ষনে তাঁর দূরদর্শীতা ছিল প্রবাদপ্রতিম। শেলার সাহেবের বই নজর এড়ায়নি দু'জনেরই। সে বছরই নিজেদের উদ্যোগে কানহা জাতীয় উদ্যানে বারাশিঙ্গার গণনা করা হয়, দেখা যায় আর মাত্র ৬৬টি বারাশিঙ্গা হরিণ জীবিত আছে কানহা তথা পৃথিবীর বুকে। জর্জ শেলারের আশঙ্কাকে সত্যি করে নিঃশব্দে অবলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে একটি প্রজাতি।


জরুরি বৈঠকে বসলেন জেলাশাসক এবং ডিরেক্টর। অনেক আলোচনা পরিকল্পনার পর ঠিক হল, আফ্রিকার বোমার অনুকরণে কানহা তৃণভূমির একাংশে গড়ে তোলা হবে একটি বিশাল এনক্লোজার।যার মধ্যে রাখা হবে প্রজননক্ষম কয়েকটি বারাশিঙ্গা হরিণকে। চারপাশে ইস্পাতের কাঠামো এবং উঁচু কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা থাকবে যাতে বাঘ, লেপার্ড এবং অন্যান্য মাংশাসী প্রাণী এর ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে। ভিতরে নিশ্চিন্তে প্রজনন সম্পন্ন হবে এবং শিশু হরিণরা বেড়ে উঠবে বনদপ্তরের নজরদারিতে। এনক্লোজারের মধ্যে হরিণের সংখ্যা খুব বেশি বৃদ্ধি পেলে প্রয়োজন মত তাদের বাইরে স্থানান্তরিত করা হবে। এই মাফিক একটি পরিকল্পনার খসড়া তৈরি করা হল। কিন্তু টাকা? এত টাকা আসবে কোথা থেকে? খসড়া অনুমোদন এবং অর্থ মঞ্জুরের জন্য রাজ্যস্তরে আবেদন করলে জবাব এল, নীতি গত ভাবে দপ্তরের কোন আপত্তি নেই কিন্তু এর জন্য কোনরকম বাড়তি অর্থ মঞ্জুর করতে তারা অপারগ। অথৈ জলে পড়লেন জেলাশাসক এবং ফিল্ড ডিরেক্টর। এখন কানহা সহ বিভিন্ন ন্যাশনাল পার্কে আমরা যারা সাফারি ট্যুরে যাই, বিলাসবহুল হোটেল রিসোর্টের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে সুখ নিদ্রা দিয়ে, হোটেলের সুইমিং পুলে জলকেলি করে সাফারির ক্লান্তি ধুয়ে ফেলি, আমরা হয়ত কল্পনাও করতে পারব না সেদিনের জাতীয় উদ্যান গুলির পর্যটন পরিবেশ। ইকোট্যুরিজম শব্দটিই তখন অজানা ছিল। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিকাঠামোর অভাব,শ্বাপদ সংকুল অরণ্য ইত্যাদি কারণে সাধারণ পর্যটকের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল জাতীয় উদ্যানগুলি। তার মধ্যেই কিছু প্রকৃত অরণ্যপ্রেমী পর্যটক আসতেন প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ উপভোগ করতে। এরকমই একজন ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের বাসিন্দা ফ্রেডরিক স্টোভার।কানহার জঙ্গল বা বলা ভাল জঙ্গলের রাজা বাঘের প্রেমে পড়েছিলেন ফ্রেডরিক। প্রায় প্রতি বছরই স্ত্রী রেনাটাকে সঙ্গে নিয়ে কানহার জঙ্গলে আসতেন তিনি। সে বছরেও এসেছিলেন। ঘটনাচক্রে জেলাশাসক রঞ্জিত সিংহর সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। ফ্রেডরিক জানান, কানহায় বাঘ সংরক্ষণের জন্য কিছু অবদান রাখতে চান তিনি। রঞ্জিতের মাথায় খেলে যায় বিদ্যুতের ঝিলিক। কানহায় বাঘের প্রধান খাদ্য বারাশিঙ্গা হরিণ আজ বিলুপ্তির পথে। কানহার বাঘকে বাঁচাতে গেলে বাঁচাতে হবে বারাশিঙ্গাকে, আর তার জন্য প্রয়োজনীয় এনক্লোজার তৈরী করার মত অর্থের সংকুলান নেই। শুনে ফ্রেডরিক জানান দেশে ফিরেই সত্তর হাজার টাকা এই বাবদ পাঠাবেন তিনি। কথা রেখেছিলেন ফ্রেডরিক সাহেব, দেশে ফিরেই এই পরিমাণ টাকা তিনি পাঠিয়ে দেন জেলাশাসককে।কিন্তু এত বিস্তৃত তৃণভূমি ঘেরার জন্য প্রয়োজন

অনেক পরিমাণ ইস্পাতের ও লোহার। কোথায় পাওয়া যাবে এত কাঁচামাল?ভাবতে থাকেন জেলাশাসক। হঠাৎই মনে পড়ে আই এ এস এর ব্যাচমেট এস জগৎপতির কথা। বন্যপ্রাণের প্রতি অগাধ ভালবাসা এবং আগ্ৰহ তারও, কানহা অরণ্যের একনিষ্ঠ অনুরাগী এই আই এ এস আধিকারিক তখন ছিলেন ভিলাই ইস্পাত কারখানার দায়িত্ব প্রাপ্ত। জেলাশাসক বন্ধুর আহ্বানে প্রিয় কানহার জঙ্গলে আবার উপস্থিত হলেন তিনি। জেলাশাসক, ফিল্ড ডিরেক্টরের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে সকল সমস্যার কথা শুনে তিনি জানালেন প্রয়োজনীয় ইস্পাত এবং লোহার ব্যবস্থা তিনি করে দিতে পারবেন। প্রতি বছর ভিলাই ইস্পাত কারখানায় প্রচুর পরিমাণে ইস্পাতের ছাঁটাই বা স্ক্র্যাপ তৈরি হয় যা নিলামের মাধ্যমে অতি স্বল্প মূল্যে বিক্রি হয়ে যায়। ঐ স্ক্র্যাপ ইস্পাত থেকে প্রয়োজনীয় অ্যাঙ্গেল এবং কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করিয়ে দেবেন তিনি অত্যন্ত কম খরচে। মাথার ওপর থেকে একটা বড় বোঝা নেমে গেল দুই কর্তার।

টাকা আর কাঁচামালের জোগাড় তো হল কিন্তু ঐ বাঘ অধ্যুষিত কানহা ঘাসভূমিতে মাঠে দাঁড়িয়ে কাজ করানোর দায়িত্ব কে নেবে? এগিয়ে এলেন প্রায় বৃদ্ধ এক বনকর্মী, জুম্মান খান।

কানহা বনবিভাগের সকলের প্রিয় "চাচা"; যিনি প্রায় হাতের তালুর মতই চিনতেন এই বনভূমিকে। স্থানীয় বৈগা জনজাতির পরিশ্রমী যুবকদের নিয়ে তৈরী করলেন বাহিনী। মহা উৎসাহে শুরু হল, এনক্লোজার তৈরীর কাজ।চাচার তত্ত্বাবধান, জেলাশাসক এবং ডিরেক্টর সাহেবের কড়া নজরদারিতে খুব দ্রুতই শেষ হয়ে গেল কাজ। উন্মুক্ত তৃণভূমি থেকে বোমার মধ্যে প্রবেশের জন্য তৈরী করা হল ফানেলাকৃতির সুড়ঙ্গের।

এবার পরের ধাপ, বারাশিঙ্গাদের এনক্লোজারের ভিতরে প্রবেশ করানো। পরিকল্পনা মাফিক নির্দিষ্ট দিনে সমস্ত বনকর্মী এবং স্থানীয় কিছু যুবকদের দিয়ে অর্ধবৃত্তাকারে মুক্ত তৃণভূমিকে ঘিরে ফেলা হল যার মধ্যে নিশ্চিন্তে বিচরণ করছিল বারাশিঙ্গার দলটি। নির্দেশ পেতেই বিভিন্ন রকম শব্দ সহকারে পুরো বনকর্মীদের দলটি এগিয়ে গিয়ে বৃত্তটিকে ক্রমশই ছোট করতে থাকে। ভয়ে দিশেহারা বারাশিঙ্গা এবং অন্যান্য হরিণের দল দৌড় শুরু করলে বেশ কিছু প্রাণী ফানেলাকৃতির সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে বোমার ভিতরে প্রবেশ করে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হলে দেখা যায়, দুটি পুরুষ এবং তিনটি স্ত্রী বারাশিঙ্গা এনক্লোজারের মধ্যে প্রবেশ করেছে। এছাড়াও কিছু চিতল হরিণ এবং কৃষ্ণসার হরিণ ও একই সাথে প্রবেশ করেছে।সব মিলিয়ে অপারেশন সাকসেসফুল বলাই যায়।


দলের রাজা পুরুষ বারাশিঙ্গা
দলের রাজা পুরুষ বারাশিঙ্গা

তবে দুটি প্রশ্নের উত্তর তখনও খুঁজে চলেছিলেন ডঃ পানোয়ার।জর্জ শেলার সাহেবের বইতে উল্লেখিত সেই দুটি প্রশ্ন। সন্তান প্রসবকালে বারাশিঙ্গা বাহিনীর কানহা তৃণভূমি থেকে উধাও হয়ে যাওয়া এবং অত্যধিক শিশু মৃত্যুর হার। তবে কি ব্রুসোলোসিস? রহস্য সমাধানের জন্য তাঁর নির্দেশে বাঘ বা লেপার্ডের অর্ধভুক্ত বারাশিঙ্গার দেহাবশেষ থেকে কলা কোষ এবং রক্তের নমুনা সংগ্ৰহ করা শুরু হল। নমুনা সংগ্রহ করা হল এনক্লোজারের মধ্যে বসবাসরত বারাশিঙ্গার দেহ থেকেও। সেই সকল নমুনা পাঠিয়ে দেওয়া হল জব্বলপুরের পশু হাসপাতালে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষার পর রিপোর্ট এলে জানা গেল, কোন বারাশিঙ্গার দেহ নমুনা থেকেই ব্রুসোলোসিস এর ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায় নি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন পানোয়ার সাহেব। তবে কি কারণে শিশু মৃত্যুর হার এত বেশি আর বছরের ঐ কয়েকটি মাস কেন কানহা তৃণভূমি ছেড়ে চলে যায় বারাশিঙ্গার দল, আর কোথায়ই বা যায়। তীক্ষ্ণবুদ্ধির পানোয়ার সাহেব বুঝেছিলেন এই কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বারাশিঙ্গা সংরক্ষণের চাবিকাঠি।

কানহা তৃণভূমিতে চরে বেড়ানো বারাশিঙ্গার দলের ওপর দিবারাত্র নজরদারির ব্যবস্থা করলেন তিনি। দেখা গেল, ঠিক শীতের আগেই যথারীতি বারাশিঙ্গার দল কানহার তৃণভূমি ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে। গন্তব্য সুলখুম নদীর তীরবর্তী সৌফ গ্রাম সংলগ্ন একটি তৃণভূমি যেখানে একটি বিশেষ প্রজাতির লম্বা ঘাসের আধিক্য। সার্ভে করে দেখা গেল প্রতি বছর মাদী বারাশিঙ্গাদের প্রসবকালীন সময়ে বছরের এই কয়েকটি মাস বারাশিঙ্গার দল কানহা তৃণভূমি ছেড়ে এই লম্বা ঘাসের বনে এসে আশ্রয় নেয়। এর কারণ সমীক্ষা করে ডঃ পানোয়ার এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে কানহা তৃণভূমিতে অত্যধিক বাঘের

ঘনত্ব এর অন্যতম কারণ যার ফলে বারাশিঙ্গার দল প্রসবকালে কানহা তৃণভূমিতে নিরাপদবোধ করে না। তবে মূল কারণ হল, ওই বিশেষ প্রজাতির লম্বা ঘাসের জঙ্গল। যার মধ্যে একটি ঘাসের বিছানা করে মাদী বারাশিঙ্গা সন্তান প্রসব করে এবং চোখ ফোটা পর্যন্ত ঐ ঘাসের বিছানাই শিশু হরিণের আশ্রয়স্থল। মা বারাশিঙ্গা এই লম্বা ঘাসের জঙ্গলে তার বাচ্চাকে লুকিয়ে রাখে যাতে বাঘ, লেপার্ড, বন্য কুকুর বা শেয়াল তার সন্ধান না পায়। কানহা তৃণভূমিতে এই প্রজাতির ঘাস খুবই কম। আর বর্তমানে সংলগ্ন সৌফ গ্রামের বাসিন্দাদের কৃষিকাজ,পশুচারণ ঘাসের জঙ্গল সাফ করে জ্বালানি সংগ্ৰহ ইত্যাদি কারণে দ্রুত হারে হ্রাস পাচ্ছে এই তৃণভূমির আয়তন। কমছে বারাশিঙ্গা শিশুদের লুকিয়ে রাখার জায়গা, একেই বারাশিঙ্গা মনোইস্ট্রাস (যাদের স্ত্রী প্রাণী বছরে একবার মাত্র ঋতুমতী হয়) এবং মনোটোকাস (যাদের স্ত্রী প্রাণী একবারে মাত্র একটি সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম) প্রজাতির প্রাণী। তার ওপর জন্মের পরপরই তারা হিংস্র মাংসাশী প্রাণীর সহজ লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছে। চিন্তার ভাঁজ পড়ল ডঃ পানোয়ার এর মাথায়। কিন্তু হাল ছাড়ার মানুষ তো তাঁরা ছিলেন না। জেলাশাসকের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। অনেক চিন্তা ভাবনার পর দুজনেই একমত হলেন, বারাশিঙ্গার ভবিষ্যত সুরক্ষিত করতে হলে এই লম্বা ঘাসের তৃণভূমির আয়তন বৃদ্ধি করতে হবে, একে সুরক্ষিত রাখতে হবে। আর তার জন্য সৌফ গ্রামের স্থানান্তর করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তবে এর জন্য বলপ্রয়োগে দুজনেই রাজি ছিলেন না, তাঁদের পরিকল্পনা ছিল অরণ্যের সন্তান মূলবাসী এই বৈগা জনজাতির মানুষদের বারাশিঙ্গা তথা অরণ্য সংরক্ষণের এই উদ্যোগে শামিল করে, তাদের বিশ্বাস, আস্থা অর্জন করে ৮৪ টি

পরিবারের এই গ্রামের স্থানান্তর করা।


মেয়ে বারাশিঙ্গার দল।
মেয়ে বারাশিঙ্গার দল।

শুরু হল আলোচনা, তৎকালীন সময়ে এ বিষয়ে বনদপ্তরের কোন গাইডলাইন ছিল না কারণ ইতিপূর্বে কখনো কোন জনবসতি কে এভাবে সংরক্ষণের প্রয়োজনে উচ্ছেদ এবং পুনর্বাসন দেওয়া হয় নি। জেলাশাসক এবং ফিল্ড ডিরেক্টরের অনুরোধে কানহায় উপস্থিত হলেন মধ্য প্রদেশের তৎকালীন বনমন্ত্রী শশীভূষণ সিংহ। একসময়ের নামজাদা শিকারী হলেও মন্ত্রীমশাই ছিলেন বন্যপ্রাণের অনুরাগী। সৌফ গ্রামে উপস্থিত হয়ে তিনি গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিজে কথা বলেন এবং গ্রাম স্থানান্তরিত করার প্রয়োজনীয়তা বোঝান। জেলাশাসকের উদ্যোগে কানহা অরণ্যের বাইরে ভিলওয়ানি নামক

গ্রামের কাছে ভানপুর নামক মৌজায় বিকল্প জমি চিহ্নিত করা হয়। শুরু হয় পাট্টা বিতরণ, প্রথমে স্বাভাবিক জড়তা থাকলেও ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকেন সৌফ গ্রামের অধিবাসীরা। প্রাথমিকভাবে বাইশটি পরিবারের স্থানান্তর করা হয়। জেলাশাসকের উদ্যোগে তাদের দেওয়া হয় চাষের জমি, বীজ, হাল বলদ। পানীয় জলের জন্য একাধিক কুয়ো খননের ব্যবস্থাও করেন জেলাশাসক। প্রতিটি পরিবারকে তাদের সৌফ গ্রামে থাকা জমির তুলনায় দেড় গুণ জমি প্রদান করা হয়। প্রতিবেশীদের থেকে নতুন গ্রামের সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে জেনে এক সময় এগিয়ে আসেন সকলেই। অবশেষে ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে সৌফ গ্রামের শেষ পরিবারটিও স্থানান্তরিত হয় ভানপুরের নতুন ঠিকানায়। সফল হয় ডঃ রঞ্জিত সিংহ এবং ডঃ পানোয়ারের মাস্টার প্ল্যান। এর পর দ্রুততার সাথে সৌফ গ্রামকে পরিণত করা হয় লম্বা ঘাসের বিস্তৃত তৃণভূমিতে।

এত উদ্যোগ, পরিশ্রম বিফলে যায় নি। সুফল মিলতে শুরু করে দ্রুতই। শিশু মৃত্যুর হার কমে, বাড়তে থাকে বারাশিঙ্গার সংখ্যা।১৯৭২ সালের গণনায় দেখা যায় বারাশিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ২০০ র কাছাকাছি।ইতিমধ্যে সরকারি নিয়মানুযায়ী বদলি হয়ে গিয়েছিলেন মান্দলার জেলাশাসক ডঃ রঞ্জিত সিংহ, কানহার এই লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান নায়ক। পরবর্তীতে তিনি ভারতের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন ১৯৭২ এর অন্যতম খসড়া লেখক ছিলেন। বদলি হয়ে যান অপারেশন বারাশিঙ্গার অপর নায়ক ডঃ পানোয়ার ও। কিন্তু টিম কানহার যুদ্ধ থামে নি। বনবিভাগের সর্বোচ্চ আধিকারিক থেকে শুরু করে প্রতি স্তরের বনকর্মীর নিরলস প্রচেষ্টা , আন্তরিকতা এবং স্থানীয় মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে কানহার বারাশিঙ্গা সংরক্ষণ আজ আন্তর্জাতিক স্তরে একটি মডেল হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে শুধুমাত্র কানহার অরণ্যেই এদের সংখ্যা হাজারের ওপর। এছাড়া কানহা থেকে ভোপালের বন বিহার জাতীয় উদ্যান এবং সাতপুরা জাতীয় উদ্যানে ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ছয়টি পর্যায়ে প্রায় ৫৮ টি বারাশিঙ্গার সফল স্থানান্তকরণ সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে বান্ধবগড় জাতীয় উদ্যানেও কানহা থেকে এদের স্থানান্তর প্রক্রিয়া চলছে। সব মিলিয়ে মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ বনভূমিতে আজ এগারোশোর ও বেশি বারাশিঙ্গা নিশ্চিন্তে বিচরণ করছে। তাই একদা বিলুপ্তির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রাণীটি আজ শুধু কানহা নয়, সমগ্ৰ মধ্য প্রদেশের গর্ব, - Pride of Madhya Pradesh।


লেখক পেশায় প্রশাসনিক আধিকারিক। বন্যপ্রাণী প্রেমী।


ছবি: সুমন্ত ভট্টাচার্য্য ।




コメント


474525369_1074216644505260_833710345513391369_n.jpg
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG

Editor: Dr. Sumanta Bhattacharya
Co-editor: Dr. Oishimaya Sen Nag

  • Facebook

follow our facebook page to stay updated

© 2021 by Boney Pahare. All rights reserved.

bottom of page